হঠাৎ ধরফরিয়ে ঘুমটা ভাঙতে দেখলাম পরিস্থিতি যেইকার সেই। বাইরে রোদের প্রখরতা অন্য দিনের চেয়ে এতটুকুও কম না, কিন্তু জ্যামটা ঢাকার চিরচেনা জ্যামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। বরং বলা ভালো কয়েকগুণের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি।
Advertisement
জ্যামে বসে থাকতে থাকতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ঠিকমতো ঠাহর করে উঠতে পারিনি। ঘুমটা ভাঙলো একটা দুঃস্বপ্নে। আর ঘুমটা ভাঙতেই দেখলাম এর মধ্যে আমার ভৌগোলিক অবস্থানের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
ঘুমিয়ে পড়ার আগের স্মৃতি হাতড়ে যতটুকু মনে করতে পারছি, আমার ঘুমিয়ে থাকার আনুমানিক এক থেকে দেড় ঘণ্টায় গাড়িটা এগিয়েছে বড়জোর একশ কি সোয়াশো গজ। কিন্তু তারপরও জ্যামটা কেন যেন দারুণ লাগছে! এককথায় এনজয় করছি।
আশপাশের পরিস্থিতিটাও তেমনটাই। অথচ অন্যসময় এমনটা কেন, এমনটার ধারেকাছেও কোনো জ্যাম হলে এতক্ষণে অধৈর্য গাড়িচালকদের খিস্তি-খেউরিতে কান পাতা দায় হতো। বলা যায় না, হয়তো এর মধ্যেই এর গালে ওর চপেটাঘাতের মতো পরিস্থিতিরও উদ্রেক হতো। তবে আজ সবকিছুই কেমন যেন উল্টে-পাল্টে গেছে। সবাই কেন যেন এই ভয়াবহ জ্যামটাকেই এনজয় করছে। এনজয় করছে শুধু এসি গাড়িতে বসেই নয়, এনজয় করছে নন-এসি বাসে বসে ঘামতে ঘামতে আর বাইকে বসে মনের আনন্দে বাঁশি বাজিয়ে।
Advertisement
রাস্তার পাশেও সারি সারি মানুষ। অনেকের হাতেই জাতীয় পতাকা। কেউ নাচছে, কেউ গাইছে আবার কেউ নাচছে এবং গাইছে। তাদের সেই স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে যোগ দিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরাও। চারপাশে এতশত উৎসবের কারণটা বুঝে উঠতে কয়েকটা সেকেন্ড সময় লাগলো।
আজ তো দেশে ফিরছে বাংলা মায়ের দামাল মেয়েরা। ফুটবল তো ফুটবল, সমাজের যত সংকীর্ণতা তার সবকিছুকে লাথিয়ে-উড়িয়ে দিয়ে আজ দেশে ফিরছে সাফজয়ী বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা। দোতলা খোলা বাসে তাদের আজ বরণ করতে ঢাকার রাজপথে বাঙালির অমন বাঁধভাঙা উল্লাস।
বাংলার নারীদের এই জয় শুধু দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলেই নয়, তাদের এই জয় এদেশে আর এদেশের সীমানা পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সব সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। ঢাকার রাজপথে তাই তো আজ মানুষের ‘ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই’ দশা।
দুই. ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে ওঠার ধাক্কাটায় খানিকটা ধাতস্ত হতেই মনে পড়লো দুঃস্বপ্নটার কথা। এই দুঃস্বপ্নটা আমি আগেও দু-একবার দেখেছি। স্বপ্নে দেখি আমি একটা জরাজীর্ণ অফিসের সামান্য বেতনের কর্মচারী। প্রতিষ্ঠানটা সম্ভবত কোনো সরকারি হাসপাতাল।
Advertisement
বোধকরি ফিল্ড লেভেলের কোনো প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ফ্যাসিলিটি। চারদিকে প্লাস্টার খসে পড়ছে। শেষ কবে রং করা হয়েছে কে জানে? রং তো দূরের কথা, শেষ কবে এই ছোট্ট বিল্ডিংটায় ঝাড়ুর পরশ লেগেছে তাও বোঝা দায়! এমন ভাঙাচোরা হাসপাতালটাই গিজগিজ করছে অসুস্থ মানুষে। তাদের শুশ্রূষা করার জন্য চিকিৎসক-নার্স দূরে থাক, হাসপাতালের কোথাও কোনো আয়া-ওয়ার্ডবয় আছে বলেও মনে হয় না। তবে আছে একজন পরিচালক, যদিও সে ডাক্তার নয়।
পাঞ্জাবের কোনো এক পচা কলেজ থেকে বিএ পাস করে এখানে এসে কর্তা হয়ে জুড়ে বসেছে। রোগীদের ভালোমন্দ তার মাথায় নেই। মাথায় নেই হাসপাতালের হাল হকিকতও। সারাদিন কাজ শুধু বাঙালি রোগী আর স্টাফগুলোকে দাবরে-থাপড়ে বেড়ানো।
অফিস তো অফিস নয়, যেন ডিটেনশন ক্যাম্প। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার মতো এসির ঠান্ডা বাতাস খাওয়া অধ্যাপক যদি এহেন স্বপ্ন দেখি, তাহলে অবস্থাটা কি দাঁড়ায়, ভাবুন তো দেখি একবার! দুঃস্বপ্নটা দেখে, ঘেমে-নেয়ে ধরফরিয়ে ওঠে এবং তারপর নারী টিমের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনজনিত জ্যামের ধাক্কাটা এনজয় করতে করতে এখন অবশ্য দারুণ লাগছে। খালি মনে হচ্ছে ভাগ্যিস!
তিন.বিদেশের মাটি দাপিয়ে বেড়ানো আমাদের নারী ফুটবলাররা, নারীর যে ক্ষমায়নের ফসল আর আমার মতো সরকারি হাসপাতালের সামান্য কর্মচারীর নিয়তি নিয়ে বেড়ে ওঠা পঁচাত্তর আর নব্বই পরবর্তী প্রজন্ম, এই যে আজ অমন সুরম্য-সুউচ্চ অট্টালিকার উচ্চতম ক্যারিয়ার গড়ার অবারিত সুযোগ পাচ্ছি, এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে একজন মহীয়সী নারীর কল্যাণে।
তিনি আমাদের এত বেশি কিছু এনে দিয়েছেন যা বলে-গুণে শেষ করার নয়। তিনি কোভিড ম্যানেজমেন্টে বাংলাদেশকে উঠিয়ে এনেছেন পদক তালিকায়। মহাকাশে পৃথিবীর চারপাশে আজ চরকি কাটছে আমাদের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আর মর্ত্যে বসে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি কর্নফুলীর তলদেশ দিয়ে গাড়ি চালানো আর মেট্রোরেলে ঢাকা মহানগরের দিগন্ত ছুঁয়ে চষে বেড়ানোর।
তিনি আমাদের পদ্মা নদীর দুকুলজুড়ে দেওয়া সেতুর ছায়ায় বসে ইলিশ ভাজা আর ইলিশের লেজ ভর্তা খাওয়ার উপলক্ষ্য এনে দিয়েছেন। শুধু তার কল্যাণেই সাবিনা-কৃষ্ণা-রুপারা আজকের সাবিনা-কৃষ্ণা-রুপা আর স্বপ্নীলরা আজকের অধ্যাপক স্বপ্নীল।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির কন্যা তিনি। পিতাকে তিনি ছুঁতে পারবেন না, কিন্তু সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির সিলভার মেডেলটি যে তার জন্যই নির্ধারিত, সেটা নিয়ে আমি নিশ্চিত দ্বিমত করার মতো একটি যুক্তিও কোথাও খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। সর্বকালের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠতম বাঙালি, বঙ্গবন্ধু কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনে তার শতায়ুর জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তাই শুধুই নিষ্কলুষ, ঐকান্তিক প্রার্থনা আমার, তার প্রতি অতল শ্রদ্ধা!
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/এমএস