ফার্মেসি ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি’ একটি সাবজেক্ট এবং স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা। সহজভাবে এটি হলো ওষুধবিজ্ঞান। ওষুধ বানানো, এর মান নির্ধারণ, ব্যবহার, বিতরণ, পরিবেশন—এসবই এর আলোচ্য বিষয়। ১৯৬৪ সালে দেশে ফার্মেসি বিষয়ে শিক্ষার যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি প্রোগ্রাম পড়ানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি প্রোগ্রামে পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের নানা বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. এনামুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
Advertisement
জাগো নিউজ: ফার্মেসি প্রোগ্রামে পড়ার যোগ্যতা কী?মো. এনামুল হক: যে কেউ ফার্মেসি প্রোগ্রামে পড়তে চাইলে এসএসসি ও এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করতে হবে। সে ক্ষেত্রে উভয় পরীক্ষায় জিপিএ সর্বনিম্ন ৭-৮ পয়েন্ট হতে হবে। বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের নিয়ম অনুযায়ী গণিত বিষয়ে ২.৫ পয়েন্ট হতে হবে। এ ছাড়াও জীববিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান আবশ্যিক বিষয় হিসেবে থাকতে হবে। তবে দেখা যায়, যাদের পয়েন্ট ভালো; তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেয়ে যান। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিষয়ে স্নাতকে ভর্তি হতে ‘ক’ ইউনিট কিংবা জীববিজ্ঞান অনুষদের পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।
জাগো নিউজ: ফার্মেসিতে পড়ার জন্য কোথায় কোথায় ভর্তি হওয়া যায়?মো. এনামুল হক: ফার্মেসি পড়ার জন্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা ও কুমিল্লা (বিশ্ববিদ্যালয়) এবং যশোর, পাবনা, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নোয়াখালী (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) অন্যতম। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়, মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়, আশা, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনাল, বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি অন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাচেলর ও মাস্টার্স ডিগ্রি রয়েছে। কেউ চাইলে পিএইচডি ডিগ্রিও করতে পারবেন। এ ছাড়া অনেক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ফার্মেসিতে ৪ বছরের ডিপ্লোমা করা যাবে। আবার কেউ চাইলে তিন মাসে ফার্মেসি সার্টিফিকেট রেজিস্ট্রেশন কোর্স করতে পারবেন। তারা মূলত ওষুধ বিপণনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এর জন্য মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পাস হতে হবে।
জাগো নিউজ: ফার্মেসি প্রোগ্রামে কী কী বিষয়ে পড়ানো হয়?মো. এনামুল হক: ফার্মেসি মূলত মেডিকেল সায়েন্সের একটি অংশ। মেইন কোর্স হচ্ছে ‘ফার্মাকোলজি’। যেখানে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ওষুধের অ্যাকশন এবং শরীরে যাওয়ার পর ওষুধ কীভাবে কাজ করছে, তা সম্পর্কে জানা যায়। ‘ফার্মাসিটিক্যাল টেকনোলজি’ বিষয়ে ওষুধ তৈরির বিষয়াদি সম্পর্কে পড়ানো হয়। ‘মেডিসিনাল কেমেস্ট্রি’তে মেডিসিন আবিষ্কার সম্পর্কে পড়াশোনা করা হয়। ‘বায়োফার্মাসিউট্রিক্স’ বিষয়ে শরীরে ওষুধ কীভাবে কাজ করছে এবং তা ছড়িয়ে পড়ছে, তা সম্পর্কে পড়ানো হয়। ‘প্যাথোলজি’ বিষয়ে রোগ নির্ণয় করে ওষুধ ব্যবহার সম্পর্কে পড়ানো হয়। ড্রাগ অ্যান্ড ডিজিজ ম্যানেজমেন্ট’ বিষয়ে কারো অসুখ হলে কোন ওষুধ দিয়ে ম্যানেজ করা যায়, তা সম্পর্কে পড়ানো হয়। এ ছাড়া ইমিউনোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমেস্ট্রি, ফিজিওলজি এবং অ্যানাটমিও পড়ানো হয়। ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্টরা ‘এ’ গ্রেড ফার্মাসিস্ট, ডিপ্লোমাধারীরা ‘বি’ গ্রেড ফার্মাসিস্ট এবং ফার্মেসি সার্টিফিকেট রেজিস্ট্রেশনধারীরা ‘সি’ গ্রেড ফার্মাসিস্ট।
Advertisement
জাগো নিউজ: ফার্মেসি প্রোগ্রামে ইন্টার্নশিপ করতে হয়?মো. এনামুল হক: পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে কেউ ফার্মেসিতে বি.ফার্ম (ব্যাচেলর অব ফার্মাসি) কমপ্লিট করলে তাকে অবশ্যই ইন্টার্নশিপ করতে হয়। দেশে যেসব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি রয়েছে, সেখানে গিয়ে প্রত্যক্ষভাবে ইন্টার্নশিপ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট থেকে কোম্পানিগুলোতে চিঠি দেওয়ার মাধ্যমে তাদের ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। পাঁচ বছরের প্রোগ্রামের জন্য তিন মাস হাসপাতাল এবং ইন্ডাস্ট্রি উভয় স্থানে ইন্টার্নশিপ করতে হয়। চার বছরের প্রোগ্রামের জন্য একমাস শুধু ইন্ডাস্ট্রিতে ইন্টার্নশিপ করতে হয়। সবশেষে ইন্টার্নশিপের পর তাদের রেজাল্ট প্রস্তুত করা হয়।
জাগো নিউজ: ফার্মেসিতে পড়ে চাকরি বা কাজের সুযোগ কেমন? মো. এনামুল হক: ফার্মেসিতে গ্র্যাজুয়েটদের ভালো ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানিতে প্রোডাকশন, প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট, প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট, কোয়ালিটি কন্ট্রোল ও ট্রেনিংসহ বিভিন্ন বিভাগে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের চাহিদা রয়েছে। ফার্মাসিস্টরা ওষুধ বা ফার্মেসি সংশ্লিষ্ট পণ্যের উৎপাদন, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, মানোন্নয়ন, মাননিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। ওষুধ প্রশাসনের মাধ্যমে পরিচালিত ‘ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা’ দেশের প্রতিটি জেলা শহরে রয়েছে। এর দ্বারা ফার্মেসির ব্যবসাগুলো তদারকি করা হয়। ‘বিসিএসআইআর’ নামক সংস্থা রোগ নিয়ে গবেষণা করে থাকে। সেখানে চাকরির সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি সব চাকরিতে যোগদান করতে পারবেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ওষুধশিল্প ছাড়াও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ফার্মাসিস্ট, ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট, ফার্মেসি ম্যানেজার হিসেবে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতে পারবেন। ফার্মেসি প্রোগ্রাম থেকে পরীক্ষা দিয়ে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরির সুযোগ রয়েছে।
জাগো নিউজ: ফার্মেসি প্রোগ্রামে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে পড়ার খরচ কেমন?মো. এনামুল হক: ফার্মেসিতে ৪ এবং ৫ বছর মেয়াদি কোর্স পড়ানো হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন খরচ নেই বললেই চলে। পাবলিকে পুরো কোর্সে ৩০-৪০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যালেচর প্রোগ্রামের জন্য সাড়ে ৮ থেকে ১৩ লাখ টাকার মতো খরচ হবে। আবার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ থেকে ৮ লাখ টাকায় বি.ফার্ম (ব্যাচেলর অব ফার্মাসি) কোর্স করা যায়। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার কোর্স চালু রয়েছে। খরচ পড়বে এক থেকে দুই লাখ টাকা।
জাগো নিউজ: ফার্মেসি বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধা কেমন?মো. এনামুল হক: ফার্মেসি একটি যুগোপযোগী প্রোগ্রাম। এর মূল কাজ হচ্ছে ওষুধ আবিষ্কার, উৎপাদন এবং গুণগত মান উন্নয়ন। এর জন্য উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার অনেক সুযোগ রয়েছে। ফার্মেসি পড়ে ফার্মাকোলজি, বায়োটেকনোলজি, বায়োইনফরমেটিকস, নিউরোসায়েন্স, জেনেটিকস ইনফরমেশনসহ অনেক বিষয়েই উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই ফার্মেসি প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। আমেরিকায় এ প্রোগ্রামের জন্য উচ্চশিক্ষার (মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি) সুযোগ রয়েছে। আমেরিকাসহ কানাডা, মধ্যপ্রাচ্য, জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। ফার্মাসিউট্রিক্স, ফার্মাসিটিক্যাল টেকনোলজি, ফার্মাসিটিক্যাল কেমেস্ট্রি, নিউরোলজি, বায়োমেডিকেল সায়েন্স, ফিজিওলজি, প্যাথোলজি ও টক্সিকোলজি প্রোগ্রামগুলোয় উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া পাবলিক হেলথ, বায়োকেমেস্ট্রি, মলিকুলার বায়োলজি, ইমিউনোলজি প্রোগ্রামে উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে।
Advertisement
জাগো নিউজ: বাংলাদেশে ফার্মাসিস্টদের প্রয়োজনীয়তা কেমন?মো. এনামুল হক: বাংলাদেশে ফার্মাসিস্টদের প্রয়োজনীয়তা অতীতে যেমন ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বর্তমানে দেশে ২৫০টির উপর ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানিতে বহু সংখ্যক ফার্মাসিস্ট কাজ করেন। ওষুধের গুণগত মান উন্নয়ন, ওষুধ প্রস্তুত এবং ওষুধ গবেষণা ইত্যাদির জন্য প্রচুর ফার্মাসিস্ট দরকার। প্রতিবছর অনেক গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট বের হচ্ছেন। তারপরও ফার্মাসিস্টদের সংকট থেকে যায়। কারণ অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে চলে যান এবং পরে সেখানেই সেটেল্ড হচ্ছেন। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর ২-৬ মাসের মধ্যে সবারই চাকরি হচ্ছে। তাই বলা যায়, দেশে ফার্মাসিস্টদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। উন্নত বিশ্বে ব্যাপক হসপিটাল ফার্মেসি ও ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি রয়েছে। যেখানে ডাক্তারদের পাশাপাশি ফার্মাসিস্টরা ওষুধের বিষয়ে অনেক ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন। বাংলাদেশেও হসপিটাল ফার্মেসির ও ক্লিনিক্যাল ফার্মেসির ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেখানে ফার্মাসিস্টরা ভালো ভূমিকা রাখতে পারবেন।
এসইউ/জেআইএম