আবারো অস্থির হয়ে উঠেছে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম। তিন দিনের ব্যবধানে খুচরা বাজারে ডিমের দাম ডজনপ্রতি ৩০ টাকা বেড়ে এখন ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
Advertisement
বাজারে ডিমের দাম গত মাসের মাঝামাঝি একদফা অস্থিতিশীল ছিল। সে সময় ডজন ১৬০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এর আগে কখনো ডিমের দামের এতটা বৃদ্ধি দেখা যায়নি, দামও এতটা ওঠেনি। এখন আবার সেই পথে হাঁটছে পণ্যটি।
ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলছেন, টানা বৃষ্টিতে সরবরাহ সংকটে এমন হয়েছে। আবার কেউ বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মুরগির খাদ্যের উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়া, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া দাম বৃদ্ধির বড় কারণ। এসব কারণে যখন গত মাসে ডিমের দাম বেড়েছে, সে সময় প্রশাসনের চাপে বাধ্য হয়ে দাম কমেছিল। কিন্তু সমস্যা সমাধান না হওয়াতে আবারো বাড়ছে।
আরও পড়ুন: ডিম ব্যবসায়ীদের আটকে রাখলেন ভোক্তার মহাপরিচালক
Advertisement
এরমধ্যে কেউ আবার বলছে, ডিম নিয়ে কি হচ্ছে সেটা এখনো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। মধ্যস্বত্বভোগীরা আবারো ডিম নিয়ে খেলা শুরু করেছে। তবে ডিমের দাম যতটা বেড়েছে, ততটা বাড়ার কথা নয় বলেও অনেকে স্বীকার করেছেন।
রাজধানীর খুচরা বাজার রামপুরা, মালিবাগ, শান্তিনগর ও এসব এলাকার বিভিন্ন মহল্লার দোকান ঘুরে দেখা গেছে, খুচরায় প্রতিহালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। ডজন নিলে ১৫০ টাকা। যদিও কিছু কিছু বাজারে ৫ থেকে ১০ টাকা ডজনে কম নিতেও দেখা গেছে। তবে সে সংখ্যা কম।
রামপুরা বাজারে ডিম বিক্রেতা ইয়াছিন হোসেন বলেন, গত রাত (বুধবার) থেকে ডিম হুট করে বেড়েছে। তার আগেও দুদিন দাম বেড়েছে। তবে সেটা ৫/৭ টাকা। শেষ বৃহস্পতিবার সকালে পাইকারিতে দাম ১৪০ টাকা ঠেকেছে।
তিনি বলেন, মঙ্গলবারেও তিনি প্রতি একশো ডিম ১০৫০ টাকায় কিনেছেন। যা এখন ১১৭০ টাকা। এ হিসেবে প্রতিটি ডিমের দাম পড়ছে ১১ টাকা ৭০ পয়সা। যা অন্যান্য খরচ মিলে এখন সাড়ে ১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
Advertisement
তিনি বলেন, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে ডিমের সরবরাহ কম। সেজন্য দাম বেড়েছে।
মালিবাগ বিসমিল্লাহ স্টোরের মালিক জাফর উদ্দিন বলেন, আমরা নির্ধারিত একজন আড়তদারের কাছ থেকে ডিম কিনি। প্রতিদিন তারা ডিম দিয়ে যায়। গত কয়েকদিন ধরে তারা প্রতিদিন দাম বাড়াচ্ছে। আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে ৫০ টাকা হালি বিক্রি করতে বলে গেছে।
খামারিরা দুষছেন বড় ব্যবসায়ীদের-ফাইল ছবি
তিনি বলেন, সে হিসেবে তিন দিনের ব্যবধানে প্রতি ডিমের দাম প্রায় ৩ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে আগের সপ্তাহের ১২০ টাকার ডিম এখন ১৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।
তেঁজগাও আরতে ডিমের পাইকার ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন বলেন, চলতি সপ্তাহের হুট করে আবারো ডিম অস্থিতিশীল হয়েছে। গ্রামের মোকাম থেকে সরবরাহ কম। সেজন্য দাম বাড়ছে।
আরও পড়ুন: ডিম সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলা করবে ভোক্তা অধিকার
এদিকে ডিম উৎপাদনকারী সমিতির সভাপতি তাহের আহমেদ সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, খামারে ডিমের দাম বাড়েনি। উৎপাদনও কমেনি। কিন্তু আমরা শুনেছি পাইকারি বাজারে ১৩৫ টাকা ডজন বিক্রি হচ্ছে। যা দুদিন আগে ১২০ টাকা ছিল।
তিনি বলেন, আমরা ডিম উৎপাদন করলেও দাম নির্ধারণ করতে পারি না। আমরা তো এক টাকাও বাড়তি পাচ্ছি না। আড়তদার আর বড় বড় কোম্পানি সিন্ডিকেট করছে। তারা দিনে ৫ লাখ ডিম উৎপাদন করে। ২ টাকা দাম বাড়াতে পারলে দিনে ১০ লাখ লাভ করেন। তারাই দাম বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ঢাকার ডিমের আড়তদারদের সংগঠন তেজগাঁও বহুমুখী সমবায় সমিতির একজন প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিদিন সকালে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা দাম নির্ধারণ করেন। সেই দাম আমলে নিয়ে পাইকারি বাজারে দাম নির্ধারণ হয়। গত মাসে যারা ডিমের দাম অস্থিতিশীল করেছিল, তারাই এখন করছে। সে সময় আমরা সরকারের বিভিন্ন মহলকে সেসব কোম্পানির নাম জানিয়েছি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এখনো।
আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী ও উৎপাদকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশ কয়েক মাস ধরে মুরগির খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ডিমের দাম বাড়ছিল। আবার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়ে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ডিমের দাম কিছুটা বেড়েছে। তাতে গত মাসে ডিমের বাজার অস্থিতিশীল হয়। তবে তখন এসব কারণকে পুঁজি করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ফায়দা করেছে। তারা আবারও সক্রিয়। কিন্তু যেভাবে ডিমের দাম বাড়ছে সেটা হওয়া উচিত নয়।
কিছুদিন আগেও অস্থির ছিল ডিমের বাজার-ফাইল ছবি
তারা এও বলেন, দীর্ঘদিন ডিমের দাম কম থাকায় ক্ষতির মুখে পড়ে ছোট ছোট অনেক হ্যাচারি বন্ধ হয়ে গেছে। হ্যাচারি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে মুরগির উৎপাদন কমে গেছে। আর সে জায়গা দখলে নিচ্ছে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো। তারা সহজে ডিমের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। তাদের জন্য এ অস্থিরতা।
এদিকে গত মাসে যখন ডিমের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছিল সে সময় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ডিম, ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির দাম বাড়িয়ে ভোক্তা ও ক্ষুদ্র খামারিদের কাছ থেকে ৫২০ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে পোলট্রি খাতের সিন্ডিকেট বলে অভিযোগ করেন সাধারণ খামারিরা। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত রয়েছে পোল্ট্রি খাতের কর্পোরেট ১০-১২টি দেশি-বিদেশি কোম্পানি সংবাদ সম্মেলন করেও এমন তথ্য জানানো হয়।
আরও পড়ুন: বেশি দামে ডিম বিক্রি, জরিমানা সাড়ে ৪ লাখ টাকা
পরবর্তীতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন অভিযানে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ডিমের দামে সিন্ডিকেটের প্রমাণ মেলে। কাজী ফার্মসের বিক্রয় কেন্দ্রে ডিমের দাম এক রাতে ৩ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করার তথ্য পাওয়া যায় সেই অভিযানে। এরপর ওইসব কোম্পানির সঙ্গে বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি প্রতিবেদন দেয় ভোক্তা অধিদপ্তর। তবে এরপর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি।
এদিকে ওই সময় প্রশাসনের চাপাচাপি ও চাহিদা পড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে ডিমের দাম কমাতে হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেন কয়েকজন খামারি।
তারা বলেন, পোলট্রি খাত এখন ধ্বংসের মুখে। প্রকৃতপক্ষে ডিমে তারা লোকসান করছেন। ফলে ডিমের দাম কিছুটা সমন্বয় করা প্রয়োজন। জোর করে ডিমের দাম কমিয়ে রাখার চেষ্টার কারণে বারবার বাজার অস্থিতিশীল হচ্ছে।
এনএইচ/এসএইচএস/জেআইএম