# গ্রাহকদের বিমা পলিসির টাকা ফেরত পাওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে# বছরের পর বছর ধরে ঋণাত্মক যমুনা লাইফের ‘লাইফ ফান্ড’# প্রথমবর্ষ প্রিমিয়াম আয় বেশি দেখিয়ে কমিশনসহ বিভিন্ন খাতের খরচ দেখিয়ে কোম্পানি থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে সন্দেহ# শুধু যমুনা লাইফ নয়, ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় অনেক বিমা কোম্পানিই করছে- দাবি করেছেন যমুনা লাইফের সিইও
Advertisement
নতুন প্রজন্মের জীবন বিমা কোম্পানি যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স। ব্যবসার শুরু থেকেই কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে বেপরোয়া খরচ করছে বিমা গ্রাহকদের টাকা। ব্যবসা শুরুর পর একে একে আট বছর পার করলেও কোম্পানিটি খরচের লাগাম টেনে ধরতে পারেনি। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠছে প্রতিষ্ঠানটির সংকট।
আইন লঙ্ঘন করে মাত্রাতিরিক্ত টাকা খরচ করায় কোম্পানিটির আর্থিক ভিত্তি বেশি দুর্বল। এমনকি একটি জীবন বিমা কোম্পানির প্রাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় লাইফ ফান্ড (জীবন তহবিল), যমুনা লাইফের সেই লাইফ ফান্ড বছরের পর বছর ধরে ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। ফলে কোম্পানিটি থেকে বিমা পলিসি কেনা গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়া পড়ছে অনিশ্চয়তার মধ্যে।
আরও পড়ুন>> সংকটে প্রগ্রেসিভ লাইফ
Advertisement
অন্যদিকে আইন লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর গ্রাহকের টাকা খরচ করার পাশাপাশি প্রতিবছর কোম্পানিটির বিক্রি করা সিংহভাগ বিমা পলিসি তামাদি (ল্যাপস) হয়ে যাচ্ছে। নতুন পলিসি বিক্রির পর বছর ঘুরতেই প্রায় ৯০ শতাংশ পলিসি তামাদি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির। ফলে কমছে নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ের হার।
আর্থিক দুরবস্থায় পড়া কোম্পানিটি বিমা ব্যবসার নিবন্ধন সনদের শর্তও লঙ্ঘন করেছে। নিবন্ধন সনদের অন্যতম শর্ত ছিল তিন বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে ২০১৩ সালে নিবন্ধন পাওয়া এ জীবন বিমা কোম্পানিটি ব্যবসা শুরু করে ২০১৪ সালে। ব্যবসা শুরুর পর এরই মধ্যে আট বছর পার করে ফেললেও কোম্পানিটি এখনো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারেনি।
নিবন্ধন সনদের শর্ত লঙ্ঘনের পাশাপাশি কোম্পানিটি দীর্ঘদিন নিয়মিত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) পদ খালি রেখেও আইন লঙ্ঘন করেছে। তবে সম্প্রতি কোম্পানিটির সিইও হিসেবে অনুমোদন পেয়েছেন কামরুল হাসান খন্দকার। যিনি দুই বছর ধরে কোম্পানিটির সিইও পদে চলতি দায়িত্ব পালন করেছেন।
আরও পড়ুন>>নানাবিধ সংকটে ধুঁকছে পদ্মা লাইফ
Advertisement
অথচ বিমা আইন অনুযায়ী, বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) পদ তিন মাসের বেশি খালি রাখা যাবে না। তবে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ অনুমোদন দিলে সিইও নিয়োগের জন্য আরও তিন মাস সময় পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে ছয় মাসের বেশি সিইও পদ খালি রাখার সুযোগ নেই। কোনো কোম্পানিতে সিইও পদ ছয় মাস শূন্য থাকলে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে বিমা আইনে।
একটি জীবন বিমা কোম্পানি ব্যবস্থাপনা খাতে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে তা আইন দ্বারা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আইন অনুযায়ী, সবশেষ সমাপ্ত বছর ২০২১ সালে যমুনা লাইফের ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা নির্ধারিত হয় ৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা। তবে এবছর কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ১২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইন লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানটি তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।
শুধু ২০২১ সাল নয়, এর আগের বছরগুলোতেও কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেছে। ২০২০ সালে কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করে। বছরটিতে ব্যবস্থাপনা খাতে কোম্পানিটির সর্বোচ্চ ব্যয় নির্ধারিত হয় ৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। তবে ব্যয় করে ১০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
ব্যবস্থাপনা খাতে অবৈধভাবে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করায় কোম্পানিটির পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আইনি সীমার অতিরিক্ত যে টাকা ব্যয় করা হচ্ছে তার ৯০ শতাংশই প্রতিষ্ঠানের পলিসিহোল্ডাররা প্রাপ্য। বাকি ১০ শতাংশের ভাগিদার শেয়ারহোল্ডাররা।
আরও পড়ুন>>গ্রাহকের টাকা অবৈধভাবে খরচ করছে ডায়মন্ড লাইফ
প্রতিষ্ঠানটির পলিসির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতি বছর বড় অঙ্কের বিমা পলিসি তামাদি হয়ে যাচ্ছে। সবশেষ ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি নবায়ন প্রিমিয়াম আয় করেছে ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। বছরটিতে প্রথমবর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের দ্বিতীয় বর্ষ নবায়নের শতকরা হার মাত্র ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ, বিমা পলিসি বিক্রির দ্বিতীয় বছরেই নবায়ন প্রিমিয়াম আয় ৮৯ দশমকি ৭০ শতাংশ আদায় হয়নি। ২০২০ সালেও এ আদায়ের হার ছিল ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ হিসাবে প্রতি বছর কোম্পানিটি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম যা আদায় করছে, তার প্রায় ৯০ শতাংশ পরের বছরে আর নবায়ন হচ্ছে না।
কোম্পানিটির নতুন পলিসি ইস্যুর পরের বছরেই তামাদি হয়ে যাওয়ার এ হারকে আশঙ্কাজনক বলছেন বিমা সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন— নতুন পলিসি ইস্যুর পরের বছরেই প্রায় ৯০ শতাংশ পলিসি তামাদি হওয়া কিছুতেই স্বাভাবিক না। এখানে প্রথমবর্ষ প্রিমিয়াম আয় বেশি দেখিয়ে অনৈতিকভাবে কমিশনসহ বিভিন্ন খাতের খরচ দেখিয়ে কোম্পানি থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে সন্দেহ করাই যেতে পারে। আইডিআরএর বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা উচিত।
এদিকে একটি জীবন বিমা কোম্পানির প্রাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় লাইফ ফান্ডকে। যমুনা লাইফের এ লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। ২০২১ সালের শুরুতে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ছিল ঋণাত্মক ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যা বছর শেষে দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। আগের বছর ২০২০ সালের শুরুতে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ছিল ঋণাত্মক ৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা বছর শেষে দাঁড়ায় ঋণাত্মক ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকায়।
আরও পড়ুন>>বিমার প্রতি আস্থা ফেরানো প্রধান লক্ষ্য: আইডিআরএ চেয়ারম্যান
একাধিক বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, লাইফ ফান্ডকে একটি জীবন বিমা কোম্পানির রক্তের সঙ্গে তুলনায় করা হয়। মানুষ রক্তশূন্য হয়ে পড়লে যেমন বাঁচে না। তেমনি জীবন বিমা কোম্পানির লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক হয়ে পড়লে ওই কোম্পানি সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। যে কোম্পানির লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক, ওই কোম্পানিতে গ্রাহকদের টাকা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গ্রাহক তার জমা করা টাকা ফেরত পাবে কি না তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা।
এ বিষয়ে প্রগতী লাইফের সিইও এবং জীবন বিমা বিশেষজ্ঞ মো. জালালুল আজিম জাগো নিউজকে বলেন, একটি জীবন বিমা কোম্পানির লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক মানে ওই কোম্পানির ভবিষ্যৎ জিরো। আমার মতো ওই কোম্পানি অপারেট (পরিচালনা) করতে দেওয়া উচিত না। যাদের এ অবস্থা তারা এ মার্কেট নষ্ট করছে। ইমেজ নষ্ট করছে। এটা নিয়ন্ত্রক সংস্থার দেখা উচিত এবং তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে যমুনা লাইফের সিইও কামরুল হাসান খন্দকার বলেন, আমি আগে যমুনা লাইফের সিইও পদে চলতি দায়িত্বে ছিলাম। এখন আমি পূর্ণাঙ্গ সিইও।
কামরুল হাসান খন্দকার বলেন, ব্যবস্থাপনা খাতে আইনি সীমার অতিরিক্ত ব্যয় শুধু যমুনা লাইফ করছে না, অনেক বিমা কোম্পানিই করছে। সুতরাং, এটা যমুনা লাইফের একার সমস্যা না, এটা টোটাল ইন্ডাস্ট্রির সমস্যা।
তিনি আরও বলেন, পুঁজিবাজারে আসতে হলে আমাদের কতগুলো ফাইন্যান্সিয়াল স্টেপ (আর্থিক পদক্ষেপ) আছে। পুঁজিবাজারে আসতে কিছু আর্থিক ক্রাইটেরিয়া লাগে। আমরা আশা করছি সেগুলো শেষ করে আগমী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে অর্থাৎ, ২০২৩ বা ২০২৪ সালে পুঁজিবাজারে আসতে পারবো।
এমএএস/এমএএইচ/এএসএ/জিকেএস