খুলনা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা রূপসা নদী পার হলেই রূপসা উপজেলা। বছরে নির্দিষ্ট সময়ে কিছু এলাকায় ধান উৎপাদন হলেও লবণাক্ততার কারণে বাকি সময়টা অনাবাদী থেকে যায় বিপুল পরিমাণ জমি। নদী পরিবেশষ্টিত হওয়ায় লবণাক্ততার পরিমাণটাও অনেক বেশি থাকে সবসময়। সেই লবণাক্ততাকে দূর করে মৌসুম ছাড়া তরমুজসহ বিভিন্ন সবজি উৎপাদনে ঝুঁকেছেন এখানকার কৃষকরা। একদিকে ঘেরে মাছ চাষ অন্যদিকে ভেড়িতে (আইলে) নানা ধরনের সবজি উৎপাদনসহ কৃষকরা ঝুঁকছেন মৌসুম ছাড়া তরমুজ চাষে। প্রথম দিকে সফলতার মুখ না দেখতে পারলেও ক্রমেই তারা সফলতার পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছেন। উপজেলার জাবুসাসহ আরও বেশকিছু এলাকার কৃষকরা এখন আর বৃষ্টির জন্য অপেক্ষায় না থেকে স্বল্প খরচে তরমুজ উৎপাদনে ঝুঁকেছেন।
Advertisement
কৃষকরা বলছেন, সবজির চেয়ে তরমুজ উৎপাদন ঝুঁকিমুক্ত এবং লাভ বেশি হওয়ায় বর্তমানে রঙিন তরমুজের চাষে ঝুঁকেছেন কৃষকরা।
রূপসা উপজেলার জাবুসা উত্তরপাড়ার কৃষক মো. হাফিজ শেখ বলেন, তার দশ বিঘা জমির ঘেরের ভেড়িতে ঢ্যাঁড়শ, লালশাক, পুঁইশাক, সিম, বরবটি, লাউয়ের বীজ বপন করেন। ফলনও মোটামুটি ভালো পেয়েছেন। কিন্তু ভেড়ির জমি আরও বেশি পরিমাণে ব্যবহারের জন্য তিনি উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী বাহারি তরমুজের চাষ করেন।
এই কৃষক বলেন, লবণাক্ততার কারণে প্রথম দিকে ফলন খুব ভালো না হলেও এখন মৌসুম ছাড়া তরমুজ বিক্রি করে তিনি বেশ লাভবান হবেন। মৌসুম ছাড়া তরমুজ ভালো হওয়ায় আবারও বীজ বপনের জন্য জমি প্রস্তুতও করেছেন তিনি।
Advertisement
কৃষি অফিসের অনুপ্রেরণায় ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে খুলনা কৃষি অঞ্চলের জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্প হতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবছরই প্রথম তরমুজ চাষ করেন। প্রকল্প হতে বীজ, সার ও অন্যান্য উপকরণ সহায়তা পেয়েছেন। তার তরমুজ ক্ষেতের মাচায় ঝুলছে বাহারি রঙের তরমুজ। এরই মধ্যে তিনি প্রায় ৫০ কেজি তরমুজ বিক্রি করেছেন। তার ক্ষেতে যে পরিমাণ তরমুজ রয়েছে তাতে তিনি প্রায় ৫০,০০০ টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারবেন বলে আশাবাদী।
নতুনদিয়া গ্রামের কৃষক লিটন বলেন, গত বছর ভালো ফলন ও লাভবান হওয়ায় এবছরও মৌসুম ছাড়া তরমুজ চাষ করেছি। আশা করি বাম্পার ফলন পাব।
কৃষক মো. হাফিজ শেখের দেখাদেখি তরমুজ চাষ শুরু করেছেন দিপঙ্কর দে। তিনি বলেন, গত বছর এ তরমুজ চাষে ব্যাপক লাভ হওয়ায় সকল শ্রেণির কৃষকদের মধ্যে তরমুজ চাষের আগ্রহ বেড়েছে। তরমুজ মৌসুমি ফল। সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যায়। সেই তরমুজ এখন আর মৌসুমি ফল নয়। এখন সারাবছর তরমুজ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। তবে মৌসুম ছাড়া বাজারে তরমুজের সরবরাহ তুলনামূলকভাবে কম থাকায় কৃষক অধিক মূল্যে বিক্রির সুযোগ পাচ্ছেন।
রূপসা উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রীষ্মকালে সাধারণত অধিকাংশ কৃষক শসা, লাউ, ধুন্দল, করলাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষাবাদ করত। কিন্তু তারা কখনো নায্য মূল্য পেতেন না। ২০২০ সালে করোনাকালে কৃষি অফিস প্রথমবারের মতো কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বীজ, সার ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করে।
Advertisement
ফলে সে বছরই প্রথমবারের মতো মৌসুম ছাড়া তরমুজ চাষে সফলতা আসে এবং ন্যায্য মূল্যে পাওয়ায় কৃষকরা তরমুজ চাষে উৎসাহী হন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর মৌসুম ছাড়া তরমুজের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক কৃষক বাহারি রঙের তরমুজের আবাদ করে হয়েছেন স্বালম্বী।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিমাদ্রী বিশ্বাস বলেন, উপজেলার কিছু অংশ খুবই লবণাক্ত। কিন্তু সেই লবণাক্ততাকে দূর করে কৃষকরা সবজি ও তরমুজ উৎপাদন করছেন। আমরা নিয়মিত তরমুজের ক্ষেত পরিদর্শন করে পরামর্শ প্রদান করি। তিনি বলেন, উপজেলার সর্বত্রই ঘেরের মাচায় ঝুলছে বাহারি রঙের তরমুজ।
প্রতিটি তরমুজের ওজন জাত ভেদে দুই থেকে চার কেজি। বীজ বপনের ৪০ দিনের মাথায় ফুল থেকে ফল আসা শুরু হয়। আর ফল ধরার ৩০ থেকে ৩৫ দিন পার হলে ফল পরিপক্ক হয়।
এখানে তৃপ্তি, ইয়েলো ড্রাগন, রংধনু, রঙ্গিলা, ব্লাক বেবি ও সুইট ড্রাগন পাকিজা জাতের তরমুজ বেশি চাষ হয়। এ তরমুজ এখন বাজারে উঠতে শুরু করেছে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. ফরিদুজ্জামান বলেন, এটি নিরাপদ ও সুস্বাদু তরমুজ। প্রথমবার অনেক কৃষক আগ্রহ দেখাননি। প্রথম দিকে যারা উৎপাদন করেছিলেন তারা খুবই লাভবান হয়েছিলেন। লাভ হওয়ায় এবার চাষ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০০ বিঘা। অন্যান্য সবজি ও ফলের তুলনায় লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরা মৌসুম ছাড়া তরমুজ চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। কৃষকদের স্বাবলম্বী করার স্বপ্ন দেখাচ্ছে মৌসুমি বাহারি রঙের তরমুজ।
আলমগীর হান্নান/এমএমএফ/এমএস