বিশ্বে কতই না আজব জাতি আছে। যাদের অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড অন্যদের হতবাক করে চলেছে। এক জাতি আছে যারা শিশুদের নাম রাখেন আশেপাশের জিনিসের নামানুসারে। যেমন ধরুন- সেখানে গেলে শুনতে পাবেন কেউ ডাকছে ‘এই ফেসবুক কিংবা বাস কই গেলি রে, কফি এদিকে আয়’।
Advertisement
এমন কথা শুনে যে কেউ অবাক হবেন বৈকি! তবে সে জায়গায় এটি খুবই স্বাভাবিক। ভারতের বেঙ্গালুরু শহর থেকে বিশ মিনিটের পথ এই গ্রাম। পাহাড় ও অরণ্য ঘেরা এই গ্রামের নাম ভদ্রপুর। এখানে এলেই শুনবেন আরও বিচিত্র সব কথাবার্তা।
এখানে একসঙ্গে বাস করেন কংগ্রেস, অমিতাভ বচ্চন, সোনিয়া গান্ধী, ক্যালকাটা, ব্রিটিশ, হাইকোর্ট, কফি, বাস, ট্রেন, ফেসবুক, গুগল সবাই। এসবই একেকজন মানুষের নাম। আরও আছে, এখানকার বাবা-মা সন্তানের নাম রাখেন ইংলিশ, কফি, মিলিটারি, হোটেল, ডলার, মাইশোর পাক, হাইকোর্ট, পিস্তল, ভোটের বুথ, সাইকেল রানি, গভর্নমেন্ট, অনিল কাপুর, শাহরুখ খান, আমির খানেরাসহ আরও অনেক কিছু।
এ গ্রামে এমনই নিয়ম চলে আসছে বহুদিন ধরেই। সেখানে এগুলো খব স্বাভাবিক হলেও বাইরের মানুষের কাছে অস্বাভাবিক বটেই। এখানে শিশুদের নাম রাখা হয় বিভিন্ন নামবাচক বিশেষ্য দিয়ে। সেগুলি হতে পারে কোনও বিখ্যাত জায়গা, সরকারি অফিস, যানবাহন কিংবা কোনো খাবার। হতে পারে কোনো সেলিব্রেটি, রাজনৈতিক দল বা বিখ্যাত সোশ্যাল মিডিয়া। সোজা কথায় সন্তান জন্ম নেওয়ার পর যে নাম মনে আসে, সেটাই হয় সন্তানের নাম।
Advertisement
এই চল অনেক দিন থেকেই এখানে। ভদ্রপুর গ্রামের বাসিন্দারা খুবই সাধারণভাবে জীবনযাপন করে। এখানে নেই আভিজাত্যের ছোঁয়া। বাড়িগুলো টালির ছাদ দেওয়া। এখানকার আদিবাসীদের বলা হয়‘হাক্কি পিক্কি’। কন্নড় ভাষায় ‘হাক্কি পিক্কি’ শব্দের অর্থ ‘পাখি শিকারি’। এই সম্প্রদায়ের ১৪০টি পরিবারের বাস এই ভদ্রপুরে। তারা এবার গুজরাথিওয়া, কালিওয়ালা, মেওয়ারা, পানওয়ারা এই চারটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত।
হাম্পি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ট্রাইবাল স্টাডি’ বিভাগের গবেষণার মাধ্যমে জানা গিয়েছে, ‘হাক্কি পিক্কি’ সম্প্রদায়ের মানুষদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন রাজপুত। রাণা প্রতাপের সেনাবাহিনীর যোদ্ধা। তাদের পদবী ছিল সিংহ। মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর এই সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষেরা আশ্রয় নিয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অরণ্যে। যাযাবরের মত ঘুরে বেড়াতেন এখানে সেখানে।
খিদে মেটাতে বাধ্য হয়ে জঙ্গলের পশু ও মাছ স্বীকার করতেন। এটিই হয়ে যায় তাদের পেশায়। তবে এখন তাদের পেশা হস্তশিল্প। হাক্কি পাক্কিদের হস্তশিল্প বেশ জনপ্রিয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরও তারা বাস করতেন জঙ্গলে। ১৯৭০ সালে ভারতের বন দফতরের আইনে শিকার নিষিদ্ধ করা হয়। জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে আস তে বাধ্য হয় তারা।
ভারত সরকার তাদের বসবাসের জন্য জঙ্গলের পাশেই জমি দেয়। সেখানেই গড়ে ওঠে এই সম্প্রদায়ের এক নতুন ভুবন। এখন তারা প্লাস্টিক ও কাপড় দিয়ে মালা ও বাড়ি সাজানোর শৌখিন সরঞ্জাম তৈরি করেই জীবিকা চালান। হস্তশিল্পগুলো গ্রামবাসীরা বিক্রি করেন দীপাবলি ও রমজান মাসে। বিভিন্ন মেলাতেও দেখা যায় হাক্কি পাক্কিদের হস্তশিল্পের দোকান।
Advertisement
মূলত জঙ্গল ছেড়ে বাইরে আসার পর থেকেই সন্তানদের অদ্ভুত নাম রাখতে শুরু করে তারা। এর উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের আসল পরিচয় গোপন রাখা। ভদ্রপুরের গ্রাম প্রধানের নাম ‘হাইকোর্ট’। তার জন্ম হয়েছিল ভারতের হাইকোর্টের পাশে এক তাঁবুতে। এজন্যই তারা বাবা-মা সন্তানের নাম রাখেন হাইকোর্ট।
আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে- হাইকোর্টের দাদার নাম ছিল ব্রিটিশ। তিনি জন্মেছিলেন ব্রিটিশ আমলে। এখানে এক ছোট্ট মেয়ের নাম মাইশোর পাক। এটি সেখানকার একটি মিষ্টির নাম। মাইশোরের বাবা সেই মিষ্টি খেতে এতোই ভালোবাসেন যে নিজের মেয়ের নামই রেখে দেন এটি।
এখানে এলে দেখা পাবেন মিলিটারির। তার ছেলের নাম এবার বাহুবলী। ভারতের জনপ্রিয় দক্ষিণী সিনেমা বাহুবলী দেখে ভালো লেগে যায় তার। এরপর সন্তান জন্মালে তার নামই রেখে দেন বাহুবলী। এখানকার মানুষের আছে ভারতের নাগরিকত্ব ও জাতীয় পরিচয় পত্র। সেখানে তাদের নাম এগুলোই দেওয়া। অদ্ভুত সব নামের তালিকা থেকে বাদ যায়নি প্রযুক্তি বিশ্বও। আছে ফেসবুক, গুগলও। ভবিষ্যতে আসবে হয়তো টুইটার কিংবা ইনস্টাগ্রাম।
সূত্র: মেকমাইট্রিপ, নেটিভ প্ল্যানেট কেএসকে/এমএস