মাত্র কয়েকদিন আগে মিয়ানমার বাংলাদেশের আকাশ সীমায় যুদ্ধ বিমান উড়িয়েছে। সীমান্তে গোলা ছুঁড়েছে। তারও এক সপ্তাহ আগে ছুঁড়েছিলো মর্টারশেল। নতুন করে বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তে মর্টারশেল ছুঁড়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। শেলের আঘাতে নিহত হয়েছেন একজন এবং আরো পাঁচজন আহত। আতঙ্কের ভেতরে কাটাচ্ছেন ঐ অঞ্চলে বসবাসকারী নাগরিকেরা। বাধ্য হয়ে সীমান্ত লাগোয়া ধুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র পরিবর্তন করতে হয়েছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে রাখতে হয়েছে সতর্ক প্রহরারত। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে একের পর এক অঘটন ঘটানোতে মিয়ানমারের ভূমিকা যে সুবিধাজনক নয় সেটা স্পষ্ট। পায়ে পাড়া দিয়ে এভাবে ঝগড়া করার অর্থ কি? কি চায় মিয়ানমার?
Advertisement
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বছর পাঁচেক আগে নিজ ভূখণ্ডে উচ্ছেদ-উদ্বাস্তুর শিকার হয়ে ঠাঁই হয় বাংলাদেশের শরনার্থী শিবিরে। যারা মিয়ানমারের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক আদিবাসী। ধর্মের দিক থেকে মুসলমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। নবম-দশম শতাব্দীতে যারা পরিচিতি ছিলো রোহাঙ বা রোহাঙ্গ নামে। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ব্রিটিশরা মিয়ানমারে বসবাসরত ১৩৯ জাতিগোষ্ঠীর একটা তালিকা প্রকাশ করেছিলো। তালিকায় কোন কারণে বাদ পড়ে যায় রোহিঙ্গারা। পরবর্তীতে আখ্যায়িত হতে থাকে তারা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আগত অভিবাসী। দেওয়া হয়নি নাগরিকত্ব কিংবা নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি। দমন পীড়নের মাধ্যমে বিতাড়িত হতে থাকে ১৭৮৪ সাল থেকে। ১৯৪২, ১৯৭৮, ১৯৯২ এবং ২০১৭ সালের শিকার হয় পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম গণহত্যার। ঢল নামে বাংলাদেশ সীমান্তে। তৎপরবর্তী ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তো আমরা সককলেই জানি।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা বাংলার সাথে কিছুটা মিল থাকা এবং ধর্মীয় কারণে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলো। বর্ণবাদী রাখাইনদের দ্বারা শিকার হয়েছে চরম বৈরিতার। সকল ঘাটে তাড়া খেয়ে শেষে স্থান হয় মানবিক বাংলাদেশে। কয়েকশত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জীবন বাঁচাতে মানুষের ঢল আসতে থাকে সীমান্তের দিকে। প্রমত্তা নাফ নদীও সে ঢেউয়ে প্রতিবন্ধতা তৈরি করতে পারেনি। আমরাও একদিন পাকিস্তানি হায়েনা কর্তৃক নির্যাতন, নিপীড়ন এবং গণহত্যার শিকার হয়েছিলাম। আশ্রয় পেয়েছিলাম ভারতে। মানবিক সেই দায় আমাদের নিয়মিত তাড়িয়ে বেড়ায়। রোহিঙ্গাদেরও আমরা না বলতে পারিনি। কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশটা তো ছোট। নিজেদেরই এখানে কর্মসংস্থান সংকট, আছে অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা। দ্বিতীয়ত বসিয়ে বসিয়ে আর কত খাওয়ানো যায়!
গত মাসের মাঝামাঝি রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাচলেট। অতঃপর এসেছেন জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত মিস নোয়েলিন হেজার। পরিদর্শন শেষে হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচলেট তুলে ধরেছেন শরনার্থী জীবনের কথা। রোহিঙ্গাদের সাথে যা হয়েছে তা যে মানবাধিকার লঙ্ঘন সে কথারই ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। রোহিঙ্গাদের তিনি আশ্বস্ত করেছেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রত্যাবাসন করার। ব্যক্ত করেছেন অনিরাপদ জীবনে তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে না। এ সপ্তাহে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার ৫১তম অধিবেশনে মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে আলাদা বিশেষ প্রতিবেদন পেশ এবং তা নিয়ে আলোচনা হয়।
Advertisement
জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধানের শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন এবং কমিশনের অধিবেশনে পেশ হওয়া প্রতিবেদনে মিয়ানমার একধরনের চাপ অনুভব করেছে এটা স্বাভাবিক। এমনকি বাংলাদেশের সরকার প্রধানও ইতোমধ্যে বলেছেন আমরা আর কত দেখবো! যেভাবেই হোক তোড়জোড় চলছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফেরানোর। ঠিক এই সময়টাতেই বাংলাদেশ সীমান্ত লক্ষ্য করে মিয়ানমার কর্তৃক নানা অঘটন ঘটানোর উদ্দেশ্য যে অসৎ সেটা বুঝতে হয়তো কারো বাকি নেই। মিয়ানমার জান্তা সরকার আক্রমণ করে রোহিঙ্গাদের বার্তা দিতে চায় “তোমরা এসো না, আসলে কপাল খারাপ আছে”। এতে যদি ভয় পেয়ে রোহিঙ্গারা না যেতে চায় তাতেই তো মিয়ানমার জান্তা সরকারের ষোলকলা পূর্ণ।
২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বহু চেষ্টার পর একবার তারিখ নির্ধারিত হয়েছিলো। দেওয়া হয়েছিলো ৮ হাজার ৩৭৪ জনের তালিকা। শেষ মুহূর্তে মিয়ানমারের খামখেয়ালির কারণে জীবনের নিরাপত্তা এবং আবাসস্থল অনিশ্চয়তায় রোহিঙ্গারা যেতে রাজি হয়নি। বর্তমান সময়ে যখনই আবার চাউর হচ্ছিলো তখনই বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের আক্রমণের উদ্দেশ্য উত্তেজনা সৃষ্টি করার। রোহিঙ্গাদের গণহত্যার মুখে দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেও পাড় পেয়েছিলো কেননা রোহিঙ্গা তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। কিন্তু একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সীমান্তে যুদ্ধ বিমান উড়ানো কিংবা গোলা নিক্ষেপ যে চরমতম অন্যায়।
এর জন্য কি তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে না ভেবেছে? ওরা কি ভেবেছে যে বাংলাদেশ নিরব মানে শক্তিতে দুর্বল? বাংলাদেশের মাথায় বোঝা চাপিয়ে দিয়ে দিনদুপুরে ওরা খালাস হয়ে যাবে, বাঙালিরাও নিরবে মেনে নিবে, তা তো হবে না। যুদ্ধ এড়াতে চাওয়ার অর্থ কখনোই দুর্বলতা নয়, বরং বাংলাদেশ সব সময়েই শান্তির পক্ষে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে এক ঘরে করতে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা আহ্বান করেছে মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করতে। সংঘাত এড়াতে আমরাও আহ্বান করছি মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের মিয়ানমারে ফেরাক, স্বাধীন কোন রাষ্ট্রের উপর হামলে না পড়ুক; নতুবা এর পরিণতি নেতিবাচক হতে বাধ্য।
রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ এবং ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগের চিত্র পৃথিবী জুড়ে দেখেছে। দেখেছে সামরিক জান্তার পৈচাশিক উল্লাস। সুতরাং রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, এ কথা মুখে যতোটা স্বীকার করা সম্ভব; বাস্তবে অস্বীকার করা ততটাই অসম্ভব। মিয়ানমার যদি মনে করে ভয় দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের বোঝা আমাদের মাথায় চাপিয়ে দিতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে আক্রমণ ন্যায়সঙ্গত; তবে তাদেরও বুঝে রাখা উচিত এ ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এদেশে একাত্তর নেমে এসেছিলো। নেমে এসেছিলো বর্বর পাক হায়েনার রক্তের হোলিখেলা। আধুনিক মারণাস্ত্রের বিপরীতে খালি হাতে অদম্য সাহস নিয়ে বাঙালিরা দাঁড়াতে জানে। মিয়ানমারের চিন্তায় তেমনটাই যদি হয়, আমরা নাহয় গাইবো আবার জয় বাংলার গান।
Advertisement
লেখক: প্রাবন্ধিক।
এইচআর/জিকেএস