পাবনার ঈশ্বরদী বেনারসি তাঁত শিল্পের সুখ্যাতি শত বছরের। ব্রিটিশ আমলে শহরের অবাঙালী অধ্যুষিত ফতেহ মোহাম্মদপুর এলাকায় গড়ে ওঠে এ শিল্প। দক্ষ কারিগরের নিখুঁত বুননের জন্য এখানকার শাড়ির ব্যাপক চাহিদা থাকা স্বত্বেও মুখ থুবড়ে পড়েছে এ শিল্প। পাশাপাশি দফায় দফায় সুতার দাম বৃদ্ধি ও শ্রমিক সংকটে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে বেনারসি কারখানা।
Advertisement
মালিকরা জানান, পাকিস্তান আমলে এখানে প্রায় ৪৫০টি বেনারসি তাঁত কারাখানা ছিল। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন প্রায় ৭ হাজার মানুষ। ২০১৮ সালেও এখানে ৩০০ থেকে ২৫০টি কারখানা ছিল। এখন মাত্র ৫০টি কারখানা চালু রয়েছে। ভারতীয় নিম্নমানের শাড়িতে দেশীয় বাজার সয়লাব ও দফায় দফায় সুতা, চুমকিসহ সব তাঁত সামগ্রীর দাম বাড়ায় লোকসানে পড়ে বেনারসি তাঁত শিল্প থেকে ধীরে ধীরে অনেকেই গুটিয়ে নিচ্ছেন।
ফতেহ মোহাম্মদপুর চেয়ারম্যান পাড়ার সানজিদা শাড়ি কারখানার স্বত্বাধিকারী মো. নাসিম উদ্দিন টুটুল বলেন, ৩০ বছর এ পেশায় আছি। বেনারসি তাঁতিতে এমন দুঃসময় আগে কখনো দেখিনি। ৩০০ কারখানা থেকে বন্ধ হতে হতে ৫০টিতে এসে ঠেকেছে। ২০২০ সালের শুরুতে শাড়ি তৈরির সুতা ছিল ২ হাজার টাকা বান্ডিল (সাড়ে চার কেজি)। আর এখন ৪ হাজার টাকা। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে সুতার দাম দ্বিগুণ। কিন্তু শাড়ির দাম এক টাকাও বাড়েনি। একটি সাধারণ জামদানি শাড়ি তৈরিতে এখন খরচ হয় ২৭০০ টাকা আর ২০২০ সালে খরচ হতো ১৯০০ টাকা। মাত্র দুই বছরে একটি শাড়ি তৈরিতে খরচ বেড়েছে ৮০০ টাকা। কিন্তু সেই শাড়ি এখনো ২৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সেলিম বেনারসির স্বত্বাধিকারী সেলিম হোসেন জানান, আমার কারখানার সাতটি তাঁতের মধ্যে চারটি বন্ধ। সুতা ও তানির দাম বাড়ার পাশাপাশি মজুরি বৃদ্ধির দাবি মেটাতে না পারায় কারিগর সংকটে পরতে হয়েছে। কারিগরদের একটি সাধারণ জামদানী শাড়ি তৈরি করতে সময় লাগে তিন দিন। শাড়ির মজুরি ১২০০ টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ৪০০ টাকা মজুরিতে কাজ করে তাদের সংসার চলে না। তাই কারিগররা এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে কারিগর সংকটের কারণে তাঁত বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
Advertisement
ফতেহ মোহাম্মদপুর বেনারসি পল্লীর জামান টেক্সটাইলের পরিচালক শরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ৩৪টি তাঁতের মধ্যে ১৬টি চালু আছে। বাকিগুলো কারিগর সংকটের কারণে বন্ধ। বেনারসি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সুতার দাম কমানোসহ দেশীয় বাজারে ভারতের নিম্নমানের শাড়ির প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
ঈশ্বরদী প্রাথমিক বেনারসি তাঁতি সমিতির সভাপতি ওয়াকিল আলম জাগো নিউজকে বলেন, এখানকার বেনারসি তাঁতের শাড়ি সবই হ্যান্ড লুম (হাতে বুনন করা হয়)। হ্যান্ড লুমে তৈরি শাড়ির কারুকাজ ও বুনন নিখুঁত হয়। একই সঙ্গে শাড়ি টেকসই ও গুণগতমান অত্যন্ত ভালো। ভারতীয় শাড়িগুলো পাওয়ার লুমে (মেশিনে) তৈরি। এখানকার একটি জামদানি শাড়ি ৩ হাজার টাকার কমে দোকানিরা বিক্রি করতে পারবে না। কিন্তু ভারতের লুম পাওয়ারের তৈরি শাড়ি ১৫০০ টাকায় পাওয়া যায়। দামে সস্তা পেয়ে ক্রেতারা ভারতের জামদানি কিনছে। আর যারা প্রকৃত জামদানি চিনে বা জানে তারা কখনোই মেশিনে তৈরি ভারতীয় জামদানি কিনবে না।
তিনি আরও বলেন, মজুরি কম হওয়ায় এ পেশায় নতুন প্রজন্মের আর কেউ আসতে চায় না। নতুন কারিগর তৈরি হচ্ছে না। শ্রমিক সংকটের কারণে আমার নিজের ১০টি তাঁত বন্ধ রয়েছে। বেনারসি তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে সুতার দাম কমানো, ভারতীয় জামদানি, কাতান শাড়ি আমদানি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি কারখানার মালিকদের পর্যাপ্ত সুদমুক্ত ঋণ দিতে হবে। তা নাহলে এ বেনারসি তাঁত শিল্প ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খন্দকার ওবাইদুর রহমান জিলানী জাগো নিউজকে বলেন, ঈশ্বরদীর সম্ভাবনাময় বেনারসি তাঁত শিল্পকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে সরকার ২০০৪ সালে ফতেহ মোহাম্মদপুর এলাকায় বেনারসি পল্লী গড়ে তোলে। এখানকার বেনারসি তাঁত মালিকদের মধ্যে ৯০টি প্লট বরাদ্দ দেয়। বর্তমানে এখানে ছয়টি বেনারসি কারখানা চালু আছে। আরও কয়েকটি চালুর অপেক্ষায়।
তিনি আরও বলেন, তাত বোর্ডের তালিকায় ২০৬ জন নিবন্ধিত বেনারসি তাঁতির নাম রয়েছে। ২০২২ সালে ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে সরকার তাদের ৪০ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়।
Advertisement
এসজে/জিকেএস