মতামত

মির্জা ফখরুল কি ভুল করে সত্য কথাটি বলেছেন?

২০২৩ এর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বক্তব্য এবং পাল্টা বক্তব্যের রাজনীতি চলমান রয়েছে সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে গত সাড়ে তের বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অর্জনকে জাতির সামনে উপস্থাপনের মাধ্যমে নির্বাচনী বৈতরণী পার করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

Advertisement

একই সাথে দেশে অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের সফলতা এবং করোনা অতিমারির মতো শতাব্দীর ভয়াবহতম দুর্যোগ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সরকারের সফলতার বিষয়গুলোকে জনসম্মুক্ষে প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে তাদের ওপর আস্থা রাখার আবেদন জানাচ্ছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ।

অন্যদিকে বিএনপিসহ জোটের সঙ্গীরা সব ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচনা করায় ব্যস্ত। সরকারের কোনো ভালো কাজই তাদের নজরে আসে না বিধায় তারা সরকারের সব কাজের সমালোচনা করায় ব্যস্ত রয়েছে। আগামী বছরের নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলনের নামে দেশে এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

তাছাড়া সেপ্টেম্বরের শুরুতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে কেন্দ্র করে বিএনপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের মনগড়া ও মিথ্যা তথ্য জাতির সামনে উপস্থাপন করার মাধ্যমে সরকার এবং আওয়ামী লীগকে খাটো করার চেষ্টা করা হয়েছে।

Advertisement

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা এবং মিথ্যাচারের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে পুরোপুরি ব্যর্থ হিসেবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে বিএনপি যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে সেটি হচ্ছে এই সফরটি ছিল কীভাবে আগামী নির্বাচনে ভারত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে-সেই বিষয়ে আলোচনার সফর। বিএনপি এই ধরনের অপ্রাসঙ্গিক মিথ্যাচার এবং প্রোপাগান্ডা চালালেও বাংলাদেশের জনগণ তা বিশ্বাস করবে না, কারণ বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বাস করে শুধু শেখ হাসিনার হাতেই বাংলাদেশ নিরাপদ।

বিভিন্ন ধরনের সমালোচনার মাঝে গত কয়েকদিন আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার নিজ নির্বাচনী এলাকা ঠাকুরগাঁওয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় কালে হয়তো ভুল করে একটা সত্যি কথা বলে ফেলেছেন।

বিভিন্ন ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করার একপর্যায়ে তিনি বলেছেন ‘এর চেয়ে তো আমরা পাকিস্তান আমলেই ভালো ছিলাম’। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধে নিহত ত্রিশ লাখ শহীদ, সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ মা-বোন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের চরম ভাবে অসম্মানিত করেছেন বলে আমি বিশ্বাস করি।

Advertisement

এই বক্তব্যের মাধ্যমে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় তা হলো মির্জা ফখরুল কিংবা তার দলের পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি এখনো চলমান। বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলামের দলের নেতা।

তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে কখনও বা বিএনপি অথবা কখনো বা জাতীয় পার্টি বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থি শাসন ব্যবস্থা চালু রেখেছিল। পাকিস্তানের সাথে বিএনপি বা তাদের জোটের অন্যান্য দলের একটি যোগসূত্র রয়েছে বিধায় তাদের মূল টার্গেট হচ্ছে অপপ্রচার চালিয়ে কীভাবে আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছে খাটো করা যায় তার চেষ্টা করা। পাকিস্তানপন্থি রাজনৈতিক দর্শনের কারণেই আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী ভারতের সাথে তাদের সম্পর্কের উন্নতি হয়নি। বরং বিএনপি সবসময় রাজনীতি করেছে ভারত বিরোধিতার।

বিএনপির সাথে তাদের জোটের দলগুলো একদিকে যেমন ভারত বিরোধিতার বিষয়টিকে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে চলেছে, ঠিক তেমনিভাবে ধর্মের বিষয়টিকে জনগণের সামনে ভুলভাবে উপস্থাপন করে জনগণের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা করে চলেছে অনাদিকাল থেকে।

আমরা এর আগে বিভিন্ন সময়ে বিএনপি বা তাদের নেতাদের সাথে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের যোগাযোগের খবর পত্রিকান্তরে জানতে পেয়েছি। পাকিস্তান এবং চীনের সম্পর্কের গভীরতার জেরে বিএনপির সাথে পাকিস্তান এবং চীনের সম্পর্ক বরাবরই ঘনিষ্ঠ ছিল। বিএনপি মূলত ভারত বিরোধিতার বিষয়টিকে সামনে এনে পাকিস্তান এবং চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছে কারণ ভারতের সাথে উভয় দেশেরই বৈরিতা রয়েছে অনেক কাল ধরে।

ফলে বিএনপি যখন দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করছে এবং ক্ষমতায় ফেরার আশা ক্ষীণ হয়ে গেছে তখন তাদের পরম বন্ধুদের অবদান স্বীকার করার মধ্য দিয়ে দিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম ভুল করে হলেও সত্য কথা বলেছেন। আর এই সত্য কথা বলার কারণে নিশ্চয়ই তিনি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করে সরকারের সমালোচনা করা এবং নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকে বয়কট করে ক্ষমতার মসনদে বসার ব্যাপারে এই দলটির যে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে সেটি হয়তো কখনোই সফল হবে না।

এ কথাটি ঠিক যে আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের শাসনামলে দেশে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। এই সরকারের আমলে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, অর্থনীতির ভিত্তি শক্ত হয়েছে, করোনা অতিমারির মতো দুর্যোগ সফলতার সাথে মোকাবিলা করতে পেরেছে সরকার এবং করোনা পরবর্তী রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলার ক্ষেত্রেও সরকার সফল হয়েছে। তবে ব্যাপক উন্নয়নের মাঝেও হয়তো কোথাও কোথাও এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। দুর্নীতির কারণে সরকারের অনেক বড় বড় অর্জন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছিলেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তারপরও তার সেই পদক্ষেপগুলো কখনো কখনো থমকে গেছে কোনো অজানা কারণে, যা জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। আমাদের বিশ্বাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে আগামী দিনগুলোতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করবেন এবং দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করবেন।

একই সাথে আগামী নির্বাচনের আগে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এবং একটি গোষ্ঠীর কারসাজিতে অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনগণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমরা জানি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চেষ্টা করে চলেছেন এ বিষয়টি সমাধান করতে।

আমাদের প্রত্যাশা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে অতিসত্বর দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন। অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এলে জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসবে, যা আগামীতে ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।

নির্বাচনে জিততে হলে জনগণের সমর্থন প্রয়োজন হয়, যা অর্জিত হয় রাজনীতিবিদের কাজের মাধ্যমে। বিএনপি বর্তমানে যেভাবে রাজনীতির মাঠে এগিয়ে চলেছে সেটি তাদের জন্য কখনোই সুফল বয়ে আনবে না। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের সংকট এবং কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে মূল বাধা। ফলে বিভিন্ন পত্রিকায় ইঙ্গিত করা হয়েছে যে আগামী দিনে এই দলের একতা অক্ষুণ্ণ রাখা কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

একই সাথে বিএনপি জোটের অন্য দলগুলো আদৌ বিএনপির সাথে কতদিন থাকবে-সেটিও ভেবে দেখার বিষয়? আওয়ামী লীগের উন্নয়নের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে জনগণকে আকৃষ্ট করার মতো কোনো কর্মপরিকল্পনা বিএনপির পক্ষ থেকে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি এখন পর্যন্ত।

ভবিষ্যতেও তারা সেটি করতে পারবে কি না তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। সরকারের সমালোচনা এবং ভারত বিরোধিতার মতো অস্ত্র ব্যবহার করে বর্তমান বাংলাদেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হলে তা হবে বৃথা চেষ্টা।

তাই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে যথার্থই তার হৃদয়ের অন্তঃস্থলের এ সত্য কথাটি অকপটে স্বীকার করেছেন।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।

এইচআর/ফারুক/এমএস