অবিভক্ত ভারতের এ অঞ্চলে চা-শিল্পের যাত্রা শুরু ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে। ১৮২৮ সালে চট্টগ্রামের কোদালায় চা বাগান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে যে স্থানটিতে চট্টগ্রাম ক্লাব ঠিক সেখানেই প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চা গাছের চারা রোপণ করা হয় ১৮৪০ সালে। তবে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা-শিল্পের যাত্রা শুরু সিলেটে। ১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে প্রতিষ্ঠিত হয় মালনিছড়া চা বাগান। সেখান থেকে দেশীয় চা শিল্পের গোড়াপত্তন। এর ১৭০ বছর পরের ইতিহাস একেবারেই ভিন্ন। বর্তমানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয়, গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণসহ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে চা-শিল্প। এ শিল্পের বহুমুখী বিকাশও ঘটছে উত্তরোত্তর।
Advertisement
১৯৫৭ সালের কথা। সে বছরের ৪ জুন প্রথম বাঙালি হিসেবে দেশের চা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। বোর্ড চেয়ারম্যান থাকাকালীন চায়ের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজারে শ্রীমঙ্গল নন্দরানী চা বাগান পরিদর্শনে আসেন বঙ্গবন্ধু। মিটিং করেন বাগান কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সেই মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু যে চেয়ারে বসেছিলেন যে টেবিলটি তার সামনে রাখা ছিল, সেগুলো এখন দেশীয় চা শিল্পের ইতিহাসের অংশ হয়ে স্থান নিয়েছে শ্রীমঙ্গলের ‘টি রিসোর্ট অ্যান্ড মিউজিয়ামে’।
শ্রীমঙ্গল থেকে লাউয়াছড়ার পথে দুই কিলোমিটার এগোতেই চোখে পড়ে চা জাদুঘরটি। রাস্তার পাশে চায়ের বাগান ঘেঁষে গড়ে ওঠা এ জাদুঘরের উদ্বোধন হয় ২০০৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। জাদুঘরটিতে দেশের চা শিল্পের প্রায় দেড়শো বছরের ইতিহাস ফুটে উঠেছে নানা সংগ্রহ আর স্মারকে। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত সেই চেয়ার-টেবিল এ জাদুঘরে স্থান পায় ২০০৯ সালের ১৬ আগস্ট।
পাহাড়ের বুকে শীতল পাটির মতো ছেয়ে থাকা চায়ের গাছ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র চা জাদুঘর। চা শিল্পের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে স্থাপিত চা জাদুঘরে ব্রিটিশ আমলে চা বাগানে উৎপাদন ও সংগ্রহে ব্যবহৃত প্রায় শতাধিক যন্ত্র ও বিভিন্ন সামগ্রী সংরক্ষিত রয়েছে। ব্রিটিশ আমল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের চা শিল্পে ব্যবহৃত এসব সামগ্রী ছোট তিনটি কক্ষে সংরক্ষিত।
Advertisement
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, তিনটি কক্ষের প্রথমটিতেই রয়েছে চা বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যবহার করা সেই চেয়ার-টেবিল। শূন্য চেয়ার-টেবিলের পেছনে টাঙানো সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা জাতির পিতার আপাদমস্তক প্রতিকৃতি। কক্ষটিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর চা পান করার ছবিসহ আরও বেশ কিছু স্থিরচিত্র। পাশের কক্ষেই চা-গাছ ব্যবহার করে তৈরি করা আসবাবপত্রের ওপর প্রদর্শন করা হয়েছে চা বাগানে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামাদি।
চা জাদুঘরের এ কক্ষটিতে আরও রয়েছে লালচান্দ চা বাগান থেকে সংগৃহীত পুরোনো আমলের চা শুকানো যন্ত্রের অংশবিশেষ। কোদালা, বারমাসিয়া ও কর্ণফুলী চা বাগান থেকে সংগৃহীত চা-বাগানের আগাছা পরিষ্কার করার কাঁটা কোদাল ও রিং কোদালও এ কক্ষেই সংরক্ষিত। ব্রিটিশ আমলে চায়ের চারা রোপণের গর্ত ও চা-গাছ উপড়ানোর জন্য ব্যবহৃত প্লান্টিং হো, কোদালা চা বাগানের শ্রমিক সুদর্শনের সংগৃহীত চা গাছ ছাঁটাইয়ের কাজে ব্যবহৃত কমল দা, ব্রিটিশ আমলে চা গাছ ছাঁটাইয়ের কাজে ব্যবহৃত প্রুনিং দা, মাটি কোপানো ও চা গাছের শিকড় কাটার জন্য ব্যবহৃত রিং কোদাল, ১৯৬০ সালে শ্রমিকদের নাম-পদবি ও মজুরি হারসহ বিভিন্ন তথ্যসমৃদ্ধ শাহবাজপুর চা বাগানের ব্যবহত সার্ভিস বুক এ কক্ষটিতে সংগ্রহে রাখা হয়েছে।
এছাড়াও রয়েছে লোহার পাপস, চা-শ্রমিকদের জন্য ব্যবহৃত বিশেষ রূপা ও তামার মুদ্রা। ব্রিটিশদের গুনতির কাজে ব্যবহৃত হাড়ের ছড়ি, লাঠি, শ্রমিকদের পূজা-অর্চনায় ব্যবহৃত কষ্টিপাথরের প্লেট, ব্যবস্থাপক বাংলোয় ব্যবহৃত প্রাচীন বেতারযন্ত্র, কলের গান রেকর্ডসহ চা পাতা সংগ্রহে চয়ন যন্ত্র ও বাগানের নারী শ্রমিকদের ব্যবহৃত রুপার গহনা সংগৃহীত হয়েছে কক্ষটিতে।
তৃতীয় কক্ষে রয়েছে চা শিল্পে ব্যবহৃত ব্রিটিশ আমলের টারবাইন পাম্প, লিফট পাম্প, হস্তচালিত নলকূপ, বাগানের সীমানা ও জমি পরিমাপের জরিপ শিকল, সিরামিকের পানির ফিল্টার, সিরামিক জার, ঊনিশ শতকের প্রাচীন বৈদ্যুতিক পাখা, পুরোনো রেডিও টেলিফোন সেট, প্রুনিং দা, টাইপ রাইটার, প্রাচীন পিএইচ মিটার ও চা প্রক্রিয়াকরণ সামগ্রী। আছে তীর-ধনুক, দেয়ালঘড়িসহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাউয়াছড়া বনে বিধ্বস্ত হওয়া একটি যুদ্ধবিমানের অংশবিশেষও। দীর্ঘদিন মাটির নিচে থেকে কাঠ পাথরে রূপান্তরিত চার খণ্ড জীবাশ্ম ঠাঁই করে নিয়েছে কাচের ফ্রেমে। রয়েছে নেপচুন চা বাগান থেকে সংগৃহীত কেরোসিনের কুপি দিয়ে চালিত মাঝারি ফ্রিজ, মাথিউড়া চা বাগান থেকে পাওয়া হাতে ঘোরানো টেলিফোন সেট এবং বাগানের হিসাবরক্ষকদের ব্যবহৃত ক্যাশ বাক্স।
Advertisement
‘টি রিসোর্ট অ্যান্ড মিউজিয়াম’ এর অফিস সহকারী কানাই গোয়ালা জাগো নিউজকে জানান, সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাদুঘরটি। ২০ টাকা মূল্যের টিকিট কেটে জাদুঘরে প্রবেশ করতে পারেন দর্শনার্থীরা। তবে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক সময় টিকিটের দাম সীমিত করা হয়।
দেশের দেড়শো বছরের চা শিল্পের ইতিহাস জানতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়গুলোতে বা নভেম্বর-ডিসেম্বরে দর্শনার্থীদের কিছুটা চাপ থাকলেও সাধারণ দিনে দর্শনার্থীর সমাগম তেমন লক্ষ্য করা যায় না। প্রতিদিন হাতেগোনা দর্শনার্থী আসেন জাদুঘরে। তবে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারিসহ বিশেষ দিনগুলোতে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে জাদুঘরটি। জাদুঘর এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি রিসোর্ট। যেখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় দর্শনার্থীরা চাইলেই থাকতে পারেন।
দেশের প্রথম চা জাদুঘরের বিষয়ে জানতে চাইলে ‘টি রিসোর্ট অ্যান্ড মিউজিয়াম’ এর ব্যবস্থাপক মো. শামসুদ্দোহা জাগো নিউজকে বলেন, চা জাদুঘরটিতে দেশের প্রথম চা বোর্ডের চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যবহৃত চেয়ার-টেবিল সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন চা বাগান থেকে আমরা ব্রিটিশ আমল থেকে চা বাগানে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও স্মারক সংগ্রহ করেছি। নারী শ্রমিকদের ব্যবহৃত গহনা থেকে শুরু করে চা উৎপাদন ও সংগ্রহকাজে ব্যবহত সামগ্রী প্রদর্শন করা হয়েছে।
এরই মধ্যে এ জাদুঘরে চায়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জাদুঘরটি যুগোপযোগী করা ও সম্প্রসারণের প্রক্রিয়াও চলমান।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, জাদুঘরটি খুবই ছোট পরিসরে রয়েছে। আমরা এটি বড় করার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছিলাম। কিন্তু করোনার কারণে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। জাদুঘরের সম্প্রসারণের জন্য বর্তমান ভবনটির পাশেই আরও একটি দোতলা ভবন নির্মাণ করা হবে।
আরএসএম/এমকেআর/এএসএ/এমএস