মতামত

সমাজকেও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন সানজিদা-সাবিনারা

‘দ্য গার্ডিযান’-র সাম্প্রতিক এক প্রবন্ধে ফেসবুককে বলা হয়েছে আধুনিক পৃথিবীর সিগারেটের নেশা! কিন্তু সোমবার সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি এদেশের মানুষকে ফেসবুক অন্য নেশায় বুঁদ করে রাখলো! সানজিদা খাতুন। বাংলাদেশের এক নারী ফুটবলার। তিনি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের আগে এমন একটা স্ট্যাটাস দিলেন; যা আবেগের আগ্নেয়গিরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো। সেখানে স্বপ্ন ছিল। আশা ছিল। প্রতিশ্রুতি ছিল। একই সঙ্গে ছিল অভিমান। ছিল বিদ্রোহী সাহস!

Advertisement

সাফ ফাইনালের আগে সানজিদা খাতুনের স্ট্যাটাসটা বার বার পড়েছি। মুগ্ধ হয়েছি। এভাবেও তাহলে লড়াইয়ের কথা বলা যায়! যে লড়াই ফুটবল মাঠে সীমাবদ্ধ রাখেননি তারা। যে লড়াই সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সানজিদা যা লিখেছেন, সেখানে নারী-পুরুষের বৈষম্যের কথা আছে। জীবন-জীবিকার জন্য লড়াইয়ের কথা আছে। আছে লড়াই করে স্বপ্ন ছোঁয়ার কথা!

ওটা পড়ার পর মনে হয়েছিল, সাফের ট্রফি না জিতলে কী ক্লিশে-পানসে মনে হবে সানজিদার কথাগুলো। নিস্ফলা হয়ে যাবে সাবিনা-আঁখি-কৃষ্ঞাদের লড়াই? মোটেও না। ট্রফি জয়ের আগেই তারা এদেশের মানুষের হৃদয় জিতে নিয়েছিলেন। আর তার স্ট্যাটসটা গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনকে যেন উপহাস করে বলছিল; ফেসবুক সিগারেটের নেশা নয়। ওটা ফুটবলের নেশাও হতে পারে। তা না হলে এদেশে যারা সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন, তাদের চোখ কেন আটকে গেলো ঐ স্ট্যাটাসে! শুধু আটকে যায়নি। অনেকের চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। ভেতরে উদগ্র এক বাসনা জেগেছে চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের। গোটা দেশের মানুষ তাদের জন্য শুভ কামনা জানিয়েছেন।

এভারেস্টের কোলে নেপালের মাটিতে দাঁড়িয়ে নেপালী কন্যাদের বিপক্ষে যে লড়াই করে সানজিদারা জিতলেন, এক কথায় তাকে বলতে হবে- অসাধারণ। আর এই অসাধারণত্বের পেছনে কত সাধারণ মানুষের ঘাম-শ্রম-রক্ত- ক্ষুধা-যন্ত্রণার মর্মর্স্পশী গল্প। আমরা ক’জন জানতাম। বা জানার চেষ্টা করেছি!

Advertisement

গত এক যুগের বেশি ধরে যে লোকটা এই মেয়েগুলোকে ফুটবলার হিসেবে গড়ে তুলেছেন, সেই গোলাম রব্বানী ছোটনকে কত টিপ্পনী সহ্য করতে হয়েছে! কিন্তু তিনি অবিচল ছিলেন লক্ষ্যে। অঞ্জল থেকে নিজের কাজটা করে গেছেন। সাফল্যের এই মহাকাব্যে হয়তো তিনি থেকে যাবেন উপেক্ষিত! আমাদের সমাজ আর এই সমাজের আবেগ প্রবণ মানুষগুলো সাফল্য নিয়ে হৈ চৈ,লাফালাফিটা বড় বেশি করে। কিন্তু সাফল্যের রুপকারকে চিনে নিতে চায় না। তার শ্রম-ঘাম-আর মেধার দাম দিতে কার্পণ্য করে!

আমাদের ফুটবল যখন প্রতিদিন রং হারাচ্ছে, সেই সময় নারী ফুটবল দল দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করলো। নতুন রঙের ছোঁয়া দিলো দেশেজ ফুটবলের গায়ে। কিন্তু সাফল্যের এই রং আবার বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাবে না তো! যে সানজিদার ফেসবুক স্ট্যাটাস ফাইনালের আগে গোটা দেশের মনকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, তার দলের ক’জন ফুটবলারকে আমরা চিনি। চেনার চেষ্টা করেছি! আমরা ক্রিকেটমত্ত আমজনতা মেতে আছি ক্রিকেট নিয়ে। সেখানে এই সব নারী ফুটবলারদের খবর রাখার সময় কোথায়! তা ছাড়া আমাদের মনোজগতে একটা কথা গেঁথে আছে।’ পুরুষের খেলা- ‘ফুটবল’!

সেই দেশে যে মেয়েগুলো ফুটবলার হতে চাওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছেন, তাদের লড়াইয়ের গল্পটা আমাদের জানা দরকার। সানজিদার স্ট্যাটাসে সেই গল্প লেখা আছে। আজ যারা সাফ জয়ী দলের সদস্য, তাদের সঙ্গে আরও অনেকেই ছিলেন। তীব্র অভাব যাদের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটাকে কেড়ে নিয়েছে। সামাজিক কুসংস্কার যাদের অনেকের পায়ের বুট আর জার্সিকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে বাধ্য করেছে। আমাদের অনেক কিছু বদলেছে। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটাতে পারিনি আমরা। তাই নারীদের স্বপ্ন সত্যি হওয়া কঠিন। আর এই সব নারী ফুটবলারদের স্বপ্ন সত্যি হওয়া ছিল আরও কঠিন। প্রথমত তারা নারী। দ্বিতীয়ত গরীব। দরিদ্র এই সমাজে খেলাধুলা মানায় না! আর নারী? নারীকে হতে হবে সুন্দরী, ঘরোয়া কর্মরতা! মাঠে-ময়দানে তারা প্রবেশ করবেন কেন?

এই বাস্তবতার মধ্য দিয়েই সাবিনা খাতুনরা এভারেস্টের কোলে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে এলেন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা নারী ফুটবল দলের শিরোপা জিতে! এদেশে নারীর অধিকার আর নারী বিদ্বেষ একই রকম প্রবল! নারীর অধিকারের কথা বলতে গিয়ে অনেকে যে সব স্ট্যাটাস দেন সেটাও মাঝেমধ্যে মনে হয় বায়বীয়! আর নারী বিদ্বেষীদের কথাগুলো মূর্খতা ছাড়া অন্য কিছু কী!

Advertisement

ফেসবুক আধুনিক পৃথিবীর সিগারেটের নেশা নাকি স্বপ্ন পূরণের পর পৃথিবীকে জানান দেয়ার বড় মঞ্চ তা নিয়ে বির্তক হতে পারে। কিন্তু সানজিদার মত কিছু মানুষের স্ট্যাটাসে নিজের অধিকারের কথা বলতে খুব বেশি শব্দ খরচের দরকার পড়েনি। সেখানে সাফল্যের প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি এই সমাজকে চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দেয়া যায়, সেটাও আছে।

সাবিনা-সানজিদা –রা সাফল্য এনে দিলেন। নারী ফুটবল নিয়ে উন্মদনা তুঙ্গে পৌঁছে দিলেন। ওরা বুঝিয়ে দিলেন; ওরা ভালো খেলেন। কিন্তু আমরা কী বুঝলাম ওদের আরও ভাল খেলার সামর্থ্য আছে! পরিকাঠামো-পরিচর্যা- পরিশ্রম- আর প্রশিক্ষণ পেলে সাফল্যের এই পতাকাকে ওরা আরও উঁচুতে তুলে ধরার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু দারিদ্র্য, পুরুষতন্ত্র, সমাজ, অপুষ্টি, পিরিয়ড সমস্যা, নব্বই মিনিটি দৌড়ানোর মত ফুসফুসের জোর, আধুনিক টেকনিক, প্রচুর প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ এসব সমস্যার সমাধান কী ওরা পাবেন? নাকি আপাতত সহর্মমিতা আর সাহায্যের ভরসা দিয়ে রাজকীয় চা-চক্রে সারিবদ্ধ গ্রুপ ছবির ফ্রেমে আটকে রাখবো ওদের সাফল্য!

লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম