মতামত

স্মৃতিতে-কর্মে উদ্ভাসিত মেজর খন্দকার নুরুল আফসার

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অবসরপ্রাপ্ত)

Advertisement

সাবেক সেনা কর্মকর্তা, রাওয়া এর সাবেক চেয়ারম্যান, আফসার গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক ও বিশিষ্ট সমাজসেবক মেজর খন্দকার নুরুল আফসার গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ঢাকার ইউনাইটেড হসপিটালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে এই সাহসী ও মানব দরদী সেনা কর্মকর্তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৬৮ বছর।

খন্দকার নুরুল আফসার ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারি কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ফরদাবাদে। তিনি ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্রাজুয়েট। তরুণ আফসার চট্টগ্রামের ভাটিয়ারির বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (বিএমএ) থেকে তৃতীয় শর্ট সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি-৩) সঙ্গে কমিশন লাভ করেন। তিনি সেকেন্ড লে. হিসেবে ২৪ ইস্ট বেঙ্গলে যোগদান করেন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর আফসার একজন চৌকস ও প্রতিশ্রুতিশীল অফিসার ছিলেন। মেজর পদবিতে বিএমএ’র প্রশিক্ষক (প্লাটুন কমান্ডার) ও ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজরের মতো মর্যাদাবান পদে তিনি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি চীনের নানজিং সামরিক একাডেমি থেকে ক্ষুদ্র অস্ত্রের ওপর বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। একটি দুর্ঘটনার কারণে, দুঃখজনকভাবে ১৩ বছরের চাকরিতেই তাকে সামরিক জীবনের সমাপ্তি টানতে হয়েছিল।

Advertisement

১৯৯০ সালে মেজর আফসারের কর্মজীবনের দ্বিতীয় ইনিংশ শুরু হয়। তবে প্রথম দিকে এটি ছিল অকল্পনীয় কঠিন এক জীবন সংগ্রাম। পরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের জোন-১০ এর জোনাল এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর নেমে পড়েন নিজস্ব ব্যবসায়। প্রচণ্ড পরিশ্রম , অধ্যবসায়, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সাহস, মেধা ও ব্যবস্থাপনা গুণের সমন্বয়ে নিজেকে ধীরে ধীরে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। আফসার গ্রুপ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এই গ্রুপে ১০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’ কথাটি তার জীবনে ফলেছে। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পুরোপুরি ‘সেলফ মেড ম্যান’। কর্মজীবনের দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম দিকে স্লো রান করলেও শেষ পর্যন্ত সেঞ্চুরি করেন। এই সাফল্যের গল্পটি অনুপ্রেরণার।

মেজর আফসারের মুত্যুর পর, তার পরিচিত মানুষের মাঝে বিশেষত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সামরিক সার্কেল/কমিউনিটিতে শোকের ছায়া নেমেছে। তাকে শ্রদ্ধা-স্মরণে ভাসছিল সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষত ফেসবুক। প্রিয়জন, বন্ধু, সহকর্মী, সামরিক কর্মকর্তা, সহযোদ্ধা, শুভ্যানুধায়ীরা মেজর আফসারকে নানা অভিধায় অভিষিক্ত করেছেন: একজন মানবিক মেজর, সত্যিকারের ব্রাদার অফিসার, মানবিকতার সেতু, নিঃস্বার্থ জনদরদী, গতিশীল নেতা। ইংরেজিতেও অনেকে লিখেছেন- রিয়েল গুড কমরেড, লিজেন্ড, জেম অব এ পারসন, বেনোভেলেন্ট পারসোনালিটি, পোল স্টার অব রাওয়া, দি শাইনিং স্টার...। ফেসবুকের কল্যাণেই গুণী এই মানুষটির যাপিত জীবনের কর্মময় পূর্ণাঙ্গ অবয়ব প্রস্ফুটিত হয়েছে।

চমৎকার নেতৃত্বগুণ ও সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী মেজর আফসার রাওয়ার (রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন) চেয়ারম্যান হিসেবে অসাধারণ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ ও উন্নয়ন করে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের অকৃত্রিম আন্তরিক ভালোবাসা অর্জন করেন। বিশেষত করোনাকালে রাওয়ার উদ্যোগী ভূমিকা উদাহরণ হয়েই থাকবে। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজারে মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর, হত্যার বিচার চেয়ে তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যা পরে এই বিচারটি সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। এছাড়া ডিওএইচএস মহাখালী পরিষদের সভাপতি হিসেবে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ, সামাজিক, বন্ধুবৎসল, সদা হাস্যোজ্বল ও প্রাণবন্ত মেজর আফসার অবসরপ্রাপ্তদের সামরিক কমিউনিটিতে স্বাভাবিক নেতায় পরিণত হন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত পরোপকারী, সদালাপী, বিশাল হৃদয় ও মানবিক গুণাবলির অধিকারী খুবই শ্রদ্ধাভাজন একজন সেনা অফিসার ছিলেন। আত্মীয়-স্বজন, কোন সামরিক কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবার কোনো সমস্যায় পড়লে এই মানব দরদী সর্বদাই তাদের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তিনি নিঃস্বার্থ দানশীল এবং পরোপকারী মানুষ ছিলেন। সুযোগ পেলে গোপনে মানুষের অনেক উপকার ও দান করতেন। এর সাক্ষী হয়ে রইলো বিকাশ মোবাইল ব্যাংকিং।

Advertisement

মেজর আফসার সমাজসেবা বিশেষত শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। ঢাকা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ফরদাবাদে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও ডায়াবেটিক সেন্টার স্থাপন করেছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো- উত্তরায় প্রতিষ্ঠিত আধুনিক নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- ‘আনোয়ারা-মান্নাফ স্কুল অ্যান্ড কলেজ’। তাছাড়া আরও অনেক সেবামূলক সামাজিক প্রতিষ্ঠানে এই উদার দানশীল ব্যক্তির উল্লেখযোগ্য পদচারণা ছিল।

আমাদের ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও দুঃখজনকভাবে ক্রমাগত নৈতিক অধপতন দৃশ্যমান। দিন দিন আমরা স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। এরকম সময়ে, মেজর আফসার ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। মৃত্যুর পর একজন সেনা সহকর্মী লিখেছেন- ‘আফসারের জীবনের মিশন বা ব্রত ছিল অন্যদের বিশেষত সমস্যাগ্রস্ত মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’। তিনি চারপাশের মানুষকে নিয়ে আনন্দে থাকতে চাইতেন। এক্ষেত্রে নিজের আর্থিক সঙ্গতিও ভাবতেন না। ভাবা যায়?

মেজর আফসার নিজে একজন ভালো খেলোয়াড় ও অত্যন্ত ক্রীড়ামোদি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে ফুটবল ও ক্রিকেট দুটিতেই বিশ্ববিদ্যালয় টিমে খেলেছেন। সেনাবাহিনীতেও সেনাবাহিনী পর্যায়ে ফুটবল খেলেছেন। পরবর্তী জীবনে গলফ খেলা ছিলে সবচেয়ে প্রিয় হবি, যা তার প্যাসানে পরিণত হয়। তিনি ‘ক্রেজী গলফার্স’ এসোসিয়েশনের সভাপতিও ছিলেন। কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের ‘ভোরের পাখিদের’ অন্যতম ছিলেন মেজর আফসার। তিনি ‘খিউ কুশিন কারাতে বাংলাদেশ’র সভাপতি ছিলেন।

এসবের পাশাপাশি মেজর আফসারের ছিল প্রবল জ্ঞান স্পৃহা। আধুনিক মনের অধিকারী ও প্রগতিশীল খন্দকার নুরুল আফসার ফেসবুকে শিক্ষা, সামরিক, খেলাধুলা, সামাজিক, অর্থনৈতিক, কৌশলগত, জাতীয় ও বৈশ্বিক সমসাময়িক বিষয়ের ওপর সহজ ভাষায় অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ও জ্ঞানগর্ভ পোস্ট দিতেন। ফেসবুক বন্ধুদের কাছে যা ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

পরোপকারী, মানুষ-দরদী এই ব্যক্তিটি ছিলেন জীবনমুখী ও প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা। চলমান সমাজ সময়কে জীবনের সঙ্গে একিভূত করে সুখ দুঃখ হাসি কান্না ও জীবনের আনন্দ বেদনার মধ্য দিয়ে মানিয়ে নেওয়ার চমৎকার ক্ষমতা ছিল। জীবনকে কর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে আনন্দময় ও উপভোগ্য করে তুলতেন। সে যাত্রায় অবশ্যই সঙ্গে নিতেন চারপাশের বন্ধু ও স্বজনদের: দলবেঁধে ভ্রমণ, পিকনিক করা, গলফ খেলা, মাছ ধরা... । মেজর আফসার ছিলেন উদ্যমী ভ্রমণ পিয়াসী।

মৃত্যুর দুই মাস আগে দীর্ঘ সময় ধরে ভ্রমণ করেছেন কানাডা ও আমেরিকার নগর প্রান্তরে। সেটি ছিল তার জীবন সঙ্গীনির সঙ্গে ‘দি লাস্ট রাইড টুগেদার’। তার ভ্রমণ মানেই নিজের ফেসবুকে অসংখ্য ছবি আপলোড করা। কখনো অটোয়ার ফ্যানকন রিজ গলফ ক্লাব, রিডো নদীর ধারে ব্রিটানিকা পার্কে হাঁটাহাঁটি, লেক অন্টারিওর নীল জলে মাছ ধরার তুমুল উৎসব। আনন্দ নগর লসএঞ্জেলসের ওয়াক অব ফেম, ওকলেন্ড বে ব্রিজ, নিউইয়ক মহানগরীর টাইমস স্কোয়ার ভ্রমণ...। পথ চলায়ই ছিল তার আনন্দ।

সামরিক জীবনের ঠিক প্রথম দিন থেকেই বিএমএতে মেজর আফসার আমাদের ১২তম লং কোর্সের প্লাটুন কমান্ডার (প্রশিক্ষক) ছিলেন। এই সময় আমাদের টার্ম কমান্ডার ছিলেন মেজর আলাউদ্দিন মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াদুদ, বীর প্রতীক (পরে মেজর জেনারেল, বর্তমান রাওয়া চেয়ারম্যান)। বিএমএতে প্লাটুন কমান্ডারদের বলা হয় ‘মেকারস অব লিডার্স’। মেজর ওয়াদুদ, মেজর আফসারসহ এক ঝাঁক তারকা প্রশিক্ষক ছিলেন আমাদের ‘দ্রোনাচার্য’। আজ একথা ভাবতেই গর্ব হয়।

কত কথা মনে পড়ছে...। ১৯৮৩ সালের ২ অক্টোবর। নবীন ক্যাডেটদের, দুই মাস পর প্রথম আউটডোর এক্সারসাইজ- ‘পদক্ষেপ’র তৃতীয় দিন। ইতোমধ্যে ভাটিয়ারী-হাটহাজারি-গহীরা-রাউজান-রাঙ্গুনিয়া-কাপ্তাই রোড-জানালিহাট হয়ে আমরা চট্টগ্রাম শহরের ফয়’স লেক পাহাড়ের পাদদেশে। ইতোমধ্যে হেঁটেছি ৮০-৮৫ কিলোমিটার। খাকি ডাংরিপরা ক্যাডেটদের হাতে রাইফেল, কাঁধে ভারী প্যাক-০৮ বা হ্যাভার স্যাক।

ক্লান্ত ক্যাডেটদের পা যেন চলছে না। কিন্তু সামনেই পাহাড়। হঠাৎ সেখানে কালো কমবেট পরা স্মার্ট তরুণ মেজর আফসার হাজির। চোখে কালো সানগ্লাস। হাতে শুটিং স্টিক। আমার সামনের ক্যাডেটের হ্যাভার স্যাকে শুটিং স্টিক ঠেকিয়ে বললেন- কাম অন মুভ, ইউ কেন মেক ইট- ‘তুমি এগিয়ে যাও, তুমি পারবে’। টনিকের মতো কাজ হলো। ফয়স লেকের পাহাড়ে হেঁটে আমরা এগিয়ে যাই কেবল্য ধাম পাহাড়ের মন্দিরের দিকে।

দ্বিতীয় টার্মে তিনি ছিলেন সরাসরি আমাদের প্লাটুনের ‘প্লাটুন কমান্ডার’। মেজর আফসার ছিলেন নিষ্ঠাবান সিরিয়াস টাইপের ‘২৪ ঘণ্টার প্রশিক্ষক’। কখনো ইয়ামাহা মোটরসাইকেল চালিয়ে ক্যাডেট ব্লকে আসতেন আমাদের কর্মকাণ্ড মনিটর করতে। প্রশিক্ষণের সময় দুর্বলতা কাটাতে আমাদের বিশেষ অনুপ্রেরণা ও গাইডেন্স দিতেন। তবে কখানো কখনো তার নির্দেশগুলো ছিল বেশ কাঠিন্যে ভরা!

কমিশন পাওয়ার ১৮-১৯ বছর পর আবার দেখা। শান্তি চুক্তির পর তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে ধীরে ধীরে শান্তি ফিরছে...। পাহাড়ের ভেতরের হিংসার ঝর্নাধারাগুলো ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের সব মানুষকে নিয়ে একত্রে হাঁটার চেষ্টা শুরু হয়েছে। আমি তখন রাঙ্গামাটিতে একটি পদাতিক ব্যাটালিয়নে কাজ করছি। আমাদের দেখা হলো রাঙ্গামাটির অপরূপ এক প্রাকৃতিক পরিবেশে। রাঙ্গামাটি শহরের পূর্বদিকে অপরূপ কাপ্তাই হ্রদের ওপারে বসন্তপাড়া মইনের (পাহাড়ের) পাদদেশে পেদা টিং টিং (ভরপুর পেট) নামে একটি রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। এর পাশ দিয়েই সুবলং ঝর্নায় যেতে হয়। পেদা টিং টিং এ মেজর আফসার এসেছেন তার প্রিয় বন্ধু ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফকরুদ্দিন হায়দার এর অতিথি হিসেবে।

আফসার স্যার এসেছিলেন সপরিবারে। সঙ্গে তার জীবন সঙ্গীনী সোমা নাসরিন, দুই রাজপুত্র- খন্দকার জুনায়েদ তামিম ও খন্দকার জুনায়েদ তাওসিন। তাদের মিষ্টি রাজকন্যা-জাসিয়া আমরিন। পুরো সময়টা তিনি মাতিয়ে রেখেছিলেন। ফেরার সময় আমাকে আশ্চর্যরকম একটা দায়িত্ব দিলেন। একটি খামে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে বললেন, ‘পাহাড়ি জনপদের একটি গ্রামে ওষুধ কিনে পৌঁছে দিতে হবে’। ততক্ষণে পশ্চিমের ফুরোমন পাহাড়ে সূর্য ঢলে পড়েছে। মেজর আফসার ও জেনারেল হায়দার স্পিডবোটে রওয়ানা হলেন কাপ্তাইয়ের দিকে। খানিক পর আমরাও রাঙ্গামাটির পথে স্পিডবোটে এগিয়ে যাই। যেতে যেতে ভাবি, আমার এই প্রশিক্ষকের হৃদয়টি হয়তো এই কাপ্তাই হ্রদের চেয়েও অনেক গভীর...।

বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী মেজর আফসারকে সমাজের বিভিন্ন মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানোর বিষয়টি আশা জাগায়। সমাজের দুর্ধর্ষ স্বার্থপর আগাছোগুলো ধেয়ে আসছে সৌরভময় গোলাপ বাগানের দিকে। সমাজে মেজর আফসারের প্রতি ভালোবাসা জানান দেয় যে, মানুষ সৌরভ ছড়ানো গোলাপ বাগানই চায়, পরোপকারী ভালো মানুষ চায়। স্বার্থপর আগাছা চায় নয়।

৬ সেপ্টেম্বর বাদ জোহর মহাখালী ডিওএইচএস মসজিদে মেজর আফসারের জানাজা। ডিওএইচএসের তুলনায় প্রায় জনসমুদ্র। তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা দেখে, অভিভূত হলাম। এরপর তার মরদেহ আনা হলো বনানী সামরিক কবরস্থানে। মৃত্যুঞ্জয়ী পঁচিশ নামে পরিচিত ২৫ ইস্ট বেঙ্গলের একটি স্মার্ট কন্টিনজেন্ট মরণোত্তর সালাম দিলো, এমন একজন সেনা কর্মকর্তাকে যিনি এসএসসি পাস করেছিলেন ময়মনসিংহের ‘মৃত্যুঞ্জয় স্কুল’ থেকে। সারাদিন ঢাকার আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল। কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলো। অবশেষে আমাদের সঙ্গে শোকের মিছিলে দাঁড়ালো বনানীর প্রকৃতি। সবশেষে বেজে উঠলো বিউগলের করুণ সুর- দি লাস্ট পোস্ট। এভাবেই সেনাবাহিনীর মর্যাদায় মনেপ্রাণে সৈনিক মরহুম মেজর আফসারের সামরিক ফিনারেল বা দাফন সম্পন্ন হলো। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল ৩টা ১৫ মিনিট।

মানুষের শ্রদ্ধা, সম্মান ভালোবাসা আর চোখের জলে বিদায় নিলেন খন্দকার নুরুল আফসার। ফেরার আগে শেষবারের মতো তাকালাম ফুলে ফুলে ভরা কবরের দিকে। হঠাৎ মনে হলো, নতুন কবরেই যেন একটা এপিটাফ লেখা আছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা....। ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/ আমি তোমাদেরই লোক’। ওপারে ভালো থাকুন শান্তিতে থাকুন প্রিয় আফসার স্যার। স্যালুট টু ইউ। অভিবাদন....।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক।bayezidsarwar792@gmail.com

এইচআর/ফারুক/জেআইএম