হিমালয়ের পাদদেশ থেকে আসা করতোয়া নদী এমনিতে খুব একটা খরস্রোতা নয়; গভীরতাও কম। কিন্তু বর্ষা শেষে গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণের পর উজানের ঢলে নদীতে পানি বেড়েছে। গত রোববার ধারণক্ষমতার প্রায় তিনগুণ বেশি তীর্থযাত্রী ওঠে নৌকায়! এর ফলাফল হলো মাঝ নদীতে ডুবে গেলো শ্যালো ইঞ্জিনের নৌকাটি। মুহূর্তের মধ্যেই ম্লান হলো উৎসবের রং।
Advertisement
নদীর পাড়ে এখন কান্নার রোল। আহাজারি। স্বজনহারা মানুষের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠেছে পুরো জনপদ। একসঙ্গে এত প্রাণহানি, স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ এর আগে হয়তো দেখেনি এলাকার মানুষ। মর্মান্তিক এই ঘটনায় শোকে স্তব্ধ সবাই। বাকরুদ্ধ। কে দেবে কাকে সান্ত্বনা। এমনও আছে এক পরিবারে স্বজনহারা মানুষের সংখ্যা একাধিক।
সামনে শারদীয় দুর্গোৎসব, চারদিকে খুশির ধুম। কদিন ধরেই বাবার কাছে বিষ্ণুর নতুন জামা কিনে দেওয়ার আবদার। বাবা ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, মহালয়া শেষ হোক, তারপর। এ কথা শুনে বিষ্ণুর সে কী আনন্দ! সেই মহালয়ার দিনেই নৌকাডুবিতে অনেকের সঙ্গে প্রাণ গেলো ছোট্ট এই শিশুটিরও।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় মায়ের সঙ্গে মারা যায় বিষ্ণু। মাকে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় মা-ছেলের নিথর দেহ তোলা হয় নদী থেকে! শুধু স্ত্রী-সন্তান নয়, রবিন হারিয়েছেন আরও দুই স্বজনকে। সন্তানের খুশির জন্য ভাটাশ্রমিক সংসারের খরচ বাঁচিয়ে নতুন কাপড়চোপড় কেনার জন্য টাকা জোগাড় করেছিলেন। সেই টাকা এখন স্ত্রী-সন্তানের সৎকারে খরচ হবে! আনন্দের বিকালটা এত বিষাদ নিয়ে সামনে এসে হাজির হবে হয়তো কোনোদিন ভাবেননি তিনি। জানি না বিষ্ণুর বাবা এই দৃশ্য দেখার পর শোক সামলে কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন।
Advertisement
প্রশ্ন হলো দেশে একের পর এক ঘটে যাওয়া নৌদুর্ঘটনার জন্য দায় আসলে কার? গোটা দুনিয়ায় সবচেয়ে নিরাপদ হলো নৌপথ। কিন্তু নদীমাতৃক এই দেশে নৌপথকে গত ৫১ বছরেও নিরাপদ করা গেলো না, এর চেয়ে কষ্টের, ব্যর্থতা আর কী হতে পারে?
চোখের সামনে অবহেলা, ষড়যন্ত্র, দখল আর সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে নৌপথ। যতোটুকু আছে সেখানে দুর্ঘটনার ভয়। যে পথে ভয়, সেপথে মানুষ পা বাড়াবে না এটাই স্বাভাবিক। তাহলে কী নিরাপত্তার অভাবে ধীরে ধীরে দেশের নৌপথ বন্ধ হয়ে যাবে?
নানা কারণে এ প্রশ্ন আবারো সামনে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে দীর্ঘ নদীপথ সচল করার চেষ্টার কথা বলা হচ্ছে গত ১৪ বছর ধরে। ইতোমধ্যে কিছু নৌপথ যান চলাচলে সচলও হয়েছে। কিন্তু নজরদারি নেই এ পথে; তা আবারো স্পষ্ট হলো গত রোববারের নৌদুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে। এমনকি নৌদুর্ঘটনা রোধে সামান্যতম নিয়ম-কানুন নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না! এত বড় ব্যর্থতার কী কোনো জবাব নেই?
দেশে নৌযানের প্রকৃত সংখ্যা কত, নৌযানের ফিটনেস আছে কি না ও দুর্ঘটনার কারিগরি কারণ, নৌদুর্ঘটনার পর বিচার হওয়া না হওয়ার বিষয়টিও অনেক পুরোনো। তাছাড়া নৌযানটির ফিটনেস, লাইসেন্স আছে কি না? চালকের লাইসেন্স আছে কি না, নিরাপত্তা সরঞ্জাম আছে কি না, যাত্রী পরিবহনের জন্য নৌযানটি উপযুক্ত কি না এসব প্রাথমিক বিষয়গুলোও দেখার কেউ নেই। এত অবহেলার মধ্যে যোগাযোগের এত বড় একটি সেক্টর দিনের পর দিন চলতে পারে?
Advertisement
যদি নজর থাকতো তাহলে করতোয়ার বুকে শ্যালো মেশিনের এই নৌকাটি কীভাবে ধারণক্ষমতার তিনগুণ যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করলো? মানছি এটি নিয়মিত কোনো নৌপথ নয়। তাই বলে কী নদীতে কোনো নজরদারি থাকবে না? তাহলে নৌ সেক্টরে এক কর্তৃপক্ষ, পৃথক নৌ পুলিশ গঠন করা হলো কেন?
তবে এই দুর্ঘটনার জন্য সরকার যে একা দায়ী তা বলা যাবে না। যারা নৌকায় উঠেছেন তাদের মাথায় একবারও কেন কাজ করেনি এতো বেশি যাত্রী নিয়ে চলার নৌযান এটি নয়! যিনি চালক তিনি মানা করেছিলেন কি না খবর আসেনি। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলার সময় এলাকার কেউ বাধা দেয়নি? এটা কী আমাদের সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব নয়?
এই ধরনের নৌযানের চালকের লাইসেন্স বা যানের ফিটনেস মোটেই থাকার কথা নয়। অর্থাৎ সবার ভুল আর নজরদারির অভাবের খেসারত হলো এই দুর্ঘটনা, আর এত প্রাণের অকাল বিসর্জন, যা কখনই মেনে নেওয়া যায় না। যাবেও না।
সুগন্ধার পাড়ে আহাজারি থামতে না থামতেই শীতলক্ষ্যার তীরে স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ শুনেছে দেশসহ গোটা বিশ্বের মানুষ। সেই নৌদুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারো করতোয়ার বুকে নেমে এলো মৃত্যুর এক ভয়াবহ বিভীষিকা।
প্রতিটি নৌদুর্ঘটনার পর নৌপথের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠলেও সরকার, পরিবহন মালিক, শ্রমিক, যাত্রী থেকে শুরু করে সব পক্ষকে কম বেশি এর দায় রয়েছে। তবে নিরাপদ নৌপথের জন্য করণীয় সরকারের হাতেই বেশি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে নৌপথকে নিরাপদ করা হয়েছে সে ধরনের চিন্তার বাস্তবায়ন যদি কঠোরভাবে করা যেত তাহলে সবাই তা মানতে বাধ্য। তাহলে বিষয়টি একেবারেই পরিষ্কার সড়কপথের মতোই নৌপথ নিয়ে উদাসীনতা স্পষ্ট। ভালো করতে না দেওয়ার পেছনে যদি কোনো ষড়যন্ত্র থেকে থাকে তা কাম্য হতে পারে না। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে ২৩০টি সক্রিয় নদী বহমান আছে ও প্রায় ৪৫০টি নদী দখল ও দূষণের কারণে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছে। সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র কর্তৃক নদী ও পরিবেশ সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা আছে। নির্দেশনা মতো কি সব কাজ যথাযথ হচ্ছে?
সারাদেশে নৌযানের সংখ্যা ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের সংখ্যা কত এ তথ্যও জানে না নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। অবাক করা বিষয় হলো গত ৫০ বছরে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে অন্তত ২০ হাজার পথ! নৌপথ যে অবহেলার শিকার, এই পরিসখ্যান কি যথেষ্ট নয়?
তেমনি দেশে কত নৌযান চলাচল করবে, সরকারি দপ্তরে এর কোনো হিসাব থাকবে না, তা কাম্য নয়। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের নদ-নদীতে সাত লাখের বেশি নৌযান চলাচল করে। এর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ যাত্রীবাহী, বাকিটা পণ্যবাহী। নৌযানের ফিটনেস সনদ, চালকের দক্ষতা, প্রতিটি নৌযানে নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিশ্চিতসহ দুর্ঘটনার ঝুঁকি মোকাবিলায় নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে।’ ফলে সামনের দিনগুলোতে বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটারের কিছু বেশি নৌপথ হয়তো আরও সংকুচিত হয়ে যেতে পারে- এমন ধারণা অমূলক নয়।
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে যাত্রী ও পণ্যবাহী মিলিয়ে অনুমোদপ্রাপ্ত নৌযানের সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। এর মধ্যে প্রতি বছর প্রায় আট হাজার নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়। সরকারি হিসাবের নিবন্ধন করা নৌযানের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার অবৈধ থেকে যায়।
নৌযানের নিবন্ধন ও ফিটনেস দেখতেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরে মাত্র ১৮ জন পরিদর্শক! পাশাপাশি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ২৫ জন পরিবহন পরিদর্শকও ফিটনেসসহ নৌনিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়গুলো দেখেন! তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে স্বল্প জনবলের এসব পরিদর্শকদের কাজ আসলে কী? তাদের দায়িত্ব কি শুধু রেজিস্ট্রেশন করা নৌযান দেখা? নাকি গোটা নৌ-সেক্টরকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা?
এর বাইরেও নৌযানের সার্বিক কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্ব সরকারের দুই সংস্থা-নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর। অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশের ৮১ ধারা অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএর ৪৭ জন কর্মকর্তাকে অনিবন্ধিত ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আইনগত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা খুব কমই ওই আইনের প্রয়োগ করেন। নৌ ট্রাফিক বিভাগের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। নৌদুর্ঘটনার সময় নৌযানের ভেতরে থাকা জীবন বাঁচানোর সরঞ্জাম ব্যবহার হয়েছে এমন উদাহরণও কম। আসলে নৌযানের ভেতরে নিরাপত্তা সরঞ্জাম আছে কি না তা কে দেখবে?
নিয়ম অনুযায়ী, নৌযানগুলোর নিবন্ধন নেওয়ার পাশাপাশি প্রতি বছর ফিটনেস সনদ হালনাগাদ করতে হয়। এ সনদ দিতে নৌযানের মাস্টার-ড্রাইভারের সনদ, জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ও অন্য আনুষঙ্গিক বিষয়সহ ৫১টি বিষয় দেখেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়াররা। সেদিক দেখভালের শিথিলতা চরমে। তাই দায়িত্বশীলদের দ্রুত সময়ের মধ্যে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
সব আলোচনার সারসংক্ষেপ হলো তাহলে কি নৌপথ অরক্ষিত হয়েই থাকবে? সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই নৌপথকে নিরাপদ করার দৃশ্যমান পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাব। নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবার অন্তরালে গজিয়ে থাকা দেওয়ালটি চিহ্নিত করতে হবে। সেই সঙ্গে সবকিছুতেই স্বচ্ছতা জরুরি। তেমনি দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতে হবে। আনতে হবে জবাবদিহির আওতায়। সঠিক পদক্ষেপে নিরাপদ নৌপথ গড়ে তোলা সম্ভব হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়বে, তেমনি নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা আরও সুদৃঢ় হবে। চলমান অবহেলায় দেশের নৌপথ হারিয়ে যাক এটা কারও কাম্য হতে পারে না।
দার্শনিক কুনফুশিয়ান বলেছেন, ‘যদি এক বছরের জন্য পরিকল্পনা করো তবে শস্য বপন করো। যদি দশ বছরের জন্য পরিকল্পনা করো তবে বৃক্ষ রোপণ করো। যদি একশত বছরের জন্য পরিকল্পনা করো তবে সন্তানদের সুশিক্ষিত করো।’ তাই বলছি, সুশিক্ষিত সন্তান ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মধ্য দিয়েই আমরা শত বছরের পরিকল্পনায় নৌপথকে নিরাপদ করতে পারি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস