মতামত

উৎসব হোক শঙ্কামুক্ত

শরতের সুনীল আকাশে শ্বেতশুভ্র মেঘের আনাগোনা। আরেক সাদা কাশবন কেবলই ঝলমলে উন্মুখ-উদ্বেল হতে শুরু করেছে নদ-নদীর রুপালি চরাচর। প্রকৃতি এভাবেই জানান দিয়েছে শারদীয় দুর্গোৎসবের আগমনী বার্তা। মর্ত্যলোকের মালাকার পল্লিতে এখনই দুর্গতিনাশিনী রূপে ধরা দিয়েছে দেবী।

Advertisement

আবারো দুর্গাপূজা ফিরছে উৎসবের রঙে। কেননা গত দুই বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়েছে দুর্গাপূজা। এ বছর সেই সব বিধিনিষেধ নেই। গত বছরের চেয়ে এবার ৫০টি বেশি মন্দিরে পূজা উদযাপন হবে। গত বছর ৩২ হাজার ১১৮টি মন্দিরে পূজা উদযাপন হয়। এবার এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ১৬৮টি।

রোববার মহালয়ার মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হয়েছে দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা। আগামী ১ অক্টোবর ষষ্ঠী তিথিতে দেবীর আমন্ত্রণের মধ্য দিয়ে শুরু হবে দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। ৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে তা শেষ হবে।

পূজা আসলেই কেমন যেন অনুভূতি তৈরি হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে শঙ্কা তৈরি হয়। এই বছর পূজাটি কেমন হবে? ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারবো তো ইত্যাদি ইত্যাদি। এই শঙ্কাটা স্বাভাবিকই বলা যায় কারণ প্রতি বছরই তো কোনো না কোনো মন্দিরে প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা ঘটছে। একটি বছর পর সবচেয়ে বড় উৎসব যেখানে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হওয়ার কথা সেখানে শঙ্কা তৈরি করা নিঃসন্দেহে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য কাম্য হতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ একটি বিচিত্র দেশ যেখানে নানান জাতির বসবাস। সেখানে রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের ব্যর্থতাই প্রকাশ পায়।

Advertisement

অন্যদিকে এই উৎসব আসলেই একটি গোষ্ঠী নিজেদের ধর্ম কায়েম করার সময়, স্বার্থহাসিলের সময় বা একটি অস্থিতিশীলতা তৈরির সময় মনে করে প্রতিমা ভাংচুরে লিপ্ত হয়। আর এই কাজটি করতে গিয়ে তারা শুধু শঙ্কাই তৈরি করে না, রাষ্ট্রের আইন, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ও অসাম্প্রদায়িতক চেতনা ক্ষুণ্ণ করে।

দুর্গা নামের বুৎপত্তিগত অর্থ যিনি দুর্গ অর্থাৎ সংকট হতে ত্রাণ করেন। শাস্ত্রে ‘দুর্গা’ শব্দটির একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে ‘দুর্গা’র ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ-কার’ ( ু ) বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ (র্ ) রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও ‘আ-কার’ ( া ) ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।

পন্ডিতরা বলছেন, শরৎকালের প্রথম শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথিতে মহালয়ার দিনে দেবীঘট স্থাপন করে শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। শরতকালের এ পক্ষকে দেবীপক্ষও বলা হয়। শাস্ত্রে আছে, দেবীদুর্গা হিমালয়বাসিনী দক্ষরাজার কন্যা। পিতৃগৃহে আগমন উপলক্ষে ষষ্ঠীর দিনে বিজয় শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে মর্ত্যলোকে মা দুর্গার আগমনকে স্বাগত জানানো হয়। এটিই দেবীর বোধন। এরপর যথাক্রমে মহাসপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ, অষ্টমীতে কুমারী ও সন্ধিপূজা এভাবে নবমী পার হয়ে দশমীর দিনে দেবী বিসর্জন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলেও পক্ষকাল চলে বিজয়া পুনর্মিলনী উপলক্ষে বিভিন্ন লোকজ উৎসব।

দেবী দুর্গার সৃষ্টি-রহস্যসমৃদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ শ্রীশ্রীচন্ডীতে উল্লেখ আছে, ব্রহ্মা মহিষাসুরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিয়েছিলেন কোন পুরুষ তোমাকে বধ করতে পারবে না। ব্রহ্মার বর পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে মহিষাসুর। একে একে বিতাড়ন করেন স্বর্গের সব দেবতার। উপায়ন্তর না পেয়ে দেবতারা অবশেষে ব্রহ্মার স্মরণাপন্ন হন। কিন্তু কী করবেন তিনি। নিজের দেওয়া বর ফেরাবেন কী করে?

Advertisement

এ অবস্থায় শিব ও অন্যান্য দেবতা সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মা যান স্বয়ং বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণু তাদের দুর্দশার কথা শুনে দেবতাদের বলেন, দেবতাদের নিজ নিজ তেজকে জাগ্রত করতে হবে। তখন দেবতাদের সমবেত তেজের মিলনে আবির্ভূত হবে এক নারী মূর্তি। সেই নারীই বিনাশ করবে মহিষাসুরকে।

বিষ্ণুর থেকে সবকিছু অবগত হয়ে দেবতারা হিমালয়ের পাদদেশে পূণ্যসলিলা গঙ্গার সামনে এসে প্রার্থনা শুরু করেন। দেবতাদের সম্মিলিত তেজরাশি থেকে দশদিক আলোকিত করে আবির্ভূত হন এক নারীমূর্তি। ইনিই দেবী দুর্গা নামে অভিহিত। তিনি আবির্ভূত হন দশভূজারূপে। দেবতাদের সব দুর্গতি বিনাশ করায় দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, মহিষমর্দিনী এবং অসুরদলনী নামেও পরিচিত। বৈদিক সূত্রে এ দেবীর উল্লেখ আছে। পুরাকালে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল বসন্তকালে। এ সময় দেবী দুর্গা ‘বাসন্তী’ নামে পূজিত হতেন, যা এখনও প্রচলন।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, সেদিন ‘কন্যারূপে’ বাপের বাড়ি অর্থাৎ মর্ত্যে আসেন দেবী দুর্গা। অসুর শক্তি বিনাশকারী দেবী দুর্গার আরাধনার মধ্য দিয়ে সমাজ থেকে দূর হবে সব পাপ। সমাজে ফিরে আসবে শান্তি। এবছর দেবী দুর্গা আসছেন ঘোটকে। এতে রবিশস্য ভালো হবে। দেবী বিদায়ও নেবেন দোলায় চরে। এতে দূর হবে সব অসুখ-বিসুখ। দেবীর যাত্রার সময় সব অসুখ-বিসুখ ধুলোর সঙ্গে উড়িয়ে নিয়ে যাবেন।

মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার পরিবারসমন্বিতা মূর্তির প্রচলন হয় ষোড়শ শতাব্দির প্রথম পাদে। পরিবারসমন্বিতা এই মূর্তিকাঠামোর মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী। তাঁর উপরিভাগে ধ্যানমগ্ন মহাদেব। মহিষাসুরমর্দিনীর ঠিক ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ; বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নিচে কার্তিক।

দুর্গার বিবরণের মধ্যে কোথাও কি অন্য ধর্মকে নিয়ে, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে, অমানবিক কোনো কথার প্রচলন আছে? সনাতনধর্মাবলম্বীরা যে দেশে সংখ্যায় কম সে দেশে তাদের উৎসব নিয়ে শঙ্কা যেমন হচ্ছে ঠিক অনুরূপভাবে যে দেশে সনাতনধর্মাবলম্বীরা বেশি সে দেশে সংখ্যা কম জাতির উৎসব নিয়ে শঙ্কা হয়। প্রকৃতপক্ষে আমরা সবাই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং আমাদের নির্ভরশীলতার জায়গা আস্থার হওয়া দরকার।

সমাজে সব মানুষই অসাম্প্রদায়িক তা নয় আবার সবাই সাম্প্রদায়িক তা কিন্তু নয়। জগতের সব কিছুই সৃষ্টি শুভর জন্য। তবুও অশুভর আগমন ঘটে, ঘটেছে, ঘটবে। জীবনে যেমন সুখ-দুঃখ রয়েছে তেমনি জগতেও থাকবে শুভ ও অশুভ। তবে অশুভর বিদায়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। কারণ অশুভ কখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। সবসময় অশুভর পরাজয় ঘটে। যেভাবে মহিষাসুর নামক অসুরদের হাত থেকে দেবকুলকে রক্ষা করেছিল মহামায়া দুর্গা। শুভর আগমন কেউ কখনো রুখতে পারবে না।

শারদীয় উৎসব হোক শঙ্কামুক্ত ও উৎসবমুখর। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার হোক এটাই আমার কাম্য।

লেখক: সাংবাদিক।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম