চার হাজার বছর আগের পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন রোগ জলাতঙ্ক মানুষ তথা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এ রোগে বিশ্বে প্রতি মিনিটে ৯ জন মানুষ এবং বছরে ৫৯ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে। এ রোগের প্রাদুর্ভাব শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি লক্ষ্য করা যায়। এ রোগে আক্রান্ত শতকরা ৮০ ভাগ রোগীকে গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করতে দেখা যায়।
Advertisement
আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৪০ ভাগের বেশি ১৫ বছর বয়সের চেয়ে কম বয়সী কিশোর-কিশোরী। জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হলে ঢোক গিলার সময় ডায়াফ্রাম, রেসপিরেটোরি মাসল ও কণ্ঠনালির তীব্র ব্যথাযুক্ত সংকোচন হয়, বিশেষ করে পানি পান করার চেষ্টা করলে ডায়াফ্রাম ও অন্যান্য রেসপিরেটোরি মাসলের তীব্র সংকোচন ও ব্যথা হয় ফলে রোগীর মধ্য হাইড্রোফোবিয়া বা পানিভীতি তৈরি হয়।
ক্ষেত্রবিশেষে জলাতঙ্কে আক্রান্ত ব্যক্তির পক্ষাঘাত, শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়া, ঝিমুনি হওয়া, ক্ষতস্থানে অবশতা ও অসারতা অনুভূত হওয়া ইত্যাদি লক্ষণও প্রকাশ পেতে পারে। শরীরের শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ু ও মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়লে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত অবধারিতভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি সাধনকারী এবং মরণব্যাধি এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর পালন করা হয় বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারো “জলাতঙ্ক: মৃত্যু আর নয়, সবার সাথে সমন্বয়” এ স্লোগানকে সামনে নিয়ে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস।
Advertisement
জলাতঙ্ক একটি মরণব্যাধি। রেবিস ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত কুকুর, বিড়াল, শেয়াল, বেঁজি ও বানরের কামড় বা আচড় দ্বারা আক্রান্ত কোন ব্যাক্তি বা গৃহপালিত পশু জল দেখে আতঙ্কিত হলেই জলাতঙ্ক রোগ হয়। জলাতঙ্ক ভাইরাস জনিত এক ধরনের জুনোটিক রোগ অর্থাৎ এই রোগটি প্রাণি থেকে মানুষে ছড়ায়।
রেবিস ভাইরাস নামক একধরনের নিউরোট্রপিক ভাইরাস দিয়ে এই রোগ হয়। এই রোগ সাধারনত গৃহপালিত প্রাণি ও বন্য প্রাণিদের প্রথমে সংক্রমিত করে, মানুষ এই প্রাণিগুলির বা এদের লালার সংস্পর্শে আসলে বা এই প্রাণিগুলি যদি মানুষকে কামড়ায় অথবা আঁচড় দেয় তাহলে এই রোগ মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। জলাতঙ্ক রোগ এন্টার্কটিকা ছাড়া প্রায় সব মহাদেশেই দেখা গেছে। বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি।
প্রতিবছর বিশ্বে যত মানুষ কুকুরের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তার ৯৯ শতাংশই এই রোগের কারণে হয়। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের পার্শ্ববতী দেশ ভারতে প্রতি বছর ২০ হাজার ও বাংলাদেশে প্রায় ২ হাজার মানুষ মারা যায়।
এছাড়া প্রায় ২৫ হাজার গবাদিপশু এ রোগের শিকার হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের পরে বাংলাদেশেই জলাতঙ্ক রোগে মৃত্যুর হার বেশি। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ মানুষ কুকুর, বিড়াল, শিয়ালের এবং বেজির কামড় বা আচঁড়ের শিকার হয়ে থাকেন। যাদের বেশিরভাগই শিশু।
Advertisement
বিশেষজ্ঞদের মতে জলাতঙ্ক জীবাণুতে কোন কুকুর আক্রান্ত কি না তা জানার জন্য প্রথমত প্রয়োজন দংশিত কুকুরটিকে হত্যা না করে ১০ দিন বেঁধে রেখে চোখে চোখে রাখা। যদি কুকুরটি ১০ দিনের মধ্যে পাগল না হয় বা মারা না যায় তবে বুঝতে হবে কুকুরটি জলাতঙ্ক রোগের রেবিজ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত নয়। এতে কামড়ানো মানুষটিকে চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। আর যদি কুকুরটি অসুস্থ হয়ে যায় বা পাগল হয়ে যায় অথবা মারা যায় অথবা নিখোঁজ হয়ে যায় তাহলে কামড়ানো মানুষটির চিকিৎসা করানো অবশ্যই দরকার।
তাছাড়া নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে বুঝতে হবে কুকুরটি জলাতঙ্ক জীবাণুতে আক্রান্ত : প্রথমত সামনে যা কিছু পায় তাতেই কামড়ানোর প্রবণতা দেখায়। কোনো কোনো কুকুরের ক্ষেত্রে চুপচাপ থাকে। বাহিরের আলো সহ্য করতে পারে না। তাই ঘরের কোনে অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকে। তবে সাধারণভাবে আক্রান্ত কুকুরটি ১০ দিনের মধ্যে মারা যায়।
এছাড়া আক্রান্ত কুকুরটি উদ্দেশ্যহীনভাবে ছোটাছুটি করলে বা পাগলামী করলে, চলমান কোন বস্তুকে দেখলে কামড় দিতে চাইলে, কুকুরটি পাগল হয়ে গেলে, মুখ থেকে অত্যধিক লালা নিঃসৃত হলে, ঘন ঘন ঘেউ ঘেউ করলে এবং খাবার হিসেবে জল গ্রহণ না করলে বুঝতে হবে কুকুরটি জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে কোন ব্যক্তি আক্রান্ত হলে; প্রথমে আক্রান্ত ব্যক্তির ভীতি দূর করতে হবে। জলাতঙ্কে আক্রান্ত পশুটি মেরে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। নিকটবর্তী হাসপাতালে বা ক্লিনিকে নিতে হবে। বাজারে রাবিপুর নামে ইনজেকশন পাওয়া যায়। তা ডাক্তারের পরামর্শে গ্রহণ করতে হবে। প্রথম দিন দেয়ার পর ৩, ৭, ১৪, ৩০ ও ৯০ তম দিনগুলোতে ইনজেকশন দিতে হবে। কুকুর কামড়ানোর পরপরই টিকা নিয়ে মানুষ বেঁচে যেতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত গর্ভবতী নারীদেরও এ টিকা দেওয়া যায়।
এছাড়া কুকুরে কামড়ানোর সাথে সাথে প্রাথমিক চিকিৎসায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু আমরা না জানার কারণে প্রাথমিক চিকিৎসা না করে ডাক্তারের কাছে দৌড়ায়। কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, বেজি, বানরসহ যেকোনো বন্য প্রাণি কামড়ালে প্রথমেই কাপড় কাচার ক্ষারযুক্ত সাবান (রেবিজ ভাইরাসের সেলকে গলিয়ে ফেলে ক্ষার) দিয়ে প্রবহমান পানিতে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ মিনিট ক্ষতস্থান ধুতে হবে। এতে শতকরা ৭০-৯০ ভাগ জীবাণু মারা যায়।
তাছাড়া যেকোনো আয়োডিন বা অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে দিতে হবে কামড়ানো বা আঁচড় দেওয়ার ‘জিরো আওয়ার’-এর মধ্যে, অর্থাৎ যত দ্রুত সম্ভব টিকা দিয়ে ঝুঁকিমুক্ত থাকতে হবে। আবার যারা এসব প্রাণি নিয়ে কাজ করেন তারা সতর্কতামূলক অন্যান্য টিকার মতো আগেই টিকা দিয়ে রাখবেন, এটাই নিয়ম। তবে মনে রাখতে হবে চিকিৎসকই প্রয়োজনীয় চিকিৎসার উপদেশ দিবেন।
কামড় যদি গভীর হয় বা রক্ত বের হয়, তবে ক্ষতস্থানে রেবিজ ইমিউনোগ্লোবিউলিনসহ (আরআইজি) অ্যান্টি রেবিস ভ্যাকসিন যত দ্রুত সম্ভব দিতে হবে। বেশি রক্তপাত হলে তা বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণত কামড়ানোর ৯ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা দেয়। তাই লক্ষণ প্রকাশের আগেই চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের মতে, কোন ব্যক্তি যদি আক্রান্ত হয়ে যায় তাহলে সামাজিক প্রথাগত বাটিপড়া, পানপড়া, চিনিপড়া, মিছরিপড়া, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি করা যাবে না। ক্ষতস্থানে কোনো সেলাইন, বরফ, ইলেকট্রিক শক, চিনি, লবণ ইত্যাদি ক্ষারক পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না। ক্ষতস্থান কখনোই অন্য কিছু দিয়ে কাটা বা সেলাই, চোষন করা বা ব্যান্ডেজ করা যাবে না। হাত-পা বাঁধাও যাবে না।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে কুকুর কামড়জনিত জলাতঙ্কমুক্ত বিশ্ব গড়তে হবে। বৈশ্বিক উদ্যোগের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশও ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ জলাতঙ্ক রোগ নির্মূল করার লক্ষ্যে জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, সিডিসি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ সম্মীলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মকৌশলের মাধ্যমে এই অবহেলিত রোগটির বিরুদ্ধে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে এবং বাস্তবায়িত হচ্ছে ।
টিকার মাধ্যমে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ হয় এই সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে সারাদেশে ৬৭ টি কেন্দ্রের মাধ্যমে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিন এর চাহিদা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২ সালে বিনামূল্যে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার রোগী বেশি টিকা পেয়েছে যা ২০১৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৪০৯ এ উন্নীত হয়েছে । এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে সিডিসি কর্তৃক সারাদেশে প্রায় তিন লাখ ভায়াল ভ্যাকসিন দেশের বিভিন্ন জেলা সদর হাসপাতাল ও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, মহাখালীতে প্রদান করা হয়েছে।
কুকুর বা প্রাণির আচঁড় অথবা কামড়ের পর টিকা প্রদান করলে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ হয়। কিন্তু দেশ থেকে জলাতঙ্ক নির্মূল করতে হলে প্রয়োজন প্রথমে কুকুরকে জলাতঙ্ক থেকে নিরাপদ করা। করণীয় কর্মকৌশলের আলোকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রতি মিলিয়নে ১ জনের কম জলাতঙ্ক নির্মূল করা।
জলাতঙ্ক নির্মূলে ব্যাপকহারে কুকুর টিকাদান কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২০ পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশ ব্যাপী ব্যাপকহারে কুকুরের জলাতঙ্ক প্রতিষেধক টিকাদান (এমডিভি) বর্তমানে দেশে প্রায় ১৬ লক্ষ কুকুর রয়েছে। গার্ক এর মতে কোন দেশে বিদ্যমান কুকুরের শতকরা ৭০ ভাগ কুকুরকে যদি টীকা প্রদান করা যায় তাহলে এ রোগ শতভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
জলাতঙ্ক একটি ভয়ঙ্কর মরণব্যাধি। এ রোগে মৃত্যুর হার শতভাগ। বিশেষজ্ঞরা জানান , ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা এখন প্রায় জলাতঙ্কমুক্ত এবং সকল কুকুর বাধ্যতামূলকভাবে টিকাপ্রাপ্ত। দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যাপক হারে কুকুর টিকাদানের মাধ্যমে জলাতঙ্ক প্রায় নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
ঢাকা জেলার মহাখালীতে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কেন্দ্র ‘সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল’। এখানে প্রতিদিন প্রায় অর্ধ সহস্রাধিক কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত রোগীকে সেবা প্রদান করা হয়। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার উদ্যোগে ২০১১ সাল থেকে সারাদেশে ব্যাপক হারে কুকুর টিকাদান কার্যক্রম চালু হয়েছে।
টিকা প্রদান কর্মসূচি সম্পাদন ও দেশব্যাপী জনসচেতনতা মানুষের মাঝে তৈরি করতে পারলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও ২০৩০ সালের মধ্যে জলাতঙ্ক মুক্ত বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।
লেখক: গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
এইচআর/জেআইএম