জাতীয়

চট্টগ্রামে বসছে গ্যাসের আরও ১ লাখ প্রিপেইড মিটার, মান নিয়ে ‘সংশয়’

# কর্ণফুলী গ্যাসের ২৪১ কোটি টাকার এক লাখ প্রিপেইড মিটার প্রকল্প# ডিসেম্বর বা জানুয়ারি থেকে চট্টগ্রামে স্থাপন হতে পারে নতুন প্রিপেইড মিটার

Advertisement

আবাসিক গ্যাসের আরও এক লাখ প্রিপেইড মিটার সংযোগ পাচ্ছেন চট্টগ্রামের গ্রাহকরা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। প্রিপেইড মিটারের প্রথম প্রকল্পটি ছিল জাপানের জাইকার অর্থায়নে। দ্বিতীয় প্রকল্পটি বিদেশি অর্থের সংস্থান না হওয়ায় দেখেনি আলোর মুখ। গ্রাহকের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এ অবস্থায় নিজস্ব অর্থায়নে তৃতীয় প্রকল্প হাতে নেয় কেজিডিসিএল। ঠিকাদার নিয়োগে আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে। জাইকার প্রকল্প হওয়ায় গ্রাহক সেসময় জাপানি ভালো মানের মিটার পান। কিন্তু এবার ঠিকাদার চাইলে যে কোনো দেশ থেকে মিটার আমদানি করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে মিটার বসানোর আগেই মান নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।

মিটার সংযোজনের আগেই অভিযোগ উঠেছে, প্রিপেইড মিটার সংযোজনের কাজ বাগিয়ে নিয়ে সরকারি প্রকিউরমেন্ট নীতিমালার সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিম্নমানের মিটার সংযোজন করতে একটি চক্র উঠেপড়ে লেগেছে। তবে এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে চাইছেন না।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ২৪১ কোটি টাকার এক লাখ প্রিপেইড মিটার  প্রকল্পের মাধ্যমে শুরু হবে মাঠ পর্যায়ের মূল কাজ, যা শুরু হতে পারে আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে। এরই মধ্যে ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রক্রিয়াও শেষ হওয়ার কথা।

Advertisement

কেজিডিসিএল সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী গ্যাসের প্রায় ছয় লাখ আবাসিক গ্রাহক রয়েছে। নগরীতে আবাসিক গ্যাস ব্যবহারীদের প্রিপেইড মিটার সংযোগের জন্য ২০১৪ সালে পদক্ষেপ নেয় কর্ণফুলী গ্যাস। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর ‘ন্যাচারাল গ্যাস ইফিসিয়েন্সি প্রজেক্ট’ নামে ২২২ কোটি ৪৮ লাখ টাকায় ৬০ হাজার প্রিপেইড মিটার সংযোজন প্রথম প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০১৯ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। ৬০ হাজার প্রিপেইড মিটার স্থাপনের ওই প্রকল্পে  সবমিলিয়ে ব্যয় হয়েছে ১৪৯ কোটি টাকা। যেখানে ব্যয় সাশ্রয় ৭৩ কোটি টাকারও বেশি।

শুরুতে অনাগ্রহ দেখালেও পরবর্তীসময়ে প্রিপেইড মিটার স্থাপন নিয়ে নগরবাসীর চেষ্টা-তদবিরের কমতি ছিল না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কর্ণফুলী গ্যাস কর্তৃপক্ষ পৃথক আরও দুটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর মধ্যে দ্বিতীয় প্রকল্পের আওতায় দুই লাখ প্রিপেইড মিটার সংযোজনের পরিকল্পনা ছিল। এ প্রকল্পের সিংহভাগই ছিল বৈদেশিক অর্থনির্ভর। কিন্তু তহবিল জটিলতায় প্রকল্পটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এরপর নিজস্ব অর্থায়নে তৃতীয় প্রকল্পের আওতায় এক লাখ মিটার প্রিপেইড সংযোজনে তৎপর হয় কর্ণফুলী গ্যাস।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবাসিক গ্রাহকদের ব্যবহৃত গ্যাসের অপচয় রোধের লক্ষ্যে ‘ন্যাচারাল গ্যাস ইফিসিয়েন্সি প্রজেক্ট (ইন্সটলেশন অব প্রি-পেইড গ্যাস মিটার ফর কেজিডিসিএল পার্ট-৩)’ নামে তৃতীয় প্রকল্প হাতে নেয় কেজিডিসিএল। তিন বছর আগে ২০১৯ সালে নেওয়া ২৫৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকায় প্রকল্পটি পরিবর্ধন, পরিমার্জন হয়ে ২০২১ সালের মাঝামাঝি ২৪১ কোটি টাকায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি দেওয়ার পর অনুমোদন দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটি ২০২৪ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে।

প্রকল্পটির প্রাথমিক পর্যায়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, চকবাজার, পাহাড়তলী, খুলশী, বাকলিয়া, সদরঘাট, কোতোয়ালি, হালিশহর, ডবলমুরিং, বন্দর, ইপিজেড, পতেঙ্গা, আকবরশাহ ও জেলার কর্ণফুলী, হাটহাজারী, সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, পটিয়া, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ ও আনোয়ারা উপজেলার গ্রাহকদের জন্য নেওয়া হলেও পরে শুধু মহানগরে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। গত ১৪ আগস্ট মূল প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্র খোলার শিডিউল রয়েছে আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর।

Advertisement

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে গ্রাহকদের আবেদন নেওয়া শুরু করে কেজিডিসিএল। গত সাত মাসে ৭৫ হাজার ৫০০ আবেদন জমা পড়েছে। প্রিপেইড গ্যাস সংযোগের জন্য প্রকল্পের আওতায় এক লাখ আবেদন নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে কর্ণফুলী গ্যাস।

জানা যায়, দেশের অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রথম প্রকল্পের ৬০ হাজার প্রিপেইড মিটার গ্রাহকরা পিওএস (পয়েন্ট অব সেলস) স্টেশন ক্রেডিট কিনে প্রিপেইড মিটার রিচার্জ করে গ্যাস ব্যবহার করেন। এক লাখ প্রিপেইড মিটার প্রকল্পে গ্রাহকদের জন্য ঘরে বসে মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইনের মাধ্যমেও প্রিপেইড বিল পরিশোধের সুযোগ রাখা হচ্ছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পোস্টপেইড গ্রাহকরা প্রতি দুই চুলার মিটারে মাসে গড়ে ৭৭ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেন। কিন্তু প্রথম প্রকল্পে সংযোজিত প্রিপেইড মিটার গ্রাহকরা মাসে গড়ে ৪০-৪৮ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করছেন। এতে মিটারপ্রতি মাসে সাশ্রয় হচ্ছে ২৭-২৮ ঘনমিটার গ্যাস।

৬০ হাজার মিটার প্রিপেইড সংযোগের প্রথম প্রকল্পে অর্থায়ন করেছিল জাইকা। ওই প্রকল্পে জাপান থেকে আনা গুণগত মানসম্পন্ন মিটার সংযোজন করা হয়। এসব মিটার নিয়ে গ্রাহকদের তেমন জটিলতা পোহাতে হচ্ছে না। তবে নতুন প্রকল্পে কোন দেশের মিটার সংযোগ করা হবে, তা এখনো নির্দিষ্ট নয়। এর আগে কখনো গ্রাহক পর্যায়ে বাজার থেকে প্রিপেইড মিটার লাগানো হয়নি। এ প্রকল্পটির মিটারের গুণগত মান নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলছেন গ্রাহক ও কর্ণফুলী গ্যাসের তালিকাভুক্ত অনেক ঠিকাদার।

নগরীর কদমতলী এলাকার আবাসিক গ্রাহক আলাউদ্দিন। তার এক বাসায় প্রিপেইড সংযোগ দেওয়া হলেও অন্যটিতে সংযোগের জন্য আবেদন করা হয়েছে। এই গ্রাহক জাগো নিউজকে বলেন, গত বছর যে মিটারগুলো লাগানো হয়েছিল সেগুলো জাপান থেকে আনা। প্রকল্প থেকেই সরাসরি লাগানো হয়।

কর্ণফুলী গ্যাসের তালিকাভুক্ত ঠিকাদাররা বলছেন, এবার আগের মতো শুধু জাপান থেকে মিটার আসবে এমন নিশ্চয়তা নেই। কাজের মূল ঠিকাদার চাইলে টেন্ডারের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী যে কোনো দেশ থেকে মিটার নিয়ে আসতে পারবেন। সেক্ষেত্রে মিটারের মান ও কর্মক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এসব মিটার দ্রুত নষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা থেকে যাবে।

এ বিষয়ে কর্ণফুলী গ্যাসের তালিকাভুক্ত এক ঠিকাদার জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদার বা তাদের এজেন্টরা কাজ পেলেও মিটার সংযোজনের মূল কাজটি করবেন কর্ণফুলী গ্যাসের তালিকাভুক্ত ঠিকাদাররাই। এটাই নিয়ম। যিনি কাজ পাবেন, তিনি যদি মানসম্পন্ন মিটার আমদানি না করেন তাহলে তো মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। কারণ, প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ঠিকাদার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাবেন। পরবর্তীসময়ে গ্রাহকরা যে কোনো ঝামেলায় প্রথমে আমাদের খুঁজবেন। তখন আমরা গ্রাহকদের কী জবাব দেবো? তাই আমরাও বুঝেশুনে কাজ করতে চাই।

প্রকল্প পরিচালক ও কর্ণফুলী গ্যাসের উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. নাহিদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, এক লাখ প্রিপেইড মিটার প্রকল্পের জন্য এরই মধ্যে ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ডিসেম্বরের মধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হবে। এরপর মিটার সংযোজনের কাজ শুরু হতে পারে ডিসেম্বরের শেষ কিংবা জানুয়ারির শুরুর দিকে।

তবে ঠিকাদার বা মিটারের মান নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেজিডিসিএলের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, প্রথম প্রকল্পটি জাইকা অর্থায়ন করেছিল। যে কারণে প্রকল্পের কাজও তারাই (জাইকা) মনিটরিং করে। পুরো কাজটি মানসম্মতভাবে শেষ হয়েছে। বিশেষত মিটারগুলো ছিল জাপান থেকে আনা। তবে অন্য দেশেও মানসম্মত মিটার তৈরি হয়। কিন্তু ঠিকাদার চাইলে বাইরের অনেক দেশ থেকে কার্যাদেশের স্পেক (মানমাত্রা) রক্ষা করে কম দামের মিটার তৈরি করে নিতে পারেন, যেগুলো জাপানি মিটারে সম্ভব নয়। তারপরও সরকারি ক্রয়নীতি অনুযায়ী প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ করা হবে।

ইকবাল হোসেন/এমকেআর/এএসএ/জিকেএস