ভ্রমণ

পতেঙ্গা থেকে সাইকেল চালিয়ে কক্সবাজার গেলাম যেভাবে

ইসমাঈল হোসেন নয়ন

Advertisement

ছোট-বড় সব সাইক্লিস্টের স্বপ্ন থাকে মেরিন ড্রাইভ রাইড, টেকনাফ টু তেঁতুলিয়া ক্রসকান্ট্রি রাইড কিংবা আখাউড়া টু মুজিবনগর ক্রসকান্ট্রি রাইডে যাওয়া। আমারও স্বপ্ন ছিল মেরিন ড্রাইভ রাইড দেওয়ার।

পড়ালেখার পাশাপাশি চাকরি জীবনে সুযোগ যেন আমার হাতে ধরা দিচ্ছে না। তবে ইচ্ছা থাকলে যে উপায় হয় এ বছর মার্চ মাসে হঠাৎ করে একদিন আগে পরিকল্পনা করি পতেঙ্গা-কক্সবাজার-মেরিন ড্রাইভ রাইডের।

পরিকল্পনায় সঙ্গী ছিলেন পতেঙ্গা সাইক্লিস্ট চট্টগ্রামের অ্যাডমিন ফাহিম আফজাল, ইফতেখার সাগর ও সাইফুল ইসলাম। ১৭ই মার্চ বিকেলে আমরা পরিকল্পনা করি ১৮ই মার্চ ভোরে রওনা দেওয়ার।

Advertisement

রাত দেড়টার দিকে ঘুমাতে গেলাম। উঠলাম ভোর সাড়ে ৪টায়। এরপর ফ্রেশ হয়ে ফজরের নামাজ আদায় করলাম। তারপর ফোনে যোগাযোগ করে রাইডার সঙ্গীদের মিটিং প্লেসে আসতে বললাম। শীতল বাতাস আছে তবে, তেমন শীত নেই তবে কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছিল না।

আমাদের রুটপ্ল্যান ছিল পতেঙ্গা-আনোয়ারা-বাঁশখালী-পেকুয়া-চকরিয়া-কক্সবাজার। সেহেতু পতেঙ্গা থেকে নৌকায় আমাদের কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে হবে। সময় এখন ভোর ৬টা ২০ মিনিট। ঘাটে নৌকা পারাপার সাময়িকভাবে বন্ধ কারণ, ঘন কুয়াশার জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

ঘাটে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছি। সময় এখন সকাল ৭টা বেজে ১৫ মিনিট। এখন একটি নৌকা ওইপাড়ের উদ্দেশ্য ছেড়ে যাবে। আমরা দেরি না করে সাইকেলসহ নৌকায় উঠে যায় তখনো কুয়াশা পরিষ্কার হয়নি। সবারই মনে দুশ্চিন্তা ছিল আদৌ কি এই নৌকা ওইপাড়ে সঠিকভাবে পৌঁছাতে পারবে কি না।

সবারই দুশ্চিন্তা সঠিক হলো, নৌকা ভুল গন্তব্যে চলে এসেছে। তবে পাড় ঘেঁষে আস্তে আস্তে ঘাটে নৌকা নোঙর করে। এখন সময় সকাল ৭টা বেজে ৫০ মিনিট। আমাদের রওনা দেওয়ার কথা ছিল ভোর ৬ টায় সেখানে প্রায় দু’ঘণ্টা দেরিতে রওনা দিলাম।

Advertisement

আনোয়ারা থেকে আমাদের স্বপ্নের রাইডের যাত্রা শুরু। পিচঢালা রাস্তাগুলোতে ভালোই সাইক্লিং করছিলাম। আমরা মূলত এই রুটপ্ল্যান ব্যবহার করছি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সাইকেল চালানো ঝুকিপূর্ণ বিধায়। আনোয়ারার চৌমুহনী পাড় হয়ে আমরা ঐতিহ্যবাহী সরকার হাট অতিক্রম করি প্রথমে। তারপর সাঙ্গুর তৈলারদ্বীপ ব্রীজ অতিক্রম করি।

একে একে চাঁনপুর বাজার, বানিগ্রাম, গুনাগারী বাজার অতিক্রম করলাম। হালকা নাশতা বিরতির জন্য আমরা থামলাম বাঁশখালীর জলধিতে। কলা বন ও চা খেয়ে আবারো আমাদের যাত্রা শুরু। ঘুরছে দু’চাকা চলছি স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে।

হঠাৎ সবাই সবার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলাম! আমরা তখন যেখানে অবস্থান করছিলাম সে জায়গার নাম প্রেম বাজার। সাগর ভাই বললেন, আমাদের সবার জীবনে প্রেমের অভাব। চলো কিছু প্রেম কিনে অভাব দূর করি। রসিকতা করতে করতে বাশখালী ও চট্টগ্রাম জেলাকে বিদায় জানিয়ে প্রবেশ করলাম কক্সবাজার জেলার আওতাধীন পেকুয়া উপজেলায়।

পেকুয়া উপজেলার কথা আমার আজীবন মনে থাকবে। পেকুয়া উপজেলা কমপ্লেক্সের এর আগে কয়েকজন কিশোর ফুল হাতে নিয়ে আমাদেরকে থামিয়ে ফুলের শুভেচ্ছা জানায়। এরপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ও পানি পান করে আবারও রওনা হলাম। আমরা জঙ্গলকাটা, রামপুর বাজার হয়ে চকরিয়ার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে উঠলাম।

তখন সময় দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট। জুমার নামাজ আদায়ের জন্য মহাসড়ক সংলগ্ন মসজিদে আমরা থামলাম। এরপর দুপুরের খাবার খেতে বসলাম। জমপেশ খাওয়া দাওয়া শেষ করে গন্তব্য এখন কলাতলী কক্সবাজারে। এখন সময় দুপুর ২টা বেজে ২০ মিনিট। এখনো কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ৫৫ কিলোমিটার। আর সবারই জানা চকরিয়া-কক্সবাজার সড়ক অনেকটা খাড়া।

আবারো যাত্রা শুরু দু’চাকায় ভর করে স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে। চকরিয়া-কক্সবাজার আপহিল সড়ক ভালোই ঘায়েল করছিল আমাদের। থামলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আবারো যাত্রা শুরু করে ডুলহাজরা, খুটাখালী, ঈদগাঁ থানা অতিক্রম করলাম।

ফাহিম ভাই আর সাগর ভাইয়ের লং রাইডের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল, তবে আমি আর সাইফুল একদম নতুন। নতুন হয়েও আমরা তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাইকেল চালাতে পেরেছি। ফুটবল চত্বরের কিছুটা আগে মহাসড়কের পাশে মসজিদে নেমে আমরা আছরের নামাজ আদায় করলাম। এরপর আবার যাত্রা শুরু।

এরপর কক্সবাজার সরকারি কলেজের সামনে দিয়ে আমরা চলে এলাম কলাতলী বীচ কক্সবাজার। অসম্ভব ভালো লাগছিল তখন। সরকারি ছুটির দিনে কক্সবাজারে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় থাকে। আমরাও এসেছি সরকারি ছুটিতে আগে জানতাম থাকার হোটেল পেতে কষ্ট হবে।

তাই এদিকটায় সময় নষ্ট না করে বিমানবন্দরের দিকে চলে গেলাম একটা থাকার উপযোগী আবাসিক হোটেলে ৪০০ টাকায় দরাদরি করে উঠে গেলাম। সবার পেটেই তখন ভীষণ ক্ষুধা। সবাই পর্যায়ক্রমে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেতে চলে গেলাম। তারপর এসে কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে মুয়াজ্জিনের ডাকে সাড়া দিয়ে নামাজ আদায় করতে গেলাম।

রাতের খাবার শেষ করে একটু ঘোরাঘুরি করেই রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ফাহিম আর সাইফুল রাতের কক্সবাজার দেখতে বের হলো। ঘুম হোক ভালোভাবে কারণ আগামীকাল তো যাচ্ছি স্বপ্নের মেরিন ড্রাইভে। ভোরে কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ নামাজ আদায় করে নাস্তা করে নিলাম। তারপর হোটেলে গিয়ে তৈরি হয়ে স্বপ্নের মেরিন ড্রাইভের উদ্দেশ্য রওনা দিলাম।

কলাতলীর ডলফিন মোড় অতিক্রম করে ঢুকে পড়লাম মেরিন ড্রাইভে। হ্যাচারি জোন অতিক্রম করে আমরা এখন হিমছড়ির দিকে। পরিকল্পনা ছিলো আমরা যাওয়ার পথে হিমছড়িতে সময় কাটাবো। হিমছড়ি থেকে গেলাম ইনানী বীচের পথে। একপাশে পাহাড় অন্যপাশে সমুদ্রের গর্জন ও নীল ঢেউয়ের হাতছানি। এই দুইয়ের মাঝখানে মেরিন ড্রাইভ পিচঢালা মসৃণ পথ।

ইনানী বীচ অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম ইনানী বীচ জেটি বরাবর। এবার থামতে হলো আমাদের... একই পথে ফিরছি হিমছড়িতে। দু’চাকায় ভর করে স্বপ্ন পূরণ করে আবারো ব্যস্ত নগরীর উদ্দেশ্যে ফিরছি। ফেরার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাতাস। বাতাসের বিপরীতে সাইক্লিং করতে বেশ কষ্ট।

অনেকগুলো চেকপোস্ট সব পর্যটক'কে কিছু না কিছু জিজ্ঞেস করে আমরাও চেকপোস্টের সামনে এখন। বিজিবির একজন কর্মকর্তা ডাক দিয়ে বললেন সাইক্লিস্ট ভাইয়েরা আপনারা চলে যান। আমরা এখন হিমছড়ির পথে।

হিমছড়ি এসে ফাহিম ভাই হ্যামক ঝুলিয়ে দিয়েছেন। হিমছড়িতে সময় কাটিয়ে হোটেলে এসে গোসল দিলাম সবাই। যোহরের নামাজ আদায় করে দুপুরে জমপেশ খাওয়া দাওয়া করে আপন গৃহে ফেরার প্রস্তুতি নিলাম।

জেএমএস/এমএস