মতামত

রাজনীতিতে দুঃসময়ের কাণ্ডারি

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পল্টন ময়দানে জনসভা করতে দেয়া হতোনা। তাই বায়তুল মোকারম মসজিদের দক্ষিণ গেটের সামনের রাস্তায় জনসভা হতো। সভার মঞ্চ তৈরি হতো তখনকার স্টেডিয়ামের টিকেট কাউন্টার ঘরের ছাদে। সভাস্থলের সামনে, পশ্চিম দিকে জিরোপয়েন্ট, ওদিকে গুলিস্তান পর্যন্ত মানুষের ঢল নেমে যেতো।

Advertisement

তখন বিটিভিতে শুধু সরকারের খবর প্রচার হতো। গুটি কয়েক সংবাদপত্র,তারাও বিরোধী দলের কোনো কথা ছাপতো না। বঙ্গবন্ধুর নাম ছবি কোথাও খুঁজে পাওয়া যেতো না। নেতারা সব জেলবন্দি। তাই জনসভায় মানুষ শুনতে আসতো দেশে কি হচ্ছে, কি হবে।

আওয়ামী লীগের জনসভা মানেই জনতার ঢল। আর সেই সভার প্রধান আকর্ষণ সাজেদা চৌধুরীর ভাষণ। আব্দুল মালেক উকিল, বেগম জহুরা তাজউদ্দিন এদের বক্তব্য শেষে সাজেদা চৌধুরীর নাম ঘোষণা হতো। জনসভায় আগতরা নড়ে চড়ে উঠতেন।

তিনি সাধারণ মানুষের ভাষায় দরাজ কণ্ঠে কথা বলতেন। গুছিয়ে, বুঝিয়ে যুক্তিদিয়ে ইতিহাস ব্যাখ্যা করে ভাষণ দিতেন। মানুষ তার কথায় কখনো চোখের পানি মুছতো, কখনও শ্লোগানে গর্জে উঠতো। তিনি গ্রামে গ্রমে গিয়ে তার দলের নেতা-কর্মীদের ঘরের বাইরে এনেছিলেন। তাদের সাহস জুগিয়েছিলেন। নেতা-কর্মীদের জন্য অসংখ্য মামলা লড়েছেন।

Advertisement

১৯৫৬ সাল থেকে সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ১৯৬৯ , ১৯৭৫ সময়কালে তিনি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন কলকাতা গোবরা নার্সিং ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

১৯৭২-১৯৭৫ সময়কালে বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ডের পরিচালক, ১৯৭২-১৯৭৬ সময়কালে বাংলাদেশ গার্ল গাইডের ন্যাশনাল কমিশনার এবং ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রদত্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বও তিনি পালন করছেন।

১৯৩৫ সালের ৮ মে মাগুরা জেলায় মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তার পিতার নাম সৈয়দ শাহ হামিদ উল্লাহ এবং মাতা সৈয়দা আছিয়া খাতুন। শিক্ষাজীবনে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তার স্বামী রাজনীতিবিদ এবং সমাজকর্মী গোলাম আকবর চৌধুরী। ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর তার স্বামী মৃত্যুবরণ করেন।

Advertisement

গোলাম আকবর চৌধুরীর জন্মস্থান চট্টগ্রামের হাটহাজারি থানার মাদার্শা গ্রামে । জন্ম ১৯৩১ সালের ১ সেপ্টেম্বর । ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন । ১৯৪৮-এ ছাত্রলীগে যাযোগদান । ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামে তার সভাপতিত্বে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন । পরবর্তী বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ ।

জনসভায় বকৃতৃতারত সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভের পর তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগরে অবস্থান । সে-সময় মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের অবৈতনিক সদস্য। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলের নেপথ্য নীতি-নির্ধারক। ছাত্রজীবনে রাজনীতির পাশাপাশি আমদানিরফতানি ব্যবসা। তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীমা সংগঠক। স্বাধীনতার পর টিসিবির পরিচালক। বঙ্গবন্ধুহত্যাকাণ্ডের পর ঘাতক সরকার কর্তৃক চাকুরিচ্যুতি। ১৯৫৮ সালে বাংলাদেশে লায়ন্স আন্দোলনের সূচনাকারী।

বাংলাদেশের প্রথম লায়ন ‘চট্টগ্রাম লায়ন্স ক্লাব’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। ১৯৫৪ সালে সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে। জীবন সঙ্গী হিসেবে সাজেদা চৌধুরী এমন একজন মানুষকে পেয়েছিলেন যার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল মানবতার জন্য, দেশের জন্য।

সাজেদা চৌধুরী গত নবম ও দশম সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে একাদশ জাতীয় সংসদের উপনেতা পদে তার বহাল থাকা-না থাকা নিয়ে আলোচনা চলছিল। তবে সবকিছুর অবসান করে ফের জাতীয় সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।

একাদশ জাতীয় সংসদে তিনি ফরিদপুরের কৃষাণপুর ইউনিয়ন (ফরিদপুর-২; নগরকান্দা, সালথা ও সদরপুর) থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জয়ী হন। দশম সাধারণ নির্বাচনেও তিনি এ অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হন।

আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে, স্বাধীনতা সংগ্রামে, স্বাধীনতা যুদ্ধে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ১৯৮১ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তার সাথে সবসময় ছায়ার মতো ছিলেন বেগম সাজেদা চৌধুরী।

এছাড়া ২০০৭-২০০৮ সালে যখন অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তখন বেগম সাজেদা চৌধুরী নেত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের ইতিহাস তো বটেই, বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে হলে বেগম সাজেদা চৌধুরীর কথা আসবে বারবার ।তিনি ১৯৭৪ সালে গ্রামীণ উন্নয়ন ও শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য ইউনেস্কো ফেলোশিপপ্রাপ্ত হন এবং একই সময়ে তিনি বাংলাদেশ গার্ল-গাইড এসোসিয়েশনের জাতীয় কমিশনার হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানসূচক সনদ সিলভার এলিফ্যান্ট পদক লাভ করেন। তিনি ২০০০ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট কর্তৃক বর্ষসেরা নারী নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।

সাজেদা চৌধুরী ১৯৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯১ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে টেকনোক্র্যাট কোটায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়।

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুঃসময়ের কাণ্ডারি। সারাটা জীবন দলের সব সংকটে নিজেকে সামনের কাতারে রেখেছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থেকেছেন কয়েকবার। কোন রক্তচক্ষুকে কখনই পরোয়া করেননি। আজকের রাজনীতিকদের অনেক কিছু শেখার আছে তার জীবনী থেকে।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/জিকেএস