সাম্প্রতিক সময়ে দাবি আদায়ে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। আন্দোলনের দাবি রাজনৈতিক হলেও গণজাগরণ মঞ্চের রূপায়ন ছিল অনেকটাই অরাজনৈতিক। তবে সে দৃশ্যপটে এখন বিস্তর পরিবর্তন এসেছে। নানা অর্জন থাকলেও তিন বছরের গণজাগরণ মঞ্চে এখন বিভাজনই মুখ্য। রাজনৈতিক দলগুলোর কোন্দল, সরকারের ইন্ধন আর উদ্যোক্তাদের মধ্যকার অনৈক্যের কারণে গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিনিয়ত দুর্বল হয়ে পড়ছে।প্রচার রয়েছে, যাদের হাতে গড়া মঞ্চ, দ্বন্দ্বের কারণে তাদের অনেকে সেখান থেকে নেমে এসেছেন। অনেকেই জীবন বাঁচাতে দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছেন। আবার সরকার পক্ষের সঙ্গে আঁতাত করে কর্মসূচিও চালিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের যাত্রা। উপলক্ষ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার পরিবর্তে ফাঁসির দাবি। আন্দোলনের মুখেই আইন পরিবর্তন করে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাঁসি কার্যকর হয়েছে আরও তিন যুদ্ধাপরাধীর।২০১০ সালে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলেও শুরুর দিকে বিচারে তেমন গতি ছিল না। কাদের মোল্লার রায়ের পর গণজাগরণ মঞ্চের গড়ে ওঠা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বিচারে গতি পায়। এ পর্যন্ত ২২টি মামলার রায়ে সাজা দেয়া হয়েছে ২৬ জন যুদ্ধাপরাধীকে; যাদের বেশিরভাগেরই হয়েছে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে, রায় হচ্ছে, হচ্ছে কার্যকরও। কিন্তু আন্দোলনের মঞ্চ থেকে ছিটকে পড়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। আন্দোলনে সফল হলেও তিন বছরের গণজাগরণ মঞ্চ এখন বিভক্তিতে জরাজীর্ণ। স্পষ্টত তিনটি ভাগে বিভক্ত হওয়ায় মঞ্চের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। যা হয়, তাও অনেকটাই দ্বন্দ্ব-উপহাসের জন্ম দিয়ে।আন্দোলনের সেই সময় ও বর্তমানের চিত্রযুদ্ধাপরাধের রায়ের প্রসঙ্গ এলেই ইমরান এইচ সরকার, কামাল পাশা এবং বাপ্পাদিত্য বসুর নেতৃত্বে শাহবাগে পৃথক পৃথক কর্মসূচি পালন করা হয়। জনবল না থাকলেও একই জায়গায় তিনটি মঞ্চ, তিনটি সমাবেশে তিনটি মাইক আর পৃথক পৃথক মিছিলের দরুণ গণজাগরণ মঞ্চ এখন যেন বিভ্রান্তির মঞ্চ। শুরু থেকেই বিভাজন দেখা দিলেও, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ। মঞ্চের পক্ষ থেকে ২৪ তারিখে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের পর জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে সরকারকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ২৬ তারিখের মধ্যে জামায়াত নিষিদ্ধের ঘোষণা না এলে ২৭ তারিখ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও হবে। দাবি ছিল মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২১টি সংগঠনের।কিন্তু সবার সঙ্গে আলোচনা না করেই ২৬ তারিখের সমাবেশে মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার ঘোষণা দেন, ৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী বরবার স্মারকলিপি প্রদানের। আর এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন মঞ্চের অন্যান্য নেতারা। নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকেন অনেকেই। তাদের অভিযোগ ছিল সরকারের সঙ্গে সমাঝোতা করেই ইমরান ওই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।এরপর মঞ্চ আর ঐক্যের সূতায় বাঁধেনি। বেড়েছে দূরত্ব। কুৎসা রটিয়েছেন একে অপরের বিরুদ্ধে। এক গ্রুপের উপর আরেক গ্রুপের হামলা, হাতাহাতি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় মঞ্চের অর্জন অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়। বলা হয়, নিজেদের দুর্বলতার কারণেই ব্লগারদের একের পর এক খুন হতে হয়েছে। মঞ্চের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে এখনো।অভিযোগ ওঠে কেউ সরকারের দালাল, কেউ বামদের দালাল। এমন দলাদলিতে মূল উদ্যোক্তাদের অনেকেই মঞ্চ বিলুপ্ত করারও দাবি জানান।২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ ও বর্তমানের চিত্র আন্দোলনের শুরুর দিন থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ব্লগার ও সাংবাদিক আনিস রায়হান। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, মঞ্চের বিভক্তি আর মঞ্চ ত্যাগ, এরকম দুটো বিষয় আছে এখানে। যারা মঞ্চকে বিভক্ত করেছেন, তারা আদর্শের চেয়ে স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন বেশি। যারা আদর্শকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন এবং দেখলেন যে, মঞ্চ কাঙ্ক্ষিত কর্মসূচি দিতে পারছে না, তখন তারা মঞ্চ ত্যাগ করলেন। তিনি আরও বলেন, মঞ্চের কর্মীরা দেখেছেন, সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচিই নিতে দেওয়া হচ্ছে না, যে সরকার কি না ইসলামী ব্যাংকের টাকা ছাড়া চলতে পারে না। তাহলে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি, জামায়াতি প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধের দাবির মূল্য কী থাকলো? এ অবস্থাকে কেন্দ্র করে নেতারা অনেকবার বসেছেন। কিন্তু আমাদের মিটিংয়ে যে সিদ্ধান্ত সবাই মিলে নেওয়া হতো, মঞ্চে উঠে ইমরান ঘোষণা দিতেন তার ইচ্ছামাফিক কিংবা কারও নির্দেশনামাফিক। ফলে অনেকেই আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেন। আর মঞ্চ বিভক্ত হয়েছে তখনই, যখন সরকারপক্ষের কাছে এর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। আনিস বলেন, আমরা তখন দেখলাম যে পুলিশ শাহবাগ পাহারা দিতো। এরপর তারা মঞ্চ ভেঙে দিল রাতের অন্ধকারে। এমনকি ইমরানরা মারও খেলেন। আমার মতে, মঞ্চ তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে ফেলেছে। এখন এটাকে বয়ে বেড়ানোর প্রয়োজন নেই। সময় হলে জনতা আবার নতুন মঞ্চ গড়ে নিতে পারবেন। এখন মঞ্চ কোনো আন্দোলন করতে পারছে না। পারছে কেবল নানা বিতর্কের জন্ম দিতে।গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম নেতা সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি বাকি বিল্লাহ। এ বিষয়ে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, গণজাগরণ মঞ্চের বিভাজন সত্যিই দুঃখজনক। আমরা প্রথম থেকেই ধরে নিয়েছিলাম, এমন একটি আন্দোলন আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। কারণ যে উদ্দেশ্যেই করুক, যুদ্ধাপরাধের বিচার আওয়ামী লীগেরও ইস্যু। আওয়ামী লীগ সুবিধা নিতে পারে, তা ধারণা ছিল।নিজেদের কারণে মঞ্চের বিভাজন আন্দোলনের গতি কমিয়ে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গণজাগরণ মঞ্চে বিভক্তি থাকলেও শাহবাগ আন্দোলন সফল। গণজাগরণ মঞ্চ শাহবাগ আন্দোলন সৃষ্টি করেনি বরং শাহবাগ আন্দোলনই গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করেছে। সফলতা দেখতে হবে শাহবাগ আন্দোলনের, গণজাগরণ মঞ্চের নয়।শাহবাগ আন্দোলনের শুরু থেকেই সংহতি প্রকাশ করে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এটি ছিল তরুণদের আন্দোলন। আমরা হয়তো কাছে থেকে দেখে সংহতি প্রকাশ করেছি। তরুণদের আন্দোলনের পথ তরুণরাই ঠিক করে। কিন্তু বিভাজনের আন্দোলন বেশি দূর এগুতে পারে না। নেতৃত্ব দিতে গেলে অনেক কিছুই ছাড় দিতে হয়। এমন ছাড় দিতে না পারলে আন্দোলনের সার্বিক সফলতা আসে না।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক নেতা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে শাহবাগ আন্দোলন একটি স্মরণীয় ঘটনা, যার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রূপায়ন চলে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার তাগিদে এমন আন্দোলন আর দেখা যায়নি। ওই আন্দোলনের কারণেই যুদ্ধাপরাধ বিচার বিশেষ গতি পেয়েছে।গণজাগরণ মঞ্চের বিভাজন কারোরই কাম্য ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই আন্দোলনের সফলতা অনেক। কিন্তু নিজেদের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝির কারণে তরুণরা যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে, তাতে আন্দোলন গতি হারিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা পূরণে তরুণদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।এএসএস/এমজেড/এনএফ/এআরএস/এসএম
Advertisement