ভ্রমণ

একদিনে ঝিনাইদহে ঘুরে দেখার মতো যত স্থান

আজাহারুল ইসলাম, ইবি

Advertisement

পরীক্ষা শেষ। কয়েকদিন ক্লাস ছুটি। মন গেয়ে উঠলো রবীন্দ্রনাথের ছুটি কবিতার একটি লাইন ‘আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি।’ ছুটি পেয়ে কয়েকজন বন্ধু বাড়িও ফিরেছে। স্বল্প ছুটি আর বেশি দূরত্বের কারণে আর বাড়ি ফেরা হয়নি।

হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে দিতে বন্ধু ফাহাদ বললো, ‘বন্ধু চল আশপাশের কোথাও থেকে ঘুরে আসি।’ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে স্থান নির্বাচন হলো ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার কিছু দর্শনীয় স্থান। সেদিন রাতে প্রাথমিক সম্মতি দিলেও দোটানায় ছিলাম।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফাহাদকে খুদেবার্তায় জানালাম, ‘সবাইরে কল দে, ঘুরে আসি।’ যেই কথা সেই কাজ। বন্ধু মামুনের টিউশনি থাকায় সে আগেই ঝিনাইদহ শহরের দিকে গেল। আর আমরা- ফাহাদ, তরঙ্গ আর তিনজন জুনিয়র রিয়াদ, ইমরান, রুবায়েত সহ মোট ৬জন ১১টার দিকে বেড়িয়ে পড়লাম ঝিনাইদহের দিকে।

Advertisement

শহরে পৌঁছানোর পর টিউশনি শেষে যুক্ত হলো মামুন। তাকে নিয়ে আমরা সাতজন রওনা হলাম এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ বটগাছ দেখতে।

কিছুক্ষণ বাসে যাওয়ার পর কালিগঞ্জ বাজারে পৌঁছে অটোরিকশা নিয়ে চললাম বিখ্যাত সেই স্মারক বটবৃক্ষ দেখতে। ব্লুটুথ স্পিকারে গানের তালে সর্পিল সরু পাকা রাস্তা ধরে চলছিল অটোরিকশা।

দু’দিকে দিগন্তজোড়া মাঠ, পুকুর, গাছপালার দৃশ্যও মনোরম। যেন নিপুন কোনো শিল্পীর হাতে গড়া। সেই সরু পথ একেবারে ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ থানার সুইতলা মল্লিকপুর গ্রামের বটগাছের কোলে এসে থেমেছে।

নেমেই দেখা মিললো আমেরিকা থেকে আসা কয়েকজন পর্যটকের। তবে তারা সূদুর থেকে আসলেও বাঙালি সংস্কৃতির পোশাক পড়েছে, যা দেখে ভালো লাগলো। বাচ্চারাও যেন ৮-১০টা বাঙালি শিশুর মতোই ছিল দূরন্তপনা। গাছের এ ডাল থেকে ও ডাল, এ জায়গা থেকে ও জায়গায় ছুটছে।

Advertisement

বটগাছতলা

জেলা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটারের দূরত্ব। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এশিয়া মহাদেশের ‘সর্ববৃহৎ বটবৃক্ষ’। ১৯৮৪ সালে সর্ববৃহৎ তকমা জুড়ে দিয়েছে বিবিসি জরিপ।

দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ পাহাড়। পুরো গাছটি এক দৃষ্টিতে আনা অসম্ভব। বন বিভাগ ও স্থানীয়দের ভাষ্য, জায়গাটি বহু আগে কুমার সম্প্রদায়ের বসতির জন্য বিখ্যাত ছিল।

সেই সময় কুমার সম্প্রদায়ের লোকেরা পাতকুয়া ব্যবহার করতো, সেন বংশীয় কুমার পরিবারের কোনো একজনের পাত কুয়ার উপর একদিন একটি গাছ জন্মে। তা প্রায় ৩১৫ বছর আগের কথা।

মূল গাছটি মারা গেলেও এটি ৪৫ এটি ভিন্ন ভিন্ন গাছে প্রায় ২ দশমিক ৮ একর জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে। যার উচ্চতা প্রায় আড়াইশ থেকে ৩০০ ফুট। এর ৩৪৫টি বায়বীয় মূল মাটিতে প্রবেশ করেছে ও ৩৮টি মূল ঝুলন্ত অবস্থায় বিদ্যমান।

বটগাছ শুধু বটগাছই নয়। আঁকাবাঁকা বিভিন্ন আকৃত্তির ডালপালা, বসার জন্য জায়গা, গোল ঘর, পাখির কলতান, দেশী-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা এর সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

চারপাশে বটগাছ, ছায়াঘেরা শীতল হাওয়া যে কারো মনে অন্যরকম প্রশান্তি জোগাবে। জার্নি করে যাওয়ার পর বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কিছুক্ষণ বসলেই প্রশান্তির ঘুম চলে আসবে।

ডানে বামে সামনে পেছনে যেদিকে তাকাবেন শুধুই বটগাছ। গাছটির প্রাকৃতিক কারুকার্যে যে কেউ বিমোহিত হতে বাধ্য। এছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পর্যটকদের ক্লিকে ক্লিকে তৈরি হয় অন্যরকম এক ফটো অ্যালবাম। আমারাও সেই অ্যালবাম তৈরি করতে ভুলে যাইনি।

কথিত আছে, একবার গাছ কাটতে গিয়ে কুদরত উল্লাহ নামের একজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। কুদরত উল্লাহর স্ত্রী গাছ ধরে কান্নাকাটি করে স্বামীর প্রাণ ফেরান। প্রচলিত এই কথার জের ধরে মনের আশা পূরণের জন্যে অনেকে গাছের শাখা জড়িয়ে ধরে কাঁদেন।

তবে অযত্ন আর অবহেলার কারণে কিছু ঝুরি পোকায় নষ্ট করে দিয়েছে। অনেক ডালপালাও ভেঙে পড়েছে। ঝড়ে উপড়ে গেছে অনেক ঝুড়ির শেকড়। এরই মধ্যে বেশ কয়টি ঝুরির গাছ পৃথক হয়ে গেছে। ফলে গাছটি এখন আর এক নেই।

গাজী-কালু-চম্পাবতির মাজার

বটগাছ দেখা শেষ করে আবার যাত্রা শুরু করলাম কালিগঞ্জ উপজেলার বারো বাজারের গাজী-কালু-চম্পাবতির মাজারে। এটি ঝিনাইদহ শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার ও বারোবাজার থেকে মাত্র এক কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত।

সেখানে গিয়ে দেখি আরেক এলাহী কাণ্ড। মাজারের গা ঘেঁষে আছে ৬টি ছোট বড় বটবৃক্ষ। মনের আশা পূরণে সব ধর্মের অনেকেই গাছের সঙ্গে সুতা, পলিথিন, প্লাস্টিক, কাগজসহ বিভিন্ন জিনিস বেঁধে রেখেছে।

ইতিহাসবেত্তাদের ভাষ্য মতে, বারোবাজারে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসা আধ্যাত্মিক সাধকের মধ্যে গাজী, কালু ও চম্পাবতী ছিলেন অন্যতম। বিরাট নগরের শাসক দরবেশ শাহ্ সিকান্দারের পুত্র বরখান গাজী ও কালু ছিলেন সিকান্দারের পালক পুত্র।

গাজীর সঙ্গে ছাপাইনগরের সামন্ত রাজা রামচন্দ্রের মেয়ে চম্পাবতীর প্রেমের সম্পর্কে নানা চড়াই উৎসাই পেরিয়ে বিয়ে হয়। পরবর্তীতে গাজী অনুসারীদের সঙ্গে রাজা রামচন্দ্রের বহু যুদ্ধের পর গাজী চম্পাবতীকে উদ্ধার করে বারোবাজারে ফিরে আসেন ও বারোবাজারে তারা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

শ্রীরাম রাজার বেড় দীঘির দক্ষিণ পাড়ের আট ফুট লম্বা ৩টি মাজারের মধ্যে মাঝেরটি গাজীর, পশ্চিমের কালুর ও পূর্ব দিকের কবরটি চম্পাবতীর। মাজারে হালকা বিরতি নিয়ে চললাম গোড়ার মসজিদের দিকে। এটিও বারোবাজারেই অবস্থিত।

এটি পঞ্চদশ শতাব্দির রাজধানীখ্যাত শাহ মোহাম্মদাবাদে সুলতানী শানামলের স্থাপত্য শিল্পের অনন্য নিদর্শন। পূর্বদিকে রয়েছে পুকুর ও ওযু করার সুব্যবস্থা। একটি বড় ও তিনটি ছোট গম্বুজ ও বারান্দাসহ মসজিদটি বর্গাকৃতির। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৩ সালে খননের পর গম্বুজের কেন্দ্রস্থল ২ ফুটের মতো ভাঙ্গা দেখতে পান।

একই সঙ্গে মসজিদের পাশে একটি কবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এটি গোরাই নামের এক দরবেশের মাজার বলে অনেকের ধারণা। তার নামানুসারে এ মসজিদকে গোড়ার মসজিদ নামকরণ কয়। মসজিদে পাঁচ ফুট প্রশস্ত দেওয়াল, পূর্বদিকে ৩টি প্রবেশদ্বার ও উত্তর ও দক্ষিণের দেয়ালে দু’টি বড় ও দু’টি ছোট মোট ৪টি প্রবেশ পথ এখন জানালা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

পশ্চিমের দেওয়ালে তিনটি মেহরাব আছে। পশ্চিম দেয়ালে ৭/৮ ফুট লম্বা দু’টি ও উত্তর ও দক্ষিণের দেওয়ালে দু’টি মোট ৪টি কালো পাথরের স্তম্ভ আছে।

মসজিদের দেওয়ালে পোড়ামাটির পত্র-পুষ্পে শোভিত শিকল, ঘণ্টাসহ বিভিন্ন নকশা আছে। বাইরের দেওয়াল পুরোটাই পোড়ামাটির কারুকার্যে অলংকৃত। যা দেখে অন্তরতৃষ্ণা আরো বহুগুণে বেড়ে গেছে।

আকাশিরঙা মসজিদ

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। সবাই ক্ষুধার্ত। তবুও যেন ভ্রমণতৃষ্ণা মেটেনি। গেলাম আরেক দৃষ্টিনন্দন মসজিদে। যেটি কালীগঞ্জ উপজেলার বেলাট গ্রামে নির্মিত। তিনতলা বিশিষ্ট মসজিদটি দুই একর জমির ওপর ২০১৯ সালের শেষের দিকে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে উদ্বোধন করা হয়।

প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মসজিদটি নির্মাণ করেছে যশোরের আদ-দ্বীন ফাউন্ডেশন। মসজিদের তৃতীয় তলায় এতিমখানা ও হাফেজিয়া মাদরাসা রয়েছে।

মসজিদের রং করা হয়েছে আকাশের রঙে। সাদা ও হালকা আকাশি রঙের সংমিশ্রণে নির্মিত মসজিদটিতে রয়েছে আধুনিক দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ। মসজিদটির চারপাশের প্রাচীরেও রয়েছে ব্যতিক্রমী নকশা।

মসজিদে ঢুকেই ডানে আছে বিশাল গোরস্থান ও বামে ফুলের বাগান। নারী-পুরুষের জন্য আছে আলাদা আলাদা মসজিদ। সেখানে পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা ওযু ও নামাজের সুব্যবস্থা রয়েছে। বারোবাজারের পুরোনো ঐতিহ্যগুলোর পাশাপাশি এখানেও প্রতিনিয়ত আসছেন পর্যটকরা।

চিনিকল

এদিকে ঢলে পড়েছে সূর্য। সঙ্গে বেজে উঠেছে ফেরার সুর। ফেরার পথে ঢুঁ মারলাম কালিগঞ্জের নলডাঙার মোবারকগঞ্জ চিনিকলে। ফটকে গার্ডদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম আঁখ উৎপাদনের সময় হয়নি তাই কল বন্ধ। হতাশ হয়ে কলের আশপাশের এলাকা ঘুরে রওনা হলাম পরবর্তী গন্তব্য কালিগঞ্জের দিকে।

পুরো সময়টা জুড়ে আমরা সাত ছাড়াও অটোরিকশা চালক ছিলেন। তখন ঘড়িতে বিকেল সাড়ে ৫টা। কালিগঞ্জে ফিরে রওনা হলাম ঝিনাইদহের পথে। সেখানে নেমে খাওয়া সেরে ক্যাম্পাসের বাসে ফিরলাম ক্যাম্পাসে।

সারাদিনের তীব্র ক্ষুধা আর তৃষ্ণা রেস্টুরেন্টে মিটিয়ে নিলেও ভ্রমণতৃষ্ণা মেটেনি। সারাটাদিন যেন একটি ঘোরের মধ্য দিয়ে গেছে। যা স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে থাকবে। আবার কোনো এক ছুটিতে শোনার অপেক্ষায়, ‘বন্ধু চল......’

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্বদ্যিালয়, কুষ্টিয়া

জেএমএস/এএসএম