মতামত

নারী ক্রীড়াবিদদের পেশাদার ভাবতে না পারা অক্ষমতা

বিজয় মঞ্চে উঠতে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অনেক বাধা পেরিয়ে আসতে হয় মেয়েদের। বিশেষ করে খেলার জগতে। সাফ চ্যাম্পিয়ন নারী দলের ফুটবলারদের নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। আর্থিক পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। হয়তো আরও বড় পুরস্কার অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। এর সব কিছুই তাদের প্রাপ্য।

Advertisement

কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, দুর্দান্ত খেলেও কাঠমান্ডু থেকে সোনালি রঙের ট্রফিটা যদি না আনতে পারতেন তারা; কতটুকু কি পেতেন! এই নারী ফুটবলাররা! বড়জোর কিছু প্রশংসা বাণী। ভালো খেলেছে মেয়েরা। এবার হলো না! হয়তো আগামীতে হবে! এরকম কিছু কথায় সীমাবদ্ধ থাকতো তাদের লড়াইটা।

এটা শুধু বাংলাদেশের অবস্থা নয়। এই উপমহাদেশের সব জায়গার চেহারাটাই এক। সাউথ এশিয়ান পিস অ্যাকশন নেট ওয়ার্কের অনুষ্ঠানে পাকিস্তান নারী ক্রিকেট দলের এক অধিনায়ক সানা মীরের একটা বক্তব্য পড়ার পর, মনে হচ্ছে নারীদের বেলায় এই উপমহাদেশের সব ক্রীড়াকর্তার মানসিকতাই এক।

সানা মীর বলেছেন; ‘নারী খেলোয়াড়দের আগে ফল দেখাতে হয়। তারপর জোটে আর্থিক সাহায্য কিংবা পুরস্কার যাই বলুন।’ সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের নারীদের ক্ষেত্রে কী ব্যতিক্রম কিছু হচ্ছে! বা অতীতে হয়েছে? না।

Advertisement

আসলে বৈষম্য টুর্নামেন্টের গায়েই জড়ানো রয়েছে। সাফ ‘নারী’ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া আছে। কিন্তু পুরুষদের টুর্নামেন্টে লেখা থাকে, ‘সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নিশপ!’ আসলে খেলাধুলার ক্ষেত্রেও নারীদের একটু খাটো করে দেখা হয়। সেটা বিশ্বজুড়ে। আধুনিক যুগেও খেলাধুলাকে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার বাইরে বের করে আনা সম্ভব হয়নি!

একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারী ফুটবলাররা পুরুষদের সমান বেতন-বোনাস পাচ্ছেন। সেটাও হাঠৎ করে আকাশ থেকে তাদের হাতে এসে পড়েনি। ২০২০ এ আদালতের রায়ে তারা ওই সমান অধিকারটা পেয়েছেন। কিন্তু তারও আগে তাদের বেলায়ও সানা মীরের বক্তব্যটাই সত্যি ছিল। ‘আগে করে দেখাতে হয়েছে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারী ফুটবল দল তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তারপরই তারা আদালত পর্যন্ত দৌড়ানোর সাহস পেয়েছেন। নিজেদের পক্ষে রায় পেয়েছেন।

বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করলেন। তারা কিছুটা করে দেখাতে শুরু করেছেন। কিন্তু তাদের আর্থিক লড়াইটা শুরু হয়েছে ঘর থেকে। বাড়ি থেকে। বেশিরভাগ খেলোয়াড় প্রান্তিক জনপদের নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন।

তাদের জন্য খেলাধুলা সম্মানের চেয়েও জীবিকার প্রতিশ্রুতিই বেশি। এতদিন যে টাকা তারা পেয়েছেন তা দিয়ে তাদের ভাগ্যের কতটুকু উন্নতি হয়েছে তাতো আমরা গণমাধ্যম থেকে সামাজিক মাধ্যমে অনেক ফুটবলারের বাড়িঘর দেখেই বুঝতে পারছি।

Advertisement

এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের নারী ফুটবলকে ক্রমাগত পেশাদারিত্বের পথে নিয়ে যাওয়া। তার জন্য প্রয়োজন অংশগ্রহণকারী ফুটবলারের সংখ্যা বাড়ানো। দরকার পরিকাঠামোর উন্নয়ন করা। সরকারি-বেসরকারি সাহায্য জড়ো করে নারী ফুটবলারদের জন্য পেশাদার একটা আর্থিক ভিত তৈরি করে দেওয়া। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অর্থ-ই সব নয়। এখানে নারীকে প্রতিনিয়ত তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়। সেই লড়াই বহুমাত্রিক।

ক্রীড়া মানবাধিকারের একটা লড়াই চলছে বিশ্বব্যাপী। ক্রীড়া মানিবাধিকার! কথাটা শুনতে একটু অন্যরকম মনে হতে পারে। খেলাধুলাই মানবাধিকার-শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম এক হাতিয়ার। সেখানে আবার ক্রীড়া মানবাধিকারের লড়াই কেন! হ্যাঁ, লড়াই। কারণ, এখানেও যা হয় তাতে নারীর অনেক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়। এবং এর অনেক কিছু সভ্য সমাজের কাছে অগ্রণযোগ্য।

নারীদের খেলাধুলা পরিচালনায় অনেক সমস্যা। সেই সমস্যা দিন দিন আরও জটিল হচ্ছে। এখনকার ক্রীড়াজগৎ পুঁজিবাদী শক্তি দ্বারা পরিচালিত। সেখানে সব সিদ্ধান্তই বাণিজ্যিকভাবে হয়। ঠিক যা পণ্য হওয়া সম্ভব তা-ই বিক্রি করা হয়! তাই নারী খেলোয়াড়দের পোশাক অনেক বেশি গুরুত্ব পায়। তাদের বেতন নয়।

বাংলাদেশে এই সমস্যা দুই ধরনের! একদল মানুষ আছেন যারা চিন্তার দীনতায় ভোগেন। তাদের কাছে নারী ক্রীড়াবিদের পোশাক হতে হবে এমন যাতে শরীরের কোনো অংশ-ই যেন না দেখা যায়! একদিকে বাণিজ্যিক চিন্তা। অন্যদিকে চিন্তার দীনতা! এই দুইয়ের মাঝে হারিয়ে যায় নারী খেলোয়াড়দের অধিকার।

শুধু ফুটবলার নয়; নারী ক্রীড়াবিদদের লড়াইটা নানা কারণে কঠিন হয়ে গেছে। আমরা মানতে চাই না তারাও হতে পারেন একজন পেশাদার ফুটবলার। পেশাদার ক্রিকেটার। পেশাদার আর্চার। পেশাদার ব্যাডমিন্টন-হকি-টেবিল টেনিস খেলোয়াড়। আর সব পেশাদার খেলোয়াড়ই পারিশ্রমিক আর সম্মান দুটোই প্রত্যাশা করেন। কিন্তু আমাদের সমাজের অক্ষমতা আমরা নারী ক্রীড়াবিদদের পেশাদার হিসেবে দেখতে পারি না! তাই তাদের আর্থিক নিশ্চয়তা, সামাজিক মর্যাদা কোনোটাই দিতে পারছি না! আমাদের এই মানসিকতার পরিবর্তন না হলে নারীদের এই সাফল্যগুলোর স্বীকৃতি কিছু সংবর্ধনার মঞ্চেই থেমে যাবে!

লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এমএস