যে কোনো জরুরি অবস্থায় পথশিশুরা আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে যেখানে তারা আশ্রয় নিতো সেই জায়গাও হারাতে হয়েছিল তাদের। পথশিশুরা করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে ধারণা করে সব জায়গার দারোয়ানরা তাদের লঞ্চঘাট, পথঘাট, ফুটপাথ, রেলস্টেশন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
Advertisement
কনসোর্টিয়াম ফর স্ট্রিট চিলড্রেন ও কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশনের যৌথ সহায়তায় গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি পরিচালিত গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য।
বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দুপুর ২টায় ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে ‘পথশিশুদের বঞ্চনা ও অধিকার’ বিষয়ক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে পথশিশুদের নিয়ে সামাজিক জরিপের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে তৈরি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাকসুদ ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন অধ্যাপক মেঘনা গুহঠাকুরতা। সেমিনারের শুরুতে কনসোর্টিয়াম ফর স্ট্রিট চিলড্রেনের স্টিফেন কলিন্স উপস্থিত সবাইকে স্বাগত জানান এবং সেমিনারের পটভূমি বর্ণনা করেন।
Advertisement
গবেষণায় দেখা যায়, যদিও জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ, জাতীয় শিশু নীতি ২০১১, শিশু শ্রম নির্মূল নীতি ২০১০ এবং শিশু আইন ২০১৩ ইত্যাদির প্রতি বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু পথশিশুরা নিয়মিত তাদের অধিকার লঙ্ঘনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছে।
এ গবেষণায় দেখা যায়, কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া বাংলাদেশের পথশিশুরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও বাংলাদেশ সরকারের দীর্ঘ পরিকল্পনা (২০২০-২৫) বাস্তবায়নের অগ্রগতিতে পিছিয়ে আছে।
পথশিশুদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা খুবই সাধারণ। প্রায় ১৩ শতাংশ শিশুরই কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতা দেখা গিয়েছে। শতকরা ৬০ ভাগ শিশু গত তিনমাসে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। এরই সঙ্গে অন্যান্য সাধারণ লক্ষণ যেমন- কাশি (৩৫ শতাংশ), সর্দি (২৬ শতাংশ), মাথাব্যাথা (২৫ শতাংশ) ও পেটে ব্যাথা (২২ শতাংশ) রোগে ভুগছে।
৮৫ শতাংশ শিশু চিকিৎসা বিষয়ক উপদেশ বা চিকিৎসা পেয়েছে। এছাড়া ৬২ শতাংশ পথশিশু গণশৌচাগার ব্যবহার করে (৭ শতাংশ অন্যান্য জায়গার শৌচাগারে প্রবেশ করতে পারে) এবং বাকিরা ড্রেন বা খোলা জায়গা ব্যবহার করে।
Advertisement
ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে ‘পথশিশুদের বঞ্চনা ও অধিকার’ বিষয়ক সেমিনার
গবেষণায় দেখা যায়, ২০২০ এর প্রাথমিক লকডাউনে ৭২ শতাংশ পথশিশু খাদ্যের অভাবে ভুগেছে। আবার ৬৫ শতাংশ শিশু তাদের কাজ হারিয়েছে, যেটার উপর তারা নির্ভর করে তারা তাদের প্রয়োজন মেটাতো। এরমধ্যে ৫৩ শতাংশ পথশিশু তাদের থাকার জায়গা বা যেখানে তারা সাধারণত ঘুমাতো সেগুলো হারিয়েছে। তাদের জীবনের এমন দুরবস্থার কারণে অনেক শিশুই করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সতর্কতা উপদেশ মেনে চলতে পারেনি।
‘প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩১ শতাংশ) শিশু একা থাকে এবং ১২ শতাংশ শিশু বন্ধুদের সঙ্গে বা রাস্তায় অন্যদের সঙ্গে থাকে। ১১ শতাংশ শিশু অনাথ, যাদের কোনো অভিভাবকই বেঁচে নেই। এরমধ্যে ৩৫ শতাংশ জানে যে তাদের মা অথবা বাবা মারা গিয়েছে। প্রায় অর্ধেক (৪৪ শতাংশ) শিশু রাতে ঘুমানোর জন্য বস্তির বাড়িতে ফেরত যায়। বাকিরা পরিবহন টার্মিনাল, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, যানবাহন, পার্ক এবং রাস্তার পাশে ফুটপাতে ঘুমাতে যায় ।
বেশিরভাগ পথশিশু প্রতিদিন গড়ে ১০ ঘণ্টা পেটের তাগিদে কাজ করে অথবা টাকার জন্য ভিক্ষা করে। ৩৫ শতাংশ ভিক্ষা করার কথা বলে। অন্যদিকে ৪২ শতাংশ রাস্তায় জিনিসপত্র বিক্রি করে। সিংহভাগ পথশিশু (৯৮.৫ শতাংশ) প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করছে না।
অন্য সব শিশুর মতো পথশিশুদের সব বৈষম্য, অবহেলা এবং নিপীড়নসহ সব ধরনের সহিংসতা থেকে মুক্তির অধিকার রয়েছে। তবুও ঢাকা ও বরিশালের পথশিশুদের জন্য সহিংসতা ও নির্যাতন খুব সাধারণ ঘটনা। তিন-চতুর্থাংশেরও অধিক (৭৯ শতাংশ) শিশু জীবনের কোনো এক পর্যায়ে মানসিক (৭৬ শতাংশ), শারীরিক (৬২ শতাংশ) অথবা যৌন (রিপোর্ট অনুযায়ী ৫ শতাংশ- কিন্তু বাস্তবে আরও বেশি হতে পারে) সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছে।
এসব নির্যাতনের শিকার অর্ধেকের বেশি শিশু বলেছে যে অপরাধীর সঙ্গে তারা রাস্তায়, পার্কে বা কোনো খোলা জায়গায় নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছে। অন্যরা বলেছে- ট্রেনে অথবা গণপরিবহনে তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের পথশিশুদের শিক্ষা, খাদ্য এবং সহিংসতা থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার নিয়মিত লঙ্ঘিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারের দায়িত্ব এটা নিশ্চিত করা।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বাংলাদেশ সরকারের সব পথশিশুদের অধিকার দেওয়ার এখন সক্ষমতা আছে উল্লেখ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন একটি শিশুও আর পথে থাকবে না। তাই আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা ও জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের জন্য সবাইকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে এবং তাদের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ যোগানদানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা আরও বিশেষভাবে আবেদন জানাচ্ছি, মেয়ে পথশিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি যেন অতি জরুরিভাবে সবাই বিবেচনা করি এই সংকটের সমাধানে সবাই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করি।
সেমিনারে ঢাকা আহসানিয়া মিশনের মোহাম্মদ জুলফিকার মতিন পথশিশুদের অধিকার বাস্তবায়নে সরকারের আন্তঃবিভাগীয় সমন্বিত উদ্যোগের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। লিডোর আরিফুল ইসলাম ও গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির কর্মসূচি পরিচালক খন্দকার রিয়াজ হোসেন পথশিশুদের টাস্কফোর্স সম্বন্ধে এবং গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির কর্মসূচি ব্যবস্থাপক সাবরিনা আলমগীর পথশিশুদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
পথশিশুদের মানবিক উন্নয়ন ও অধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য বরিশাল সমাজসেবা কার্যালয়ে উপ-পরিচালক মো. এ কে এম আখতারুজ্জামানকে সম্মাননা দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে এশিয়া মহাদেশের আঞ্চলিক প্রতিনিধি হিসেবে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও আফগানিস্তান থেকে কনসোর্টিয়াম ফর স্ট্রিট চিলড্রেনের বিভিন্ন দেশের নেটওয়ার্ক সদস্য প্রতিষ্ঠান ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেমিনারে যোগ দেন।
এএএম/জেএস/জিকেএস