জাতীয়

‘মিয়ানমার বিষয়ে বাংলাদেশের ব্যাপকভিত্তিক নীতি-কৌশল দরকার’

আলতাফ পারভেজ। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস বিষয়ক গবেষক। মূলত স্বাধীন গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ প্রায় দশটি। ‘অরাজ’সহ বিভিন্ন জার্নালে নিয়মিত লেখেন।

Advertisement

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে পড়াশোনা। ছাত্রাবস্থায় সামরিকজান্তাবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমর্থনে ডাকসুর সদস্য নির্বাচিত হন তখন। বর্তমানে আগ্রহের জায়গা রাষ্ট্রপ্রশ্ন এবং দক্ষিণ এশিয়ার এথনো-পলিটিক্স।

মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে গুলির ঘটনা এবং বাংলাদেশের করণীয় প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

Advertisement

জাগো নিউজ: সীমান্তে গুলির আওয়াজ। মিয়ানমারের গুলি, মর্টারশেল পড়ছে বাংলাদেশে। মানুষও মরলো। এমন আওয়াজে আসলে কী শুনতে পাচ্ছেন?

আলতাফ পারভেজ: বার্মাজুড়েই (সাবেক মিয়ানমার) গৃহযুদ্ধ চলছে সেটা আমরা জানি। সেই গৃহযুদ্ধের একটা জাতীয় চরিত্র আছে। আবার একটা আঞ্চলিক চরিত্রও আছে। বাংলাদেশে মর্টারশেল পড়েছে আরাকানের আঞ্চলিক গৃহযুদ্ধের কারণে। আরাকানে বান্দরবান সীমান্তের একদম লাগোয়া জায়গায় আরকান আর্মির সঙ্গে টাটমাড নামে পরিচিত বার্মিজ মিলিটারির তুমুল যুদ্ধ চলছে এখন। সেই সংঘাতের গুলি ও মর্টার কখনো কখনো নো-ম্যান্স ল্যান্ডে পড়ছে—কখনো বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরেও এসে পড়ছে। আপনার প্রশ্ন হয়তো—এই মর্টার কে ছুড়ছে, কেন ছুড়ছে, এটা ইচ্ছাকৃত কি না?

আমার ধারণা এটা ছুড়ছে টাটমাড এবং গোলা ও মর্টারের সবগুলো অনিচ্ছাকৃত ছোড়া নয়। সুতরাং, পরের প্রশ্ন ওঠে কেন তারা বাংলাদেশে গুলি ও বোমা ছুড়ছে? কী চায় তারা?

এটা স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। কারণ টাটমাড অফিসিয়ালি প্রকাশ্যে কিছু বলেনি। তবে মনে হচ্ছে তারা বাংলাদেশকে কোনো বিশেষ বার্তা দিতে চায়। সেটা হতে পারে আরাকান আর্মি সংক্রান্ত।

Advertisement

জাগো নিউজ: মিয়ানমার পরিষ্কার ব্যাখ্যা না দিলেও দুর্ঘটনা হিসেবে দাবি করছে। আদৌ দুর্ঘটনা, না কি উসকানি?

আলতাফ পারভেজ: যেহেতু পরপর অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে—সে কারণে একে অনিচ্ছাকৃত বা দুর্ঘটনাবশত বলা যায় না। আবার এও মনে হচ্ছে না বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার কোনো যুদ্ধে জড়াতে চায় এখন। আরাকান আর্মিরও সেরকম কোনো ইচ্ছা বা লক্ষ্য নেই। আমার মনে হয়, যা আমি আগেই বলেছি—টাটমাড সীমিত পরিসরের একটা বার্তা দিতে চাইছে হয়তো বাংলাদেশকে। সেটা সীমান্ত এলাকা সম্পর্কিত হতে পারে। সেটা আরকান আর্মির চলাফেরা সম্পর্কে হতে পারে। অর্থাৎ তারা আরাকান ও চীন প্রদেশের নিজস্ব যুদ্ধে বাংলাদেশকে কঠোরভাবে নিরপেক্ষ থাকতে বলতে পারে। আসলে বাংলাদেশ তাই রয়েছে। কারণ এমন কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই যে, আরাকানের ভেতরকার ঘটনাবলীতে বা চীন বা বার্মার অন্য কোনো জায়গায় বাংলাদেশের কোনো পদক্ষেপ বা ভূমিকা রয়েছে। ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আসার পরও বাংলাদেশ আরাকান বিষয়ে দূরে নিরপেক্ষ অবস্থায় রয়েছে। ফলে, এই অর্থে টাটমাড’র আচরণ কিছুটা উসকানিমূলক তো বটেই।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশকে এখন বিরক্ত করে মিয়ানমারের কী লাভ?

আলতাফ পারভেজ: টাটমাড বহু ফ্রন্টে যুদ্ধে লিপ্ত। বার্মার সেনাবাহিনী প্রকৃতই এখন উম্মাদগ্রস্ত আচরণ করছে দেশের ভিতর। কোনো সেনাবাহিনীকে যখন নিজের জনগণের বিরুদ্ধে মাসের পর মাস যুদ্ধ করতে হয় তাহলে সেটার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হয় না। বার্মার সেনাবাহিনী তাই করছে। এবং প্রায় সব ফ্রন্টে তারা নির্মমতার আশ্রয় নিয়েও ভালো করছে না। আরাকানেও তাদের অবস্থা ভালো নয়। আরাকান আর্মির কাছে তারা অনেকগুলো সীমান্ত চৌকি হারিয়েছে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে। নিজেদের এই ব্যর্থতা ও আরাকানের প্রকৃত অবস্থা আড়াল করতে—বিশেষ করে আরাকান আর্মির শক্তি বাড়াতে তারা বাংলাদেশকে দায়ী করতে পারে। এতে তাদের মুখ রক্ষা হতে পারে। যদিও এরকম অভিযোগ বা দাবির কোনো বাস্তবতা নেই। আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ নেই। এর সদর দপ্তর কাচিনে।

জাগো নিউজ: সীমান্তের এই উত্তেজনা নিয়ে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যে নীতি অবলম্বন করে আছে, তা কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

আলতাফ পারভেজ: বান্দরবান সীমান্তের এখনকার উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ধৈর্য ধারণ করা উচিত। অবশ্যই যে কোনো সামরিক উসকানিতে অংশগ্রহণের কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশ তা করছেও না। বাংলাদেশ বিষয়টা নিয়ে কূটনীতিক চ্যানেলে বক্তব্য রাখছে। এ মুহূর্তে সেটাই সঙ্গত। তবে বার্মার পরিস্থিতি ক্রমে খারাপ হবে। ফলে বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্তে বাংলাদেশের বার্মামুখী অবস্থান শক্তিশালী করা এবং শক্তিশালী রাখার বাস্তব প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই সেটা করবে বা করছে।

তবে বার্মা বিষয়ে বাংলাদেশের ব্যাপকভিত্তিক নতুন নীতি-কৌশল দরকার এখন। দেশটির পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ অতীতে এতদিন যেভাবে দর্শকের ভূমিকায় ছিল—এখন ক্রমে পরিস্থিতি তার সেই অবস্থান বদলের জন্য চাপ দিচ্ছে।

জাগো নিউজ: দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হচ্ছে বারবার, আবার গুলির ঘটনাও ঘটছে। এই ‘তলব’ নীতির কী গুরুত্ব আছে?

আলতাফ পারভেজ: রাষ্ট্রদূত তলব করে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ক্ষোভ জানানো কূটনীতিক পন্থা। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে তাই করছে। এটা একটা প্রাথমিক পদক্ষেপ। হয়তো এরপর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামেও তার এই উদ্বেগের কথা তুলবে। আপাতত প্রকাশ্যে-- এরকম কূটনীতিক অপশনগুলোই বাংলাদেশের জন্য রয়েছে।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ জাতিসংঘে নালিশ করতে চাইছে। এতে কী ফল আসতে পারে?

আলতাফ পারভেজ: বার্মা যদি ক্রমাগত সীমান্তে উসকানিমূলক কাজ করে বাংলাদেশ অবশ্যই জাতিসংঘে বিষয়টা তুলে ধরতে পারে। সেটা উচিতই হবে। বার্মার শাসকদের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর স্বার্থে এরকম পদক্ষেপের ইতিবাচক ভূমিকা আছে।

জাগো নিউজ: আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশিটির সেনাবাহিনীর সংঘাত। রোহিঙ্গা ইস্যু কীভাবে মেলানো যায় এই উত্তেজনায়?

আলতাফ পারভেজ: আরাকানের গৃহযুদ্ধ এবং তাতে আরাকান আর্মির উত্থান রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার ব্যাপারটিতে বাড়তি জটিলতা তৈরি করেছে অবশ্যই। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে এখন আর আগের মতো কেবল টাটমাড’র সঙ্গে বোঝাপড়া করলে হবে না। আরাকান আর্মির সঙ্গেও বাংলাদেশকে একটা বোঝাপড়ায় আসতে হবে। না হলে রোহিঙ্গারা সেখানে গিয়ে থাকতে পারবে না। বলা যায়, আরাকানে এখন নতুন এক রাজনৈতিক সামরিক চরিত্র হয়ে উঠেছে আরাকান আর্মি। বাংলাদেশকে এই বাস্তবতা গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে ও দেখতে হবে।

জাগো নিউজ: ভারত কীভাবে দেখছে? বাংলাদেশে এখানে ভারতকে কীভাবে পক্ষে নিতে পারে?

আলতাফ পারভেজ: আরাকান ও চীন প্রদেশের এই গৃহযুদ্ধে ভারতও অন্যতম ভিকটিম। চীন থেকে মিজোরামে বিপুল শরণার্থী ঢুকছে প্রতিদিন। মিজোরামে এরই মধ্যে চীন ও আরাকানের প্রায় ৩০ হাজার শরণার্থী আছে বলে অনুমান করা হয়। আরাকানে ভারতে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। তাদের জন্যও সেখানকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। তারা গভীরভাবে সেটা মনোযোগ দিয়ে দেখছে অবশ্যই। তবে মুশকিল হলো আরাকানে বাংলাদেশ ও ভারতের স্বার্থ একরকম নয়। বাংলাদেশের স্বার্থ হলো রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো। ভারতের জন্য এটা বড় ইস্যু নয়। তারা চাইছে তাদের বিনিয়োগের নিশ্চয়তা। ওটুকুতেই তাদের সন্তুষ্টি। ফলে আমরা মনে হয় না ভারত রোহিঙ্গাদের ফেরতের বিষয়ে আরাকান আর্মি বা টাটমাডকে কোনো চাপ দিতে রাজি হবে।

জাগো নিউজ: মিয়ানমার আলোচনায় এলে চীনের নীতিও গুরুত্ব পায়। চীনকে কীভাবে দেখা যায় এখানে?

আলতাফ পারভেজ: চীন বার্মার সামরিকজান্তার প্রধান মিত্র। আবার শোনা যায় আরাকান আর্মিও চীন থেকে সহায়তা পায়। আরাকানে চীনেরও বিপুল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ আছে। তার মানে ভূ-রাজনীতির জটিল এক খেলা চলছে আরাকানে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে চীন বার্মার কেন্দ্রীয় সরকারকে বা আরাকান আর্মিকে চাপ দিয়েছে বলে শোনা যায় না। দেবে বলেও মনে হয় না। আসলে প্রত্যেকটি দেশ যার যার জাতীয় স্বার্থ দ্বারা চালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বার্থ চীন বা ভারত হাসিল করে দেবে এরকম ভাবার কোনো সুযোগ নেই। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে বা বার্মার টাটমাডকে বাংলাদেশের সীমান্তে সংযত রাখতে হলে যা করার বাংলাদেশ সরকারকেই করতে হবে। চীন বা ভারত সেরকম কিছু করে দেবে—আশা করা ভুল হবে।

জাগো নিউজ: শক্তিমত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশ হার্ডলাইনে যেতে পারে কি না?

আলতাফ পারভেজ: বান্দরবানের ঘটনাবলীর কারণে দক্ষিণ সীমান্তে বাংলাদেশের হার্ডলাইনের কোনো অবকাশ আছে বলে আমার মনে হয় না। হার্ডলাইন বলতে যদি আপনি সামরিক পদক্ষেপকে বুঝিয়ে থাকেন—তবে সেটা হবে এখন একটা ভুল কৌশল। কারণ বাংলাদেশের প্রধান স্বার্থ তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের প্রধান স্বার্থ হলো যে কোনোভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো। যে কোনো হার্ডলাইন বাংলাদেশের সেই লক্ষ্যকে দ্বিতীয় অবস্থানে নিয়ে যাবে। তবে রোহিঙ্গা প্রশ্নে, আরাকান প্রশ্নে, আরাকান আর্মির প্রশ্নে এবং বার্মার চলমান গৃহযুদ্ধের প্রশ্নে বাংলাদেশের অবশ্যই পুনর্ভাবনার অবকাশ ও প্রয়োজনীয়তা আছে।

এএসএস/এএসএ/জিকেএস