ফিচার

বাংলার গৃহবধূ যখন সিরিয়াল কিলার

দিনের আলো নিভে সন্ধ্যা গড়ালেই লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেলে এক চাপা উত্তেজনা কাজ করত। চারদিক থমথমে, জমাট বাঁধা অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসত এক আততায়ী। যার হাতে একের পর এক মানুষ মারা গেছে নির্মমভাবে। বিশেষ করে নারীরা। তার মধ্যে বেশির ভাগই আবার ছিল পতিতা। সময়টা ১৮ শতাব্দীর শেষের দিকে। এমনই এক দুঃসহ সময় পার করেছে লন্ডনবাসী।

Advertisement

জ্যাক দি রিপার তকমা পাওয়া সেই সিরিয়াল কিলারের কূল কিনারা করতে পারেনি কেউ। এমনকি আজ পর্যন্ত জানা যায়নি সেই ব্যক্তি আসলে কে ছিল। যদিও সন্দেহের বশে পুলিশ অনেককেই জ্যাক দ্য রিপারের তকমা দিয়েছে। বিনা দোষে হয়তো অনেকে শাস্তিও পেয়েছে। সে যাই হোক, পরবর্তিতে বিশ্বে আরও অনেক সিরিয়াল কিলার এসেছে। যারা ইতিহাসের এক অন্ধকার জগত তৈরি করে রেখে গেছে।

বিকৃত মস্তিষ্কের কিছু মানুষের কারণে মারা গেছে হাজার হাজার মানুষ। কেউ এই কাজ করেছে নেশায়, কেউবা পেশা হিসেবেই নিয়েছিল একে। তবে বেশিরভাগ সিরিয়াল কিলারই ছিল ঠান্ডা মাথার খুনি। বিশ্বের প্রথম সিরিয়াল কিলার হিসেবে মনে করা হয় জ্যাক দ্য রিপারকেই। তবে বাংলায় তারও প্রায় বছর আটেক আগেই এক সিরিয়াল কিলার ছিলেন। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে তিনি ছিলেন একজন নারী।

সে আমলে একজন নারীর ঘর থেকে বের হওয়াই যেখানে ছিল এক কঠিন কাজ। সেখানে এই নারীর কথা শুনে অনেকেই অবাক হবেন। তারপর সাধারণ এক গৃহবধূ থেকে বনে গিয়েছিলেন সিরিয়াল কিলার। তাকেই বিশ্বের প্রথম ও বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার হিসেবেই ধরা হয়। যদিও জ্যাক দি রিপার বা জিল দ্য রাইয়ের ভিড়ে ইতিহাসে প্রায় হারিয়েই গেছেন এই নারী।

Advertisement

তার নাম ত্রৈলোক্যতারিণী দেবী। দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখা দারোগার দপ্তর থেকে জানা যায় তারিণীর এই জীবন সম্পর্কে। পুলিশের পাশাপাশি সেই সময়ের একজন স্বনামধন্য লেখক হিসেবে পরিচিতি ছিলেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। ১৮৭৮-১৯১১ সাল পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন পুলিশ বিভাগে। তার প্রকাশিত বই ‘দারোগার দপ্তর’ থেকেই জানা যায় বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার তারিণীর সম্পর্কে। পরবর্তীকালে দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের ‘বাবু ও বারবনিতা’ বইটিতে বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার হিসেবে একাধিকবার উঠে এসেছে তারিণীর নাম।

ভারতের বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম তারিণীর। আর দশটা গ্রামের মতোই এখানকার চিত্র। ঘরের নারী সদস্যরা ব্যস্ত ঘর সংসার আর সন্তান লালন পালনে। আর বাড়ির পুরুষেরা বেশিরভাগই ব্যস্ত থাকেন চাষের কাজে। এশিয়া তথা বাংলার খুবই নিতান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনের চিত্র এটি। এই গ্রামেই বসবাস করত ত্রৈলোক্যতারিণী। অন্যদের মতো তারিণীর বাবাও সাধারণ ভাগচাষি। সংস্কারের আলো তখনও সেভাবে ছুঁতে পারেনি হিন্দু সমাজকে।

সমাজে পুরোদমে চলছে বাল্যবিবাহ। ১৩ বছর বয়সে ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধের সঙ্গে বিয়ে হয় তারিণীর। সেই সময় অনুযায়ী বিয়ের বয়স পেরিয়ে গিয়েছিল তার। তবে সংসার করা হয়নি কিশোরী বধূ তারিণীর। সতীনের ঘরে যাওয়া হয়নি। স্বামীর সঙ্গেও দেখা হয়েছিল মাত্র একবার। বাবার বাড়িতেই রয়ে গেলেন তারিণী। ফলে সময়ের নিয়মে একসময় শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ কমতে থাকে। স্বামী কিছুদিন পর মারা গেলে শ্বশুরবাড়ির দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় তার।

তবে সবে যৌবনে পা রাখা মেয়েটি জড়িয়ে যায় নতুন এক সম্পর্কে। গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে রাতের অন্ধকারে হঠাৎ করেই গ্রাম থেকে পালিয়ে যায় তারিণী। এরপরই তারিণীর ভোলবদল। বিয়ের পরেও প্রেমের সম্পর্ক, গ্রামে কানাকানির সূত্রপাত ঘটেছিল আগেই। এতে তারিণীর জন্য তার বাপের বাড়ির দরজাও চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে গেল।

Advertisement

তাতে কি? যার হাত ধরে পালিয়েছে যে তো ভালোবাসে তাকে। সুখে রাখার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। তবে তারিণীকে স্ত্রীর মর্যাদা শেষ পর্যন্ত দিতে পারেনি স্বামী। দুজনে কলকাতার সোনাগাছি অঞ্চলে ভাড়া থাকতে শুরু করে তারা। বেশ ভালোই দিন যাচ্ছিল তাদের। তবে তারিণী সেই যুবকের সঙ্গে থাকতে চান না। নিজের মতো করে জীবনযাপন করার ইচ্ছা তার। সোনাগাছিতে থাকতে শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় তারিণীর প্রথম প্রেমিকের। এই ঘটনায় সন্দেহের তীর যায় তারিণীর দিকেই।

এর মধ্যেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করে পতিতাবৃত্তি। তবে অনেকে আবার বলেন প্রেমিকই নাকি তাকে পতিতাপল্লীতে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এই পতিতাবৃত্তির সূত্রেই তার পরিচয় ঘটল অপরাধ জগতের মাথাদের সঙ্গে তারিণীরে পদার্পণ ঘটল অপরাধ জগতের বৃত্তে। পুলিশও শুরু করল তদন্ত। কিছুদিনের মধ্যেই আটক করা হয় তারিণীকে। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায় সে। সেই শুরু। তারপর দিন যত এগিয়েছে, ততই লম্বা হয়েছে খুনের লিস্ট। এরই মধ্যে একের পর এক পুরুষ এসেছে তারিণীর জীবনে।

সেসব পুরুষ সঙ্গীদের সাহায্যেই ধনী বাড়ির মেয়েদের শিকারে পরিণত করত তারিণী। কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় পাঁচটি খুন করে ফেলে। কয়েকদিনের ব্যবধানে উধাও হয়ে গেলেন পাঁচজন নারী। সবাই বেশ ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যা ছিলেন। টনক নড়ে পুলিশের। শুরু হল তদন্ত। তদন্তের শুরুতেই অদ্ভুত এক তথ্য উঠে এলো পুলিশের হাতে। তারা জানতে পারল, পাঁচটি মৃত্যুর প্রত্যেকটি হয়েছে মানিকতলা এলাকায়। এমনকি পাঁচটি মৃত্যুর প্রতিটির ধরন একই।

প্রত্যেকের মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে। কিছুদিনের চেষ্টায় পুলিশের জালে ধরা পড়ল তারিণী। পুলিশি তদন্ত শেষে উঠে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। শুধু গয়নার লোভেই একের পর এক খুন করে গেছে ত্রৈলোক্যতারিণী। এই ব্যাপারে তার মূল ঘাঁটি ছিল মানিকতলা এলাকার একটি পরিত্যক্ত বাগানবাড়ি। এখানেই বিভিন্ন ছলনায় তার শিকারদের ডেকে এনে গয়না লুঠ করে তারপর তাদের পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করত।

আর সেই কাজটি করার সময়ই একজন দেখে ফেলে তাকে। তারিণীকে গ্রেফতারের পিছনে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। জেরার পর তারিণী স্বীকার করেছিল, পেট চালানোর জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে তাকে এই উপায় অবলম্বন করতে হয়েছে। এর আগেও বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন চুরি এবং প্রেমিকের হত্যার ঘটনায় গ্রেফতা হয়েছিল তারিণী। কিন্তু প্রতিবারই প্রমাণ অথবা সাক্ষীর অভাবে বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। কিন্তু এবার পুলিশের হাতে ছিল অকাট্য প্রমাণ।

এসব ঘটনায় প্রথমবার তাকে গ্রেফতা করা হলে প্রিয়নাথ মুক্তি দেন ত্রৈলোক্যতারিণীকে। এটি ছিল প্রিয়নাথের একটি ফাঁদ। এরপর পুলিশ গ্রেফতা করেন ত্রৈলোক্যতারিণীর পালিত ছেলে হরিকে। রাজসাক্ষী করেন ত্রৈলোক্যতারিণীর সঙ্গী ষড়যন্ত্রীকে। এমনভাবে ঘটনাক্রম সাজান, যাতে মনে হয় হরিই খুনি। সবাই এমনভাবে সাক্ষ্য দেন, যেন হরি যে ঘটনায় জড়িত তা নিয়ে তারা নিশ্চিত। শেষে প্রিয়নাথের সাজানো ফাঁদে ধরা দিতে বাধ্য হয় ত্রৈলোক্যতারিণী। ছেলেকে বাঁচাতে অপরাধ স্বীকার করে নেন তিনি। নিজের ঘরের লুকোনো জায়গা থেকে বার করে দেয় খুনের পরে নিহত তরুণীর লুঠ করা গয়না। সব অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তারিণীকে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।

ইতিহাসবিদদের মতে, বাল্যবিবাহ, শ্বশুরবাড়ির অবেহেলায় কি আড়াল থেকে পশ্রয় দিয়েছিল তারিণীকে? তার অজান্তেই তার অবচেতন মনে হয়তো রেখাপাত করে গিয়েছিল একের পর এক লাঞ্ছনার ঘটনা, যা তাকে পরবর্তীকালে করে তুলেছে বাংলার অন্যতম নৃশংস সিরিয়াল কিলার! সূত্র: স্ক্রোল ইন

কেএসকে/এমএস