চোখ সব প্রাণীরই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। মানুষের হাত পা কেটে ফেলা হলেও বেঁচে থাকে। চরম কষ্টে জীবন চলে। বোবা কিংবা বধির হলে ইশারায় কাজ চলে। তবে চোখ না থাকলে পুরো জগতই অন্ধকার।
Advertisement
বলা হয়, চোখ দেখে নাকি অনেক কিছুই বোঝা যায়। চোখ যে মনের আয়না। তবে পৃথিবীতে এমন কিছু প্রাণী আছে যা তাদেরকে অন্য প্রাণী দের থেকে আলাদা করেছে। যারা শুধু চোখের কেরামতি দিয়েই জীবন বাঁচিয়ে রাখে।
পেঁচা
নিশাচর পাখি পেচাঁর কথাই ধরা যাক। পেচাঁর মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে চোখ। দৃষ্টিশক্তির কারণে অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখতে পায় ওরা। ফলে ইঁদুর সহজেই শিকার করতে পারে। তবে পেচাঁর চোখ দু’টো তুলনামূলকভাবে বড় হওয়ায় কোটরের ভেতর স্বচ্ছন্দ্যে ঘোরাতে পারে না।
Advertisement
আমরা যেমন আড় চোখে দেখতে পারি, এই কাজটা পেচাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়। কখনো পাশের কোনোকিছু দেখতে চাইলে চোখের সঙ্গে সঙ্গে পুরো মাথাটাকেই ঘোরাতে হয় পেচাঁকে। তবে তাদের ঘাড়ের পেশি খুবই নমনীয় বলে মাথা ঘোরাতে কোনো সমস্যা হয় না। প্রয়োজনে মাথাটা ঘুরিয়ে একদম বিপরীত দিকে নিয়ে আসতে পারে।
মাছির চোখের কেরামতি
মাছি মারা বা ধরা কি যে কষ্ট! শত্রুর কবল থেকে মাছির দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার এই যে অসাধারণ ক্ষমতার কারণ হলো তাদের চোখ। চারপাশের নড়াচড়া দেখার ক্ষেত্রে মাছির জুড়ি মেলা ভার। এ কারণেই চট করে পালিয়ে যেতে পারে মাছি।
বিজ্ঞান বলে, মাছির চোখ আসলে দু’টো নয়। বেশ কয়েকটি। সবগুলোই গুচ্ছাকারে সাজানো। ফলে মাছির লেন্সের সংখ্যাও অনেক। এই লেন্সগুলোর একেকটা একেক দৃশ্য ধারণ করে।
Advertisement
এভাবে লেন্সগুলো টুকরো টুকরো দৃশ্য ধারণ করে মাছির মস্তিষ্কে পাঠায়। তারপর সেই টুকরো দৃশ্যগুলো মস্তিষ্কে গিয়ে জোড়া লেগে চারপাশের সম্পূর্ণ দৃশ্যে পরিণত হয়। আশপাশে যে যেখানেই নড়ুক না কেন তা মুহূর্তেই মাছি টের পেয়ে যায়।
মাছের চোখের কারিশমা
স্ক্যালপ হচ্ছে এক ধরনের শোল মাছ। এদের আছে দুই সারি নীল রঙের চোখ। সব মিলিয়ে শ’খানেকের মতো হবে এই চোখ। এই শত চোখ দিয়ে একসঙ্গে চারপাশের সবকিছুই দেখতে পায় স্ক্যালপ।
ফলে শত্রু দেখলে যথাসময়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে পারে এই মাছেরা। পালানোর সময় পেছনে পিচকারির মত পানি ছুড়ে সামনের দিকে গতি সঞ্চার করে স্ক্যালপ।
অদ্ভুত চোখের চিংড়ি
বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও অদ্ভুত চোখওয়ালা প্রাণী হলো ম্যান্টিস চিংড়ি। প্রাণীটি চিংড়ি প্রজাতির হলেও বাস্তবে এরা চিংড়ি নয়। আকারে ছোট হলেও এই প্রাণী খুব হিংস্র ও ভয়ংকর।
এদের শরীরে উপরের অংশে এক ধরণের পাতলা আবরণ আছে। এদের অত্যন্ত ধারালো ও শক্তিশালী নখর আছে যা দিয়ে একজন মানুষের আঙুলের নখ কেটে ফেলা সম্ভব এমনকি কাঁচের অ্যাকুয়ারিয়ামও ভেঙে ফেলা সম্ভব। এদের চোখে প্রচুর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ওমাটিডিয়াম আছে ও সেগুলোর কাজও ভিন্ন। কিছু রং শনাক্ত করে আবার কিছু আলো শনাক্ত করে।
ভয়ংকর চোখ
স্পোক ফিশ নামে এক প্রজাতির মাছ আছে। এরা গভীর জলের মাছ। এদের অদ্ভুত চোখ জোড়ার জন্য এদের বেশ ভয়ংকর দেখায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় এই বুঝি চোখ জোড়া ঠিকরে বের হয়ে এলো। এদের চোখ জোড়া বেশ স্বচ্ছ ও আকারে তুলনামূলক বড়।
এরাই একমাত্র মেরুদণ্ডী প্রাণী যাদের ‘মিরর’ আকৃতির স্বচ্ছ চোখ আছে। এরা জীবনের বেশিরভাগ সময়ই গভীর পানিতে কাটিয়ে দেয়। পানির প্রায় ১০০০-২০০০ মিটার নিচে বাস করে। এই মাছ খুব বিরল। ছোট ছোট প্ল্যাঙ্কটন ও পোকামাকড় খেয়ে এরা জীবনধারণ করে। লম্বায় প্রায় ১৮ সেন্টিমিটারের মতো হয়।
বড় চোখ
স্কুইড হচ্ছে অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে সর্ববৃহৎ। স্কুইডের চোখ হচ্ছে প্রাণীকুলের মধ্যে সর্ববৃহৎ চোখ। এতটাই প্রকাণ্ড চোখ যে, আমাদেও খাবারের ডিনার প্লেট থেকেও বড় হয়। এদের চোখের লেন্স বড়সর একটা কমলার মতো দেখতে। প্রকাণ্ড একটা কলোসাল স্কুইডের চোখ ৩০ সেন্টিমিটারের মতো।
এত বড় চোখ দিয়ে স্কুইড কম আলোতেও দেখতে পারে। গবেষকদের মতে, এরা সাগর পৃষ্ঠ থেকে ২০০০ মিটার উপরের জিনিসও দেখতে পায়। এই চোখ তাদের হেডলাইট হিসেবে কাজ করে। এদের চোখে ফটোফোর নামে এক ধরনের অঙ্গ আছে যা অন্ধকারে আলো সৃষ্টি করতে পারে। যা দিয়ে অনায়াসে দূরের জিনিস দেখতে পায় তারা।
উটের চোখের জাদু
মরুভূমিতে প্রায়ই মরুঝড় বা ধুলোঝড় হয়। প্রচণ্ড বাতাস তাড়িয়ে নেয় ধূলাবালি। বালি কণার আক্রমণ ঠেকানোর জন্য অতি লম্বা দু’সারি চোখের পাপড়ি আছে উটের। এই বিশেষ গড়নের চোখের পাপড়ি বালি কণার আক্রমণ ঠেকাতে পর্দা হিসেবে চমৎকার কাজ করে।
ফলে প্রচণ্ড বালি ঝড়ের মধ্যেও দিব্যি চোখ খোলা রাখতে পারে উট। শেষমেষ যদি এই ঝড় ঠেকাতে চোখের পাপড়ি কুলিয়ে উঠতে না পারে তখন বাড়তি চোখের পাতার মতো দু’চোখে দু’টো পর্দা নামিয়ে দেয় ওরা। উটের ঘন ভুরুগুলো আবার রোদের তেজ ঠেকাতে বেশ কাজে দেয়।
গিরগিটির চোখের মাস্তানি
গিরগিটির সঙ্গে ড্রাগনের কাল্পনিক ছবির মিল আছে। শিংওয়ালা গিরগিটির চোখ কিন্তু সত্যিই ভয়ংকর। শত্রু দেখলে যেমন শরীরে বাতাস টেনে দেহ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ভয় দেখায়।
তেমনি রূপ বদলে ছদ্মবেশ নিতেও এদের জুড়ি নেই। এরা সবচেয়ে ভয়ের কাজটা সারে চোখ দিয়ে। আর তা হচ্ছে শত্রুর দিকে পিচকারির মত পিচিক করে রক্ত ছুড়ে দেয়। এটি হচ্ছে ওদের তাড়ানোর শেষ অস্ত্র।
এছাড়াও বিড়াল, বাঘ, হরিণ, সিংহসহ বিভিন্ন প্রাণীর চোখ অন্ধকারে জ্বলতে দেখা যায়। কিন্তু কেন জ্বলে? বিজ্ঞানীরা জানান, যেসব প্রাণীর চোখ অন্ধকারে জ্বলে তাদের অক্ষিপটের উপর লুমিনাস ট্যাপেটাম নামে একধরনের স্ফটিক উপাদান থাকে।
এর থেকে আলো প্রতিবিম্বিত হয়ে জ্বলজ্বল করে। রাতের আলো যত কমই হোক না কেন এদের চোখের উপর পড়ে তা চকচক করে। আর অন্ধকারে এরা সব স্পষ্ট দেখতে পায় বলে এদের বলা হয় নিশাচর প্রাণী। তবে সব প্রাণীর চোখ থেকে কিন্তু একই রঙের আলো বিচ্ছুরিত হয় না।
দেখা যায়, যাদের চোখের অক্ষিপটে রক্ত বেশি থাকে তাদের চোখ ইটভাটার আগুনের মতো জ্বলে। আর যাদের কম তাদের চোখ জ্বলে অনেকটা হলদেটে আভায়। পৃথিবীতে এমনই আরও অনেক প্রাণী রয়েছে। যারা শুধু চোখের এমন নানান কেরামতি দিয়েই জীবন বাঁচিয়ে থাকে।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
জেএমএস/এএসএম