খেলাধুলা

সাধারণ মানের ঘরোয়া টুর্নামেন্টে পরিণত হচ্ছে বিপিএল!

ক্রিকেট রাজকীয় খেলা হলেও অনেকের কাছে কিছুটা বিরক্তিকর বৈকি! কারণ, সারাদিন বসে বসে একটি খেলা দেখার যৌক্তিকতা খুঁজে পেতেন না অনেকে। যে কারণে, গুটিকয়েক দেশছাড়া ক্রিকেটের বিস্তার খুব একটা হয়নি সারা বিশ্বে। বিশেষ করে ইউরোপে ইংল্যান্ডছাড়া অন্য কোনো দেশ, আমেরিকা কিংবা লাতিন আমেরিকায় ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি।

Advertisement

ক্রিকেটকে বিশ্বব্যাপি জনপ্রিয় করে তোলার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে আইসিসি। যার অংশ হিসেবে টি-টোয়েন্টি, টি-টেন কিংবা হান্ড্রেড ক্রিকেট ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। ১০-১২টি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বিশ্বের আনাচে-কানাচে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রচলন।

তবে, টি-টোয়েন্টিকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে ভারতের ঘরোয়া ফ্রাঞ্চাইজি লিগ আইপিএলের অবদানই সবচেয়ে বেশি বলা যায়। শুধুমাত্র ক্রিকেট নয়, এর সঙ্গে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের সংযোগ এবং বলিউডি গ্ল্যামার যুক্ত হয়ে আইপিএলকে সারাবিশ্বেই জনপ্রিয় একটি টুর্নামেন্টে পরিণত করেছে। যার দেখাদেখি বাংলাদেশে বিপিএল, ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিপিএল কিংবা পাকিস্তানে চালু হয়েছে পিএসএল।

করপোরেট দুনিয়ায় এখন হটকেক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। যে কারণে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজনে লগ্নি করতে পিছপা হচ্ছে না বিশ্বের নামি-দামি কোম্পানিগুলো। যার ফলশ্রুতিতে আরব আমিরাতে শুরু হতে যাচ্ছে আই লিগ। দক্ষিণ আফ্রিকায়ও অর্থের ঝনঝনানি দিয়ে একই সময়ে আয়োজন হতে যাচ্ছে আরও একটি লিগ। পাকিস্তানের পিএসএলও কম জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। পাশাপাশি ওয়েস্ট ইন্ডিজের সিপিএল, অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ কিংবা ইংল্যান্ডের দ্য হান্ড্রেড- ফ্রাঞ্চাইজি লিগের ছড়াছড়ি।

Advertisement

এতসব লিগের মাঝে কী অবস্থা বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ তথা বিপিএলের? ২০১২ সালে শুরু হওয়া বিপিএলকে দাবি করা হতো আইপিএলের পর সবচেয়ে জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট হিসেবে। কিন্তু সেই মর্যাদা কী সত্যি ধরে রাখতে পেরেছে বিপিএল? এক সময় বাংলাদেশের এই লিগে খেলার জন্য মুখিয়ে থাকতেন বিদেশি নামিদামি ক্রিকেটাররা, অথচ এখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, বিদেশি ক্রিকেটারই পাবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে।

আগস্টের মাঝামাঝি বিপিএলে বিদেশি ক্রিকেটার পাওয়া যাবে কি যাবে না- তা নিয়ে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছিল। সেই সংবাদেই বলা হয়েছিল, আই লিগ, দক্ষিণ আফ্রিকান লিগ কিংবা পিএসএল যখন তাদের লিগকে সাজানোর জন্য বিদেশি টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট ক্রিকেটারদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে দলভূক্ত করে নিচ্ছে, তখনও বিসিবি ঘুমিয়ে। তারা ফ্রাঞ্চাইজিই তখনও ঠিক করতে পারেনি যে কারা কারা খেলবে বিপিএলে।

শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরের একেবারে শেষ মুহূর্তে (২৫ সেপ্টেম্বর) এসে বিপিএল কর্তৃপক্ষ সাতটি ফ্রাঞ্চাইজির নাম ঘোষণা করেছে। আর তারপরদিন, আজ সোমবার বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিক প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিলেন, বিপিএলে ভালোমানের বিদেশি ক্রিকেটার পাওয়া যাবে না।

শুধু তাই নয়, বিদেশি অন্যান্য লিগের সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেও অনেক পিছিয়ে পড়েছে বিপিএল। সে মানের কোনো প্রতিযোগিতা বিপিএলে এখন আয়োজন করাও সম্ভাব নয় বলেও স্বীকার করে নিয়েছেন মল্লিক। তার স্পষ্ট কথা, ‘আমরা ভালোমানের একটি ঘরোয়া টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে চাই।’

Advertisement

মল্লিকের এই শেষ কথাতেই অনেক কিছু পরিষ্কার। ধীরে ধীরে মান হারিয়ে বিপিএল এখন সাধারণ মানের ঘরোয়া টুর্নামেন্টে পরিণত হতে যাচ্ছে। যে কারণে কাঙ্খিতমানের কোনো ফ্রাঞ্চাইজিও এবার বিপিএলে পাওয়া যায়নি। এতদিন বিপিএলে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে আসা বেক্সিমকো এবং জেমকন গ্রুপ আগ্রহই দেখায়নি বিপিএলে দল নিতে। বসুন্ধরা গ্রুপ ফিরে এলেও আগের মত এত লগ্নি করবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আজকের (সোমবার) সংবাদ সম্মেলনে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল সদস্য সচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিক, বিপিএলের ভবিষ্যদের রূপরেখা অনেকটাই স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলে দিয়েছেন, ‘একই সময় বিশ্বে আরও দুই তিনটা টপ লেভের টুর্নামেন্ট হচ্ছে।’ সুতরাং, তাদের সঙ্গে পাল্লা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

বিদেশি ক্রিকেটার পাওয়ার বিষয়ে মল্লিক বলেন, ‘বিদেশিদের ব্যাপারে আপনারা জানেন যে, সাউথ আফ্রিকান লিগ, ইউএই লিগ এসবে ভারতীয় ফ্র্যাঞ্চাইজিরাই ওউন করছে। বেশিরভাগ বিদেশি খেলোয়াড় ওইদিকে চুক্তিবদ্ধ হয়ে গেছে। আমরাও টুর্নামেন্টটা আগপিছ করতে পারছি না জাতীয় দলের ব্যস্ততার জন্য। সে ক্ষেত্রে যে জিনিসটা হচ্ছে বিদেশি খেলোয়াড় সর্বোচ্চ চারজন খেলতে পারবে একটা দলে তবে মাঠে সর্বনিম্ন দুজন যেন থাকে এরকম পরিকল্পনা করছি। বিদেশি খেলোয়াড়ের রেজিস্ট্রশনেও বাধ্যবাধকতা রাখব না। ধরেন কেউ তিনদিনের জন্য এসে খেলে গেলেও তার বদলি আরেকজন আসতে পারে আরকি।’

শুধু তাই নয়, বিদেশি আকৃষ্ট করতে শেষ চেষ্টা হিসেবে তাদের পারিশ্রমিকের ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা রাখছে না এবার বিসিবি। মল্লিক বলেছেন, ‘ফরেন সরাসরি সাইনিং লিমিটেশন রাখতে চাই না। আইপিএল ছাড়া অনেক টুর্নামেন্ট এখন, কাজেই ফরেন প্লেয়ার পাওয়াটাই এখন কঠিন।’

সংবাদ সম্মেলনের শেষ অংশে এসে বিপিএল সদস্য সচিব সত্য কথাটা উম্মোচন করেছেন। তিনি বলেন, ‘তখন কিন্তু এতগুলি টুর্নামেন্ট হতো না। সে জায়গায় আমরা ভাল অবস্থায় চলে গিয়েছিলাম। এখন বিশ্বে অনেকগুলো ভালো টুর্নামেন্ট চলে এসেছে। সিপিএল হচ্ছে, পিএসএল হচ্ছে, বিগ ব্যাশ হচ্ছে, ইউএই লিগ আসল, সাউথ আফ্রিকা করছে, সামনে শ্রীলঙ্কা করবে। এটা তুলনা করা কঠিন।’

অর্থ্যাৎ, প্রতিযোগিতায় বিপিএল অন্য অনেক দেশের নতুন নতুন টুর্নামেন্টের চেয়েও অনেক পিছিয়ে গেছে। সুতরাং, এবার আন্তর্জাতিক মানের নয়, ঘরোয়া মানের টুর্নামেন্টই আয়োজন করতে যাচ্ছে বিসিবি। মল্লিক বলেন, ‘আমরা আমাদের অন্যতম সেরা ঘরোয়া টুর্নামেন্ট করতে চাই। আগের প্যারামিটার দিয়ে বলতে পারব না, আমরা একেবারে আইপিএলে মানের বা পিএসএলের যে মানে করতে যায় সেটা আমাদের জন্য করা এই মুহুর্তে কঠিন হবে। কারণ এটা অনেক খরচের ব্যাপার। তাহলে একেকটা ফ্র্যাঞ্চাইজি বিক্রি করতে হবে অনেক টাকায়। আমাদের অন্য মডেলে যেতে হবে। এখন পর্যন্ত হোম এন্ড অ্যাওয়েতেই যেতে পারি না! আমাদের ভেন্যু রেডি না এজন্য। আমাদের ওয়ান অফ দ্য বেস্ট ঘরোয়া টুর্নামেন্ট করতে চাই।’

ভবিষ্যৎই বলে দেবে বিপিএলের ভাগ্য। আপাতত খালি চোখে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে হয়তো ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের চেয়ে একটু বেশি জমজমাট একটা টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হবে বিপিএল, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।

আইএইচএস/