মিয়ানমার কি নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার ঝাঁজে বাংলাদেশকেও উত্তপ্ত করতে চাইছে? এমনিতেই মিয়ানমারের কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ এখন হিমশিম খাচ্ছে, তারপরও সীমান্ত গোলাবর্ষণ করে বাংলাদেশি নাগরিকদের জীবন অনিরাপদ করে তোলা, কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
Advertisement
মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা দেশের ভেতরে নানা সংকটের মধ্যে আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা সমীকরণে ওই জুলুমবাজ সরকারও কোনো না কোনো বিশ্ব শক্তির সমর্থন পেয়ে একেবারেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কোনো প্রতিবাদ ও নিন্দাই তারা গায়ে মাখে না। দেশ শাসনে সামরিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার মরিয়া চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে মিয়ানমারে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের এক কুদৃষ্টাত্ব হয়ে আছে দেশটি।
সরকারি সেনা ও জান্তা এবং বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে কিছুদিন ধরেই তুমুল লড়াই চলছে মিয়ানমারের ভেতরে। দুই বাহিনীরই এখন দিশেহারা অবস্থা। তাদের নিক্ষিপ্ত গোলা এসে বারবার পড়ছে বাংলাদেশের ভেতরে। গত এক মাসে কমপক্ষে চারবার বাংলাদেশের সীমানায় এসে পড়েছে ওপার থেকে নিক্ষিপ্ত গোলা। তবে শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাতে মাইন বিস্ফোরণ ও মর্টার শেলের আঘাতে একজন নিহত আর সাতজন মানুষ আহত হওয়া ছিল গত পাঁচ বছরের মধ্যে ভয়াবহ এক ঘটনা। আর সে কারণে তুমব্রু শূন্যরেখার আশ্রিত সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গার অনেকে ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে ছোট ছোট দলে। আরও অনেকে তৈরি হচ্ছে পালাতে।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে গত রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) ১২টি মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছেন মিয়ানমারের সেনারা। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৮টার মধ্যে এ মর্টার শেলগুলো এসে পড়ে। বিকট আওয়াজে বারবার কেঁপে ওঠে সীমান্তে শূন্যরেখার রোহিঙ্গা শিবির এবং ঘুমধুম এলাকায় বাংলাদেশের গ্রামগুলো।
Advertisement
এ ছাড়া সারা দিন সীমান্তের ওপারের মিয়ানমারের ভেতর থেকেও এসেছে গোলাগুলির শব্দ। সে দেশের একটি যুদ্ধবিমান তুমব্রু শূন্যরেখা ঘেঁষে মিয়ানমার আকাশে উড়তে দেখে গ্রামটির বাসিন্দারা। সীমান্তে এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং চয়ে মোয়েকে গত রোববার দুপুরে ডেকে কড়াভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, ‘নিজেদের সীমানার ভেতরে যা করো, সেটা তোমাদের নিজেদের ব্যাপার। এপারে গোলাগুলি যাতে আর না আসে, জানমালের যাতে ক্ষতি না হয়, সেদিকে একটু নজর রেখো।’ এই নিয়ে গত এক মাসে চতুর্থবারের মতো তলবে হাজির হতে হলো মিয়ানমার দূতকে। তবে সীমান্তের ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারের বিরক্তির প্রকাশ ঘটাতে এবার তাঁকে চা-কফি বা কোনো কিছুতেই আপ্যায়ন করা হয়নি।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের জল ও স্থলসীমান্ত ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে নাইক্ষ্যংছড়িতে স্থলসীমানা আছে ৯১ কিলোমিটার। নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু বাজারের ব্যবসায়ী বদি আলম, গ্রাম পুলিশ আবদুল জাব্বার, রোহিঙ্গা আবদুচ্ছালাম এবং দক্ষিণ চাকঢালার ফরিদ আলম ও জাফর আলী সাংবাদিকদের বলেছেন, সীমান্তে ভয়ানক এই উত্তেজনায় তটস্থ তুমব্রু, কোনারপাড়া, বাইশফাঁড়ি, তুমব্রু হেডম্যানপাড়া, ভাজাবুনিয়া, মধ্যমপাড়া, উত্তরপাড়া, বাজারপাড়া এবং গর্জনবুনিয়া সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ চাকঢালা, সাপমারা ঝিরি ও জামছড়ি গ্রামের মানুষজন।
এদিকে নাইক্ষ্যংছড়িতে গত রোববার ‘সীমান্ত পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধিদের করণীয়’ শীর্ষক এক জরুরি সভা ডাকেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস। ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, সীমান্তে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সেখান থেকে তিন শ পরিবারের প্রায় দেড় হাজার লোককে প্রয়োজন হলে সরিয়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে প্রশাসন।তবে বৈঠকে জানানো হয় ঘুমধুম ইউনিয়নে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় পরিবারগুলোকে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি কঠিন হয়ে যাবে। এ ছাড়া স্কুলগুলোতেও থাকার কোনো পরিবেশ নেই। এ পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়। বৈঠকে জনপ্রতিনিধিরা জানান, গোলাগুলির বিকট আওয়াজে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা ভয়ে পড়ালেখা পর্যন্ত করতে পারছে না।
তাঁরা আরও জানান, সীমানা ঘেঁষে এ গোলাগুলিতে সীমান্ত সড়কের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে ১৫-২০ দিন। একই সঙ্গে সীমান্তে বিভিন্ন বাগান ও খেত-খামারের কাজও বন্ধ। ফলে শত শত মানুষ মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বৈঠকে জানান, সরকারের উপরমহল বিষয়গুলো জানেন। সীমান্ত শান্ত রাখতে কাজ চলছে।
Advertisement
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব খুরশেদ আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সরকার বিষয়টি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে একটি বৈঠক করেছে গতকাল সকালে দেশের সব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিয়ে। বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে বলা হয়েছে সীমান্তে সজাগ থাকতে। সাগর দিয়ে রোহিঙ্গারা যেন ঢুকতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে তাদের বলা হয়েছে।
কূটনৈতিক চ্যানেল এবং সীমান্তে বিজিবির মাধ্যমে বারবার প্রতিবাদ সত্ত্বেও মিয়ানমারের আচরণে কোনো পরিবর্তন নেই, এমন বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের করার কিছু নেই। একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিবেশিকে যতটুকু করা সম্ভব, ততটুকু আমরা করছি। আমাদের বক্তব্যে কোনো ধরনের দুর্বলতা নেই।’ ভবিষ্যতে মিয়ানমারকে কীভাবে এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা যায়, সেই চেষ্টা সরকার চালিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাকায় আসিয়ান রাষ্ট্রদূতদের পরিস্থিতি নিয়ে জানানো হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান আবারও বলেন, মিয়ানমার থেকে একজন রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশে আর ঢুকতে দেওয়া হবে। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ বিষয়ে লন্ডনে কথা বলেছেন। মিয়ানমারের সংঘাতের প্রভাব নিজ অঞ্চলে পড়ার পরও বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সংযম দেখাচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লন্ডনে ব্রিটিশ লেবার পার্টির প্রধান এবং বিরোধীদলীয় নেতা স্যার কেয়ার স্টারমারের সঙ্গে বৈঠকে তিনি একথা বলেন। প্রয়াত ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চার দিনের সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন।
দুই নেতার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী লেবার পার্টির নেতাকে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি কীভাবে বাংলাদেশের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে জানান। এ সময় তারা বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সশস্ত্র সংঘাতের বিষয়েও আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সংঘাতের প্রভাব বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়ার পরও সর্বোচ্চ সংযম দেখিয়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
ওদিকে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সে দেশের জনগণকে নির্বিচারে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে বলে অভিযোগ করেছে জাতিসংঘ। গত শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আরো বিচ্ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক যেন বিদেশি মুদ্রা আয় করতে না পারে সেজন্য লক্ষ্য স্থির করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে ও তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করতে সদস্য দেশগুলোর প্রতি সুপারিশ জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক অভ্যুত্থানে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর থেকে মিয়ানমারজুড়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সামরিক বাহিনী গণতন্ত্রপন্থি প্রতিরোধ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে লড়াই করছে আর সামরিক শাসনবিরোধী হাজার হাজার লোককে গ্রেপ্তার করে চলছে। একই সময় অভ্যন্তরীণ অশান্তি ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় চাপের মুখে পড়া অর্থনীতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিবেদনে তারা বলেছে, মিয়ানমারের জনগণকে সমর্থন জানাতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং দেশটির সামরিক বাহিনীকে আর্থিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা।
জনগণকে নিপীড়ন ও ভয় দেখিয়ে শাসন করা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছে রাজস্ব ও অস্ত্র পৌঁছানো থামাতে বিশ্বের দেশগুলোর আরো বেশি কিছু করা উচিত বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও প্রতিবেশিদের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য অব্যাহত আছে এবং বেশ কয়েকটি দেশ জান্তাকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। চীন শত্রুতা শেষ করার আহ্বান জানালেও রাশিয়া দেশটির জেনারেলদের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক মিত্র হয়ে আছে এবং অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের জান্তা প্রধানকে তিনটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বরণ করেছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারকে যুদ্ধবিমান ও সাঁজোয়া যান দিয়েছে রাশিয়া, চীন যুদ্ধ ও পরিবহন বিমান সরবরাহ করেছে, সার্বিয়া রকেট ও গুলি দিয়েছে এবং ভারত একটি দূরবর্তী বিমান প্রতিরক্ষা স্টেশন তৈরিতে সহায়তা করেছে।
মিয়ানমারকে শান্তির প্রতি নত হতে বাধ্য করা তখনই সম্ভব হবে, যখন কোনো দেশ কোনো অজুহাতেই মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরাচারী শাসকদের সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ করবে। কিন্তু সেটা কি সম্ভব?
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম