অর্থনীতি

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ‘চিড়েচ্যাপ্টা’ ব্যাচেলররা

চাকরি হোক কিংবা লেখাপড়া- যে কোনো প্রয়োজনেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষকে আসতে হয় ঢাকায়। পরিবারের কাছ থেকে দূরে এসে তাদের অধিকাংশেরই অস্থায়ী আবাস হয় রাজধানীর বিভিন্ন মেস। একসঙ্গে অনেকে থাকার ফলে খরচ কিছুটা কম হওয়ায় এসব ব্যাচেলর মেসে থাকেন। সম্প্রতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মেসে থাকা প্রত্যেকের খাবারের খরচ যেমন বেড়েছে, একই সঙ্গে বেড়েছে সিট ভাড়া (থাকার খরচ)। এই শহরে বসবাস করতে রীতিমতো চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থা ব্যাচেলরদের। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবে পড়াশোনা শেষ করেছেন মালিহা ইয়াসমিন সুমি। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর চাকরির খোঁজে তাকে এখনো ঢাকায় থাকতে হচ্ছে। পড়াশোনার সময় নিজের খরচ বাবদ প্রতিমাসে পরিবারের কাছ থেকে আট হাজার টাকা নিতেন সুমি। কিন্তু বর্তমানে পরিবার খরচ দিতে অনেকটা অপারগ। জীবনযাত্রার ব্যয়ে এখন বড় কামড় বসিয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এতে সুমির জন্য চাকরির আশায় ঢাকায় থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।

Advertisement

জাগো নিউজকে সুমি বলেন, অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্যের কারণে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। হুট করে হোস্টেলের সিট-রেন্ট (মাসিক ভাড়া) দেড় হাজার টাকা বেড়ে গেছে। প্রতি মাসে খাওয়ার খরচ বেড়েছে এক থেকে দেড় হাজার টাকা। এখানে মেসে থেকে চাকরির জন্য চেষ্টা করছি। প্রতিমাসে দুই-তিনটা ইন্টারভিউ থাকে, তাতে বাড়তি খরচ। সেজন্য একটি নতুন পোশাকও কিনতে পারছি না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যেন সব দিকে ঠেকে গেছি। বাড়ি থেকে টাকা চাইলেও আগের মতো পাই না। পরিবার বলে সমস্যা হলে গ্রামে ফিরে যেতে। জীবনযাত্রার এ বাড়তি খরচ এখন আমার স্বপ্নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সুমি বলেন, খরচ সামাল দিতে টিউশনি খুঁজেছি। এখানে সেখানে গিয়ে দেখলাম, আমার মতো শত শত মানুষ টিউশনি খুঁজছে। দেয়ালে দেয়ালে টিউশনির (পড়াতে চাই) পোস্টারে ভরা। পার্টটাইম চাকরি করারও জো নেই। শত শত চাকরিপ্রার্থী। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ায় সবাই একইভাবে হিমশিম খাচ্ছে।

আরও পড়ুন: ‘গরুর মাংস খাওয়া বাদই দিয়েছি’

Advertisement

শুধু সুমি নন, দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতিতে ঢাকায় থাকা অধিকাংশ ব্যাচেলরের জীবন এমন কঠিন হয়ে উঠেছে। মাত্র কয়েকমাসের ব্যবধানে প্রতিটি মেস বা হোস্টেলে খাবার খরচ বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। পাশাপাশি নিত্যব্যবহার্য অন্য সব সামগ্রীর দামও বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বেড়েছে যাতায়াত খরচও। এ অবস্থায় চাকরি বা পড়াশোনার জন্য পরিবারের কাছ থেকে দূরে এসে টিকতে পারছেন না অনেকে। যারা থাকছেন তারা খুব অল্প অর্থ দিয়ে পুরো মাস পার করছেন। বাধ্য হয়েই তারা বাড়তি খাবার, পোশাক, বিনোদনসহ বিভিন্ন খাতে খরচ কাটছাঁট করছেন।

খরচ কতটা বেড়েছে পূর্ব রামপুরা এলাকায় আনিকা ভিলার চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাটে ১২ জন শিক্ষার্থী মিলে মেস করে থাকেন। সেখানে থাকা মামুন হোসেন নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, এ বছর জানুয়ারিতে তাদের মেসের মিল রেট (প্রতি বেলার খাবারের দাম) ছিল ৪১ টাকা। যা গত মাসে (আগস্ট) দাঁড়িয়েছে ৫৭ টাকা। তাতে তিন বেলায় প্রতিজনের শুধু খাবার খরচ বেড়েছে এক হাজার থেকে এক হাজার ৪শ টাকা পর্যন্ত।

তিনি জানান, তাদের মেসে নিত্যব্যবহার্য সব পণ্য (সাবান, শ্যাম্পু, পেস্ট, ডিটারজেন্ট, কয়েক ধরনের ক্লিনার ও অন্যান্য) একসঙ্গে টাকা উঠিয়ে কেনা হয়। এসব বাবদ আগে জনপ্রতি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দিতে হতো। তবে গতমাসে এসব কিনতে জনপ্রতি খরচ হয়েছে ৭২৭ টাকা।

মামুন বলেন, দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতির কারণে গৃহকর্মী বিল বাড়িয়ে দিতে হয়েছে। সঙ্গে একবেলা খাবারও বেশি দিতে হয় এখন।

Advertisement

ওই মেসের আরেক সদস্য সৌমিক জাগো নিউজকে সৌমিক বলেন, সব মিলিয়ে কম করে হলেও মেসের খরচ এখন দুই হাজার টাকা বেশি দিতে হয়। প্রতি মাসে বাড়ি থেকে যে টাকা নিচ্ছি তাতে আর হাতে অবশিষ্ট কিছু থাকছে না। অন্যান্য খাতে খরচের জন্য যে টাকা পাই তাও মেসের খরচ মেটাতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: খরচের ধাক্কা সামলাতে না পেরে ঢাকা ছাড়ছেন অনেকে!

এদিকে, এক বাণিজ্যিক হোস্টেলের অংশীদার মাজহারুল মনি জাগো নিউজকে বলেন, আগে যেখানে গড়ে মাসে দুই হাজার ৭শ টাকায় আমরা মেসের সদস্যদের খাওয়াতাম, সেটা এখন তিন হাজার ৮শ টাকায়ও হচ্ছে না। এছাড়া অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতির কারণে মেস পরিচালনা ব্যয়ও অস্বাভাবিক বেড়েছে।

তাদের হিসাব মতে, আগের থেকে এখন একজন ব্যাচেলরের থাকা-খাওয়ার খরচ ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

খরচ কাটছাঁট করছেন ব্যাচেলররাফার্মগেট তেজকুনিপাড়া এলাকায় একটি মেসে থাকেন শিক্ষার্থী আব্দুল মতিন। তিনি বলেন, সীমিত টাকায় এ শহরে বসবাস করা কঠিন হয়ে উঠেছে। আগে মাঝেমধ্যে পোশাক-আশাক কিনতাম, সেটা এখন আর হয়ে ওঠে না। আড্ডার জন্য এখানে-ওখানে যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছি। নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া বাইরেও বের হচ্ছি না এখন।

আব্দুল মতিনের মতোই আরও কয়েকজন জানান, অনেকে বাড়তি কাজ করে নিজেদের খরচ মেটানোর চেষ্টা করছেন। বাধ্য হয়ে বিভিন্ন ধরনের পার্টটাইম কাজ করছেন। অনেকে মাস শেষ হওয়ার আগেই টাকা আনছেন পরিবারের কাছ থেকে। সেক্ষেত্রে বাড়তি চাপের বোঝা পড়ছে পরিবারের কাঁধে। আবার সে উপায় যাদের নেই তারা খাবার, বিনোদন, হাতখরচের অন্য ব্যয় কাটছাঁট করছেন।

জামাল হুসাইন নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আগে প্রতিদিন বাইরে বের হয়ে বিকেলে নাস্তা করতাম। রাতে দুধ-ডিম খেতাম। সেগুলো এখন আর (খাওয়া) হয় না। খরচ কমাতেই বেশ কয়েকমাস হলো জিম ছেড়েছি। এমনকি পাঠ্যবই ছাড়া অন্য বই কেনাও বাদ দিয়েছি।

আরও পড়ুন: দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে অভিন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি

ছোটখাটো একটি চাকরি করে রাজধানীতে একটি মেসে থাকেন সালাউদ্দিন। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, কয়েকমাস আগে বেতনের টাকা বাড়তি থাকতো। সেটা পরিবারকে পাঠাতাম। এখন দিতে পারছি না। উল্টো প্রতি মাসে কলিগদের কাছ থেকে ধারদেনা করছি।

খরচ বাড়ছে হোস্টেলগুলোতেরাজধানীতে ব্যাচেলরদের জন্য সবচেয়ে বেশি হোস্টেল আছে ফার্মগেট এলাকায়। সেখানে গত কয়েকমাসে অধিকাংশ হোস্টেলের মাসিক চার্জ (ভাড়া ও অন্যান্য খরচ) বাড়ানো হয়েছে। আগে যেখানে ওই এলাকায় গড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকায় মাঝারি মানের একটি হোস্টেলের সিট মিলতো, সে সিটে থাকতে এখন ৮ থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে।

তেজকুনিপাড়া এলাকায় ব্যাচেলর পয়েন্টস হোস্টেলে ছয়টি ফ্ল্যাটে প্রায় ২০০ সিট রয়েছে। সেখানে আগে চার বেডের একটি রুমে সিট ভাড়া (থাকা ও খাওয়া) ছিল ৬ হাজার ৬৮০ টাকা, অক্টোবর থেকে যা ৮ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

ওই হোস্টেলের কর্ণধার শামসুদ্দিন হায়দার জাগো নিউজকে বলেন, হোস্টেল চার্জ বাড়ানো হয়েছে শুধু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে। আগের খরচে আমরা খাওয়াতে পারছি না। এর মধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ অন্যান্য খরচ বেড়েছে। সেজন্য বাধ্য হয়ে সমন্বয় করতে হচ্ছে।

ভালো নেই হোস্টেল মালিকরাওহোস্টেল মালিক মাজহারুল মনি জানান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পর থেকে হোস্টেল ব্যবসাতেও ভাটা পড়েছে। খরচ সমন্বয় করে চার্জ বাড়িয়েও স্বস্তি নেই তাদের। কারণ তাতে অনেকে সিট ছেড়ে দিচ্ছেন। অনেক বড় বড় হোস্টেলে আসন খালি রয়েছে।

আবার যেখানে খরচ সমন্বয়ে চার্জ না বাড়িয়ে সুযোগ-সুবিধা কমানো হচ্ছে, সেখানে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা না থাকায় কেউ এসে বেশিদিন থাকতে পারছেন না।

মনি বলেন, এখন আমরা লোকসান কাটাতে সিট ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ বাড়াচ্ছি। কিন্তু তাতে আরও বড় বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। হোস্টেল খালি হয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: শিক্ষা উপকরণেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব

ওই এলাকায় বর্ণালি ভিআইপি হোস্টেলের ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম বলেন, ৬০ সিটের মধ্যে প্রায় ২০টি খালি। প্রতিদিন কয়েকজন দেখতে আসেন। তবে সিট ভাড়া শুনে ফিরে যান। বর্তমানে যারা আছেন তাদের ভাড়া বাড়ানো হয়নি। সেটা বাড়ালে সবাই চলে যাবে।

দ্রব্যমূল্য ও ব্যাচেলদের সংকট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সবচেয়ে সংকটে পড়েছে নির্ধারিত আয়ের মানুষ। ব্যাচেলরদের মধ্যে এমন মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাদের ভোগাচ্ছে এ মূল্যস্ফীতি।

তিনি বলেন, হতদরিদ্রদের জন্যও সরকারের কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। তারা অন্যের কাছে হাতও পাততে পারেন। কিন্তু কঠিন হিসাবের মধ্যে থাকা মানুষগুলো কিছুই করতে পারেন না। চাপ কমাতে নিজেদের ব্যয় সংকোচন করতে করতে দিন দিন খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে চলে যান তারা।

এ অর্থনীতিবিদের পরামর্শ, এজন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এর বাইরে যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক, তাদের উচিত এ আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কর্মীদের বোনাসের মতো কিছু সহযোগিতা দেওয়া।

এনএইচ/কেএসআর/এএসএ/এমএস