ষাটোর্ধ্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা মঙ্গলু চন্দ্র রায়। বয়সের ভারে নিজে তেমন কিছু করতে পারেন না। তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন বড় ছেলে হরি কিশোর রায়। সংসারের খুঁটিনাটি থেকে বড় আয়োজন সব দেখতেন তিনি।
Advertisement
কিন্তু পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার করতোয়া নদীর মাড়েয়া আউলিয়া ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনায় সেই ছেলেকে হারিয়েছেন মঙ্গলু। শুধু হরি নন, হারিয়েছেন মেয়ে পারুল রানী, পুত্রবধূ কনিকা ও ছেলের শ্যালিকা মনিকা ও বিয়াই সরেন রায়কে। একসঙ্গে পাঁচ সদস্যকে হারানোর শোকে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ মঙ্গলু।
তিনি বলেন, ‘ওতোগুলা সাংবাদিক ছিলেন ওইখানে কী করলেন। আজ বক্তব্য নিতে আসছেন। ফায়ার সার্ভিস ছিল। তিনদিন হয় মরদেহটা আমাক দিতে পারলো না ওঠেয়া। অথচ পাবলিক তুলে দিল। আমি নিজেও সেন্সলেস। তারপরও যে দাঁড়িয়ে আছি আপনার মাঝে এটা ভগবানের কাছে আরাধনা করছি। এতো দুঃখ বেদনা দেওয়ার পর এর চেয়ে আমি কী বলবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজ বদেশ্বরী মহালয়া যাইতে কালে আমার বউ-ছোয়াল, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে হারাইলাম। দুঃখ থুবার জায়গা নাই। আমি তিনজন হারাইছি আমার পরিবারের আমার মেয়ে, বড় ছেলে, ছেলের বউ গেইছে। আমার প্রদীপটা শ্যাষ হয়া গেইছে। আমার যে একটা বংশের প্রদীপ। সেটা শ্যাষ হয়া গেইছে। এখন আমার সংসার কায় দেখবে?’
Advertisement
ওই ঘটনায় বেঁচে ফিরেছেন মঙ্গলুর জামাতা বিনয় চন্দ্র রায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আগে কাকিমারা চলে গেলেন। পরে আমরা উঠলাম মানুষের এত ভিড় কে শোনে কার কথা। ভগবানের নাম নিয়ে চলা শুরু করলাম এক মিনিটের মাথায় এমন ঘটনা। প্রাণে বেঁচে উঠে চারদিকে দেখি কেউ নাই। দাদা নাই, বৌদি, আমার বউ কেউ নাই।’
মঙ্গলুর ভাতিজা সুরেশ চন্দ্র বলেন, যে দাদা এ পরিবারটা চালাই তো, সেই এখন সংসারে নাই। দাদাই পরিবারটা ধরে রাখছিল, এ দাদার জন্য কান্নাকাটি, কী আর বলবো। আমাদের কদিন ধরে খাওয়া দাওয়াই বন্ধ। এখন এই কাকা আমার কীভাবে চলবে। তার এখন বৃদ্ধ বয়স, চলতে পারে না। কি করে চলবে।’
চাচি পতন বালা বলেন, ‘হরি কিশোরের সঙ্গে সব জায়গায় একসঙ্গে যাই। কোনটে ছাড়ি যায় না। ওইদিন একসঙ্গে যাওয়ার কথা হামরা কেনে বা আগত গেনো। কেমন করি এটা কি হয়া গেলো? এত বড় একটা বাড়ির তিনজন মারা গেইছে। কি করে থাকিবে এমরা (আমরা)।’
প্রতিবেশী বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমরাও ক্লান্ত হয়ে গেছি। মঙ্গলু ভাই যে কিভাবে এই শোক টা কীভাবে পালন করবে এটা উনি জানে আর আল্লাহ জানে। আমাদেরও কান্না আসে চোখে পানি রাখতে পারি না। আমি কথা বলতে পারছি না।’
Advertisement
২৫ সেপ্টেম্বর দুপুর আড়াইটার দিকে উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আওলিয়া ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে।
জেলা প্রশাসনের জরুরি তথ্য কেন্দ্রের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ৬৮ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। স্বজনদের দেওয়া তালিকা অনুসারে এখনো চারজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে।
৬৮ জন মৃতের মধ্যে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ৪৪ জন, দেবীগঞ্জের ১৮ জন, আটোয়ারীর দুজন, ঠাকুরগাঁওয়ের তিনজন ও পঞ্চগড় সদরের একজন রয়েছেন। এদের মধ্যে ৩০ নারী, ১৭ পুরুষ ও ২১ শিশু রয়েছে।
এসজে/এএসএম