জাতীয়

নদীপথ উদ্ধার করে জনজীবনে সম্পৃক্ত করতে হবে

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ- কথাটি এখন ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। একটা সময় বাংলাদেশের পানির চাহিদা মিটতো নদী থেকেই। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল নদীনির্ভর। সে দিন এখন আর নেই। ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদী। সংকট দেখা দিচ্ছে বিশুদ্ধ পানির। এভাবে চলতে থাকলে নদীগুলো একসময় বড় আকারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে পরিবেশে। সংকট উত্তরণে নদীদূষণ বন্ধ, দখলমুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে নদীপথ উদ্ধার করে সম্পৃক্ত করতে হবে জনজীবনে। এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

Advertisement

বিশ্ব নদী দিবস ও এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য নিয়ে আলাপকালে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মো. এজাজ জাগো নিউজকে বলেন, এবারের প্রতিপাদ্য হলো ‘আমাদের জনজীবনে নৌপথ’। যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, তখন একটি জরিপে বলা হয়েছিল বাংলাদেশে নদীপথ ২৫ হাজার ১৪০ কিলোমিটার। এখন তা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের নদীগুলো মরে যাচ্ছে বা মেরে ফেলা হচ্ছে। এটার কারণ আছে। আমরা উজান থেকে পানি পাই না। নদী মানেই তো পানি। পানি না দিয়ে নদীগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে। পানি না পাওয়ার কারণে নদী শুকিয়ে গেলে দখল করা অনেক সহজ হয়। এছাড়া রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন হচ্ছে অনেক বেশি। সব নদী দখলদারই সাধারণত প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব কারণে আজ আমরা নদী শেষ করে ফেলছি।

নদীপথ পুনরুদ্ধার করে জনজীবনের সঙ্গে আবার নদীপথ সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আমরা একটা সার্ভে করেছি। আমরা দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের ১ হাজার ২৭৪টি নদী ছিল। এখন আছে ৭শ। ৫০ বছরে প্রায় ৫শ নদী বিলীন হয়ে গেছে। এটা অনেক বড় একটা সতর্কতা। এখন আমরা যদি নদীগুলো উদ্ধার করতে চাই, আমাদের কিছু কাজ করতে হবে।

Advertisement

‘প্রথমত, নদীপথগুলো ঠিকঠাক করতে হবে। কারণ পরিবেশের অন্য যেসব চাহিদা রয়েছে নদীর কাছে, তা মিটবে তখনই যখন মানুষ সেটাকে আবার চলাচলের মাধ্যম হিসেবে গুরুত্ব দেবে। মানুষ যে রাস্তা দিয়ে হাঁটে, সেই পথে কোনো ময়লা থাকে না। গ্রামে মানুষ যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটে, তখন সেখানে ঘাস জন্মে। তেমনিভাবে নদীপথ ব্যববহার করা হলে তবেই এটি পরিষ্কার থাকবে।’

নদী উদ্ধার কীভাবে করা যাবে সে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে কয়েক লাখ খাল আছে। শুধু এলজিইডিই তিন লাখ খালের ওপর কালভার্ট করেছে, রাস্তা করেছে। এসব করার কারণেই নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খালের যে ওয়াটার নেটওয়ার্ক ছিল তা ধ্বংস হয়ে গেছে। এজন্য আমরা বলছি, এবারের প্রতিপাদ্য আমাদের জনজীবনে নৌপথ। আমরা যদি কালভার্ট সরিয়ে খাল উদ্ধার করতে পারি, তখন আসলে নদীগুলো আবার ফিরে আসবে।

‘এখন যে নৌপথগুলো আছে, সেগুলো হলো বাণিজ্যিক কারণে। বাণিজ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্যই নৌপথগুলো এখনো আছে। বুড়িগঙ্গা নদী, ধলেশ্বরী, মেঘনা, যমুনা এসব তো বাণিজ্যিক কারণে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এটার উপকারভোগী তো সাধারণ মানুষ নয়। এটার উপকারভোগী রাষ্ট্র ও যারা ব্যবসা করছেন তারা। তাই আমরা মনে করি একদম মাইক্রো লেভেলে আগে যে নদীপথ ছিল সেটা যদি ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে নদীগুলো উদ্ধার করা যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে নতুন করে খুঁজে বের করতে হবে যে, নদীর ওপর প্রতিবন্ধকতা কী ছিল। পরিবেশগত চাহিদায় আমাদের নদীর প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমরা যদি নৌপথের জন্য নদী সংরক্ষণ করি, তবে সব চাহিদাই পূর্ণ হবে।’

নদী আগে দূষণমুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ইনামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের নদীগুলোর উৎস দুই রকম। এক হলো অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে। আর কিছু হলো দেশের বাইরে বা ভেতর থেকে আসে। বাইরে থেকে যেগুলো আসে, সেগুলোকে আমরা বলি যৌথ নদী। সব নদী শীতকালে শুকিয়ে যায়। কিছু নদী শীতকালে শুকিয়ে গেলেও প্রবাহ থাকে। বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য ওই নদী দিয়ে আসে। এটা প্রকট আকার ধারণ করেছে ঢাকার আশপাশে।

Advertisement

‘নরসিংদী, ময়মনসিংহ ও মানিকগঞ্জ এসব এলাকায় কলকারখানা বেশি। নদীতে এত বেশি তরল বর্জ্য ছাড়া হয় যে পানি কালো। ঢাকার কাছাকাছি বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা নদীতে আমরা তা দেখতে পাই। এই পরিস্থিতিতে নদীগুলো রক্ষা করতে আমাদের প্রধান কাজ হবে, পরিবেশ সংরক্ষণ করার আইন প্রয়োগ করে দূষণ বন্ধ করা।’

নদী উদ্ধারে সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, দূষণ বন্ধ করায় আবার একটা সমস্যা আছে। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ করতে হয়। যেহেতু ক্ষতিগ্রস্তরা অধিকাংশই সাধারণ মানুষ, তাই পরিবেশ আইনটা প্রয়োগ করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা দিতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভার বাজেট খরচ করে মামলা করবে। আমাদের নদীগুলো দূষণমুক্ত করতে পারলে আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারে। কারণ এর একটি ঐতিহাসিক প্রবাহ আছে। দূষণ দূর করতে পারলে কেবল ছোট ছোট নদীই নয়, আমাদের আশপাশে বুড়িগঙ্গা শীতলক্ষ্যা নদীকেও আমরা ফিরে পাবো।

দখলমুক্ত করার আগে দূষণমুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, নদী দখল হচ্ছে। অধিকাংশই দখল হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। আমরা দখলটা যখন সামনে আনি, তখন দূষণ পেছনে পড়ে যায়। যখন একপাশ দখলমুক্ত করি, তখন অন্যপাশ দখল হয়ে যায়। এজন্য আগে দরকার দূষণমুক্ত করা। পরে দখলমুক্ত করা যাবে।

বাপার সাধারণ সম্পাদক ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের নদী অন্য দেশের মতো নয়। একেকটি ভৌগোলিক এলাকার নদী একেক রকমের হয়। বাংলাদেশে যে নদীর কথা আমরা বলি, সে নদী এখন আর নদী থাকছে না। নদীগুলো খালে পরিণত হচ্ছে এবং দূষিত নর্দমা হয়ে যাচ্ছে। কাজেই বাংলাদেশের নদী যদি বাংলাদেশ রক্ষা না করে, তাহলে প্রাকৃতিকভাবে মানুষের জন্য ব্যাপক হুমকি তৈরি করবে।

তিনি বলেন, সরকারের পলিসিতে নদী সংরক্ষণের কথা আছে। কিন্তু বাস্তবে যেটা হচ্ছে সেটা তো মিলছে না। তাদের জবাবদিহি নেই, এ কারণে এসব হচ্ছে। বর্তমান যুগে প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করে কীভাবে উন্নয়ন করা যায় সে জ্ঞান মানুষের আছে।

এমআইএস/এএসএ/জিকেএস