বাংলাদেশে বেশ কিছু আটকেপড়া পাকিস্তানি আছে। এই মুহূর্তে সংখ্যাটা কত ঠিক জানি না। তবে ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর এবং সৈয়দপুরের বিভিন্ন ক্যাম্পেই মানবেতর জীবনযাপন করেন আটকেপড়া পাকিস্তানিদের বেশিরভাগ। তবে তাদের কেউ কেউ নানা পেশায় সফল হয়ে ক্যাম্প ছেড়ে স্বাধীন জীবনযাপন করছেন। তবে এই সংখ্যাটা অল্প।
Advertisement
ক্যাম্পে আটকানো জীবনই বেশিরভাগের নিয়তি। এই আটকেপড়া পাকিস্তানিরা পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা জনগোষ্ঠির একটি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর হিন্দুদের অনেকে তখনকার পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে যান। আবার ভারত থেকে মুসলমানদের অনেকে তখনকার পাকিস্তানে চলে আসেন। কিন্তু তখন পাকিস্তান ছিল দুইভাগে। বর্তমান বাংলাদেশ ছিল তখন পূর্ব পাকিস্তান। নৈকট্য বিবেচনায় ভারত থেকে আসা অনেকে পশ্চিম পাকিস্তানে গেছেন, অনেকে এসেছেন তখনকার পুর্ব পাকিস্তানে। আর পূর্ব পাকিস্তানে যারা এসেছিলেন, তাদের বেশিরভাগ ছিলেন বিহারে। তাই বাংলাদেশে তারা ’বিহারি’ হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু এই বিহারিরা বিপাকে পড়ে একাত্তর সালে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। শুধু অবস্থান নিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে মিলে তারা নানান যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পরও বিহারীরা অনেক এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। যদিও সফল হয়নি।
এই দুর্ভাগা জনগোষ্ঠি নিজেদের মাতৃভূমিকে হেলায় ছেড়ে এসেছে। আর যে দেশকে নিজের দেশ ভেবে তারা এসেছিল সেই পাকিস্তানের দেখাই পায়নি তারা। স্বাধীনতার পর তারা আটকে যায় বাংলাদেশে। যে দেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছে, সেই দেশেই তাদের অনিচ্ছায় থাকতে হচ্ছে। আর পেয়ারের পাকিস্তান এখন তাদের স্বীকারই করছে না। একাত্তরের পর এ নিয়ে অনেক দেন দরবার হলেও শেষ পর্যন্ত আটকেপড়া পাকিস্তানিদের কোনো গতি হয়নি। একাত্তরের পরের জন্ম নেয়া অনেকে এখন বাংলাদেশকেই তাদের দেশ মনে করে। তারা ভোটার তালিকায়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
Advertisement
এ তো গেল শারীরিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের কথা। তাদের বেশিরভাগ যেহেতু একটা নির্দিষ্ট এলাকায় থাকে, তাই তাদের সহজেই চেনা যায়। কিন্তু শারীরিকভাবে আটকেপড়াদের মত মানসিকভাবে পাকিস্তানকে নিজের দেশ মনে করা অনেকেও এখন বাংলাদেশে আটকে পড়েছেন। তারা একাত্তর সালে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিলেন।
শান্তি কমিটি, আল বদর, আল শামস নানান বাহিনী গড়ে তারা পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়তা করেছে। স্বাধীনতার পর আটকেপড়া পাকিস্তানিদের মত মানসিকভাবে পাকিস্তানকে নিজের দেশ মনে করা একটা গোষ্ঠিও বাংলাদেশে আটকা পড়ে। স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও এই গোষ্ঠিটি বাংলাদেশকে নিজেদের দেশ মনে করতে পারেনি। বরং এই ৫১ বছরে তারা ঝাড়ে-বংশে বেড়েছে। শারীরিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের নতুন প্রজন্ম নিজেদের বাংলাদেশের নাগরিক মনে করলেও মানসিকভাবে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের উত্তরসূরিরা এখনও পুরোপুরি বাংলাদেশি হতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান একটি অভিন্ন রাষ্ট্র ছিল ভারত নামে। ব্রিটিশরা দুইশ বছরের শাসন শেষে ফিরে যেতে বাধ্য হওয়ার আগে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতকে ভেঙে দিয়ে যায়। সৃষ্টি হয় পাকিস্তান নামে এক অদ্ভুত রাষ্ট্রের। ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানে ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল ১১০০ মাইল। কিন্তু মানসিক দূরত্ব ছিল অলঙ্ঘনীয়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা সেই দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ তো নেয়ইনি। বরং তাদের শোষণ, বঞ্চনা আর অবহেলায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে সৃষ্টি হয় স্বাধীনতার আকাঙ্খা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম শেষে একাত্তরে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা।
এক সময়ের পূর্ববঙ্গ, পরের পূর্ব পাকিস্তান বদলে যায় স্বাধীন বাংলাদেশে। যুদ্ধে স্বাধীনতা পেলেও আমরা আমাদের ন্যায্য পাওনা পাইনি। স্বাধীনতার আগের সম্পদের ন্যায্য হিস্যা, ’৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আসা আন্তর্জাতিক সাহায্য পুরোটাই মেরে দিয়েছে পাকিস্তান। আশ্বাস দিলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি, আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেয়নি। এতকিছুর পরও বাংলাদেশের কিছু মানুষ এখনও পাকিস্তানকে হৃদয়ে ধারণ করেন।
বাংলাদেশে পাকিস্তান ক্রিকেটের বিপুল সংখ্যক সমর্থক আছে। তবে এই সমর্থনের দুটি ধরণ আছে। কিছু লোক আছে, যারা নিছক ক্রিকেটিয় কারণে পাকিস্তানকে সমর্থন করেন। ক্রিকেটিয় কারণে পাকিস্তানকে সমর্থন করার অনেকগুলো কারণও আছে। একসময় পাকিস্তান এক্সাইটিং ক্রিকেট খেলতো। যে আনপ্রেডিক্টেবিলিটি ক্রিকেটের সবচেয়ে সৌন্দর্য্য, তার সবচেয়ে বড় সাইনবোর্ড পাকিস্তান।
Advertisement
জাভেদ মিয়াদাদ, সাঈদ আনোয়ার, ইনজামাম উল হক থেকে শুরু করে আফ্রিদী পর্যন্ত; দারুণ সব ব্যাটসম্যান উপহার দিয়েছে পাকিস্তান। আবদুল কাদিরের মত অননুকরনীয় অ্যাকশনের গুগলি বোলারও পাকিস্তানের। ইমরান খানের মত সর্বকালের সেরা অধিনায়কও পাকিস্তানই উপহার দিয়েছে। তবে পাকিস্তান ক্রিকেটের আসল সৌন্দর্য্য বা সমর্থনের আসল কারণ তাদের ফাস্ট বোলারদের আধিক্যে এবং বৈচিত্র্যে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়া ফাস্ট বোলারদের এমন সমাহার আর কোথাও নেই। আকরাম, ওয়াকার, শোয়েব আখতার তাদের গতি দিয়ে একসময় বিশ্ব শাসন করেছেন। ডেথ ওভারে ওয়াসিম আকরামের ইয়র্কার বা গতির তোড়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের স্ট্যাম্প উপড়ে শোয়েব আখতারের ঈগল হয়ে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা বিশ্ব ক্রিকেটেরই সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যকল্পের জন্ম দেয়। তাই যারা নিছক ক্রিকেটিয় কারণে পাকিস্তানকে সমর্থন করতেন বা করেন, তাদের ব্যাপারে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু লোক আছে, যারা রাজনৈতিক বিবেচনায় পাকিস্তানকে সমর্থন করেন। এরা এমনকি বাংলাদেশের সাথে খেলা হলেও পাকিস্তানকে সমর্থন করে, পতাকা নিয়ে মাঠে যায়। পাকিস্তান জিতলে উৎসব করে। এরা এমনিতে লুকিয়ে থাকে, তবে সুযোগ পেলেই নখদন্ত বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের এই পাকিস্তানী ধারাটি কিন্তু নতুন নয়। এমনকি ৭০এর নির্বাচনেও এই বাংলাদেশের অনেকে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে তারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। শুধু পক্ষে থেকে ক্ষান্ত হয়নি, তারা পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে মিলে মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাকামী মানুষদের হত্যা করেছে। বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে উদার, অসাম্প্রদায়িক, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লড়াই শুরু হয়। তখন এই স্বাধীনতাবিরোধীরা ঘাপটি মেরে ছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আবার মাঠে নামে। খুনি মোশতাকের নেতৃত্বে রাতারাতি বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা হয়। জয়বাংলা হয়ে যায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থি ধারার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। রাজাকার শিরোমনি গোলাম আজম দেশে ফেরার সুযোগ পায়। স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজ হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতাবিরোধী সেই ধারার নেতৃত্ব এখনও বিএনপির হাতেই। খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে বিএনপির নেতৃত্ব এখন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হাতে, যার পিতা ছিলেন একাত্তরে শান্তি কমিটির নেতা।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ টানা ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। বাংলাদেশের মত একটি দেশে টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকলে জনপ্রিয়তা ধরে রাথা কঠিন নয় শুধু অসম্ভবও। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র, মানবিধকার, ভোটাধিকার, দুর্নীতি, অর্থপাচার, গুম, খুনের হাজারটা অভিযোগ করা যাবে। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে, সেটাও স্বীকার করতে হবে।
আপনি যদি অন্ধ সরকার বিরোধী হন, আওয়ামী লীগের উন্নয়নও অস্বীকার করতে পারেন। কিন্তু বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন বলেন, ’আমরা পাকিস্তান আমলে আর্থিক ও জীবন যাত্রার দিক থেকে অনেক ভালো ছিলাম। তারপরেও পাকিস্তান সরকার যেহেতু আমার অধিকার ও সম্পদহরণ করতো সে কারণে আমরা যুদ্ধ করেছি। কিন্তু এখন তার থেকেও খারাপ অবস্থায় আছি।’ তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, এটা নিছক আওয়ামী বিরোধিতা নয়, এটা আসলে হৃদয়ে লুকিয়ে রাখা পাকিস্তান প্রেমের বহিঃপ্রকাশ।
মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমরা আর যাই হই, কখনো মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবো না। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাই আমার চিরকালীন ভালোবাসা। এই ভালোবাসার সবচেয়ে বড় কারণ, পাকিস্তানের মত একটি অকার্যকর রাষ্ট্রের সাথে আমাদের থাকতে হয়নি। স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ লুটে নিয়ে পশ্চিমারা বড় হয়েছে। কিন্তু গত ৫১ বছরে পাকিস্তান ক্রমাগত পিছিয়েছে, আর সবার সব আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়েছে। শ্রীলঙ্কার পর এ অঞ্চলে দেউলিয়া হওয়ার ঝুকিতে থাকা দেশটির নাম পাকিস্তান।
অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি- সব বিবেচনাতে বাংলাদেশে এখন পাকিস্তান থেকে যোজন যোজন এগিয়ে। মির্জা ফখরুলের কাছে পাকিস্তান ভালো লাগলেও পাকিস্তানিদের কাছে কিন্তু বাংলাদেশ ভালো লাগে। পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, অর্থনীতিবিদরা কিন্তু বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীর হওয়ার পর পাকিস্তানের উন্নয়নে সুইডেন মডেল অনুসরণের কথা বলেছিলেন। তখন এক টিভি টক শোতে পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী জাইঘাম খান বলেছিলেন, ’খোদাকে ওয়াস্তে হামকো বাংলাদেশ বানা দো।’ পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা যখন বাংলাদেশ হতে চায়, তখন আমাদের রাজনীতিবিদরা পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর। এ বড় বেদনার, এ বড় গ্লানির।
স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আছে, স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি আছে- এটাই আমাদের জন্য লজ্জার। শুধু স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি আছে বলেই নয়, তারা বড় গলায় নিজেদের জানান দেন, নির্লজ্জের মত পাকিস্তান আমলে ভালো থাকার জাবর কাটেন, এটা নিছক রাজনৈতিক বিরোধিতা নয়, এটা রাষ্ট্রবিরোধিতা।
আমরা চাই, বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার পক্ষে থাকবে। যারা স্বাধীনতার বিপক্ষে, যারা বাংলাদেশের বিপক্ষে, যাদের হৃদয়ে পাকিস্তান; তারা যেন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ না পায়।
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/এমএস