মধ্য এশিয়ার প্রথম রেলপথটি তৈরি হয়েছিল সামরিক কারণে। ১৮৮০ সালে রাশিয়া যখন ট্র্যাক স্থাপনের কাজ শুরু করে, তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল কারাকুম মরুভূমির চারপাশে (বর্তমান তুর্কমেনিস্তান) সৈন্য পরিবহন করা, যেন রুশ শাসনের বিরোধিতাকারীদের প্রতিরোধ চূর্ণ করা যায়। তাদের উদ্যোগে মাত্র আট বছরের মধ্যে ক্যাস্পিয়ান সাগর থেকে সমরখন্দ পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথে ট্রেন চলাচল শুরু করে।
Advertisement
১৮৮৮ সালে তরুণ ব্রিটিশ আইনপ্রণেতা (এবং ভারতের ভবিষ্যৎ ভাইসরয়) হিসেবে ওই রেলপথ পাড়ি দিয়েছিলেন জর্জ কার্জন। তিনি লিখে গেছেন, এটি রাশিয়াকে স্থানীয় বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তারে সহায়তা ও ভারতে আক্রমণ চালানোর ক্ষমতা দ্বিগুণ করেছিল। সেই থেকে এ অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে রেলপথটি।
কিন্তু আজ ক্ষমতার ভারসাম্য বদলাতে শুরু করেছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনারা বিদায় নেওয়ায় একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে। রাশিয়া আবার ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত। ফলে নিজেদের প্রভাব বাড়ানো ও ইউরোপের বাণিজ্য রুটে বৈচিত্র্য আনার দারুণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে চীনের সামনে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোও চীনের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে আগ্রহী।
বর্তমানে এসব প্রচেষ্টার মধ্যমণি হয়ে উঠেছে দুটি নতুন অবিচ্ছেদ্য রেলপথ। আগামী ১৫ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর সমরখন্দে সাংহাই কো-অপারেশন অরগানাইজেশনের শীর্ষ সম্মেলনে এগুলো নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। এ বিষয়ে অগ্রগতির প্রথম লক্ষণ সামনে আসে গত মে মাসে। সেসময় কিরগিজস্তানের প্রেসিডেন্ট সাদির জাপারভ ঘোষণা দেন, চীন, কিরগিজস্তান ও উজবেকিস্তানকে সংযোগকারী একটি রেলপথের নির্মাণকাজ শুরু হবে ২০২৩ সালে।
Advertisement
চীনা রেলপথ এরই মধ্যে কাজাখস্তানের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। সেখান থেকে রাশিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুট হয়ে উঠেছে। ইউরোপের সঙ্গে চীনের রেলপথ বাণিজ্যের সিংহভাগই হয় এই রুট দিয়ে। ২০১৬ সালে রেলপথটি দিয়ে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়েছিল, যা ২০২১ সালে বেড়ে সাড়ে সাত হাজার কোটি ডলারে পৌঁছেছে।
এ অবস্থায় তুর্কমেনিস্তান, ইরান ও তুরস্ক হয়ে চীন থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথ খুলে দেবে নতুন একটি রেলপথ। এর ফলে যাত্রাপথের দূরত্ব প্রায় ৯০০ কিলোমিটার ও সময় অন্তত আট দিন কমে যাবে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি যাবে রাশিয়াকে পাশ কাটিয়ে। ইউক্রেনে আগ্রাসনের কারণে মস্কোর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া-নির্ভর রুট দিয়ে পণ্য পরিবহন এখন অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
চায়না কমিউনিকেশনস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন অ্যাসোসিয়েশনের ইয়াং জি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপীয় গ্রাহকদের জন্য ‘মহাঅনিশ্চয়তা’ সৃষ্টি করেছে। রাশিয়াকে পাশ কাটানোর জন্য তাদের কেউ কেউ জাহাজে করে ক্যাস্পিয়ান সাগর পার হয়ে তুলনামূলক ধীরগতির ও খরুচে রেলপথ ব্যবহার করছে। নতুন রেলপথটি রাশিয়াকে বাদ দিয়ে চীন ও ইউরোপের মধ্যে একটি বিকল্প রুট সৃষ্টি করবে।
কিরগিজস্তানের পরিবহনমন্ত্রী এরকিনবেক ওসোয়েভ বলেছেন, ট্রান্স-কিরগিজ সংযোগ রেলপথ দিয়ে বছরে ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ টন মালামাল পরিবহন হবে, যার সিংহভাগই যাবে অন্য জায়গায়। এ প্রকল্পের কর্মসংস্থান, কর ও ট্রানজিট ফি কিরগিজস্তানের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখবে।
Advertisement
পরিকল্পনাটি অবশ্য নতুন নয়। এটি প্রথম প্রকাশ্যে আসে ১৯৯৭ সালে। রাশিয়া একে কখনোই পছন্দ করেনি। খরচ ও রুট নিয়ে একমত হতে পারেনি চীন-কিরগিজস্তান। এটি কিরগিজ জনগণের বিস্তৃত অংশকে সেবা দেবে নাকি সরাসরি ইউরোপে যাবে, তা নিয়ে শুরু হয় মতবিরোধ। আবার, রেলপথের গেজ ট্র্যাক চীন-ইউরোপে ব্যবহৃত ১ দশমিক ৪৩৫ মিটার থেকে কিরগিজস্তানের মানদণ্ড অনুসারে ১ দশমিক ৫২০ মিটারে কোথায় গিয়ে পরিবর্তন হবে সেটি নিয়েও দেখা দেয় বিতর্ক। ফলে পরিকল্পনাটি বারবার স্থগিত হতে থাকে।
ওসোয়েভ বলেছেন, চীন, কিরগিজস্তান ও উজবেকিস্তান অবশেষে ২৮০ কিলোমিটার রেল রুটের বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এতে খরচ হবে ৪১০ কোটি ডলার। সরাসরি বিনিয়োগ অথবা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হবে প্রকল্পটিতে। চীন সীমান্তের তুরুগার্ট পাস থেকে পশ্চিম কিরগিজস্তানের জালালাবাদ পর্যন্ত যাবে রেলপথটি। ১৯১৬ সালে রুশ নির্মিত একটি রেলপথ দিয়ে এরই মধ্যে উজবেকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত কিরগিজ শহরটি। আর গেজ ট্র্যাক পরিবর্তিত হবে মাকমালে। এ প্রকল্পের ভূতাত্ত্বিক জরিপ শিগগির শুরু হবে এবং সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হবে আগামী মার্চের মধ্যে।
এরই মধ্যে প্রকল্পটি অনুমোদন করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। কাজাখস্তানে একদিনের সফর শেষে তিনি আসন্ন সমরখন্দ সম্মেলনে অংশ নেবেন। তাছাড়া গত আগস্টেই কিরগিজস্তানে পৌঁছেছেন চীনা বিশেষজ্ঞরা। উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শভকাত মিরজিওয়েভ বলেছেন, প্রকল্পটি আমাদের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সংযুক্ত করবে, যার ফলে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পথ প্রশস্ত হবে। আর কিরগিজ প্রেসিডেন্ট জাপারভ বলেছেন, এর জন্য তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ব্যক্তিগত সমর্থন পেয়েছেন। গত জুলাইয়ে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নেরও সমর্থন পেয়েছিল পরিকল্পনাটি।
সমরখন্দ সম্মেলনে আরেকটি রেলওয়ে প্রকল্প তুলে ধরবেন উজবেক প্রেসিডেন্ট মিরজিওয়েভ। আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে উজবেকিস্তান ও পাকিস্তানকে সংযুক্ত করবে এই রেলপথটি। উজবেক সীমান্ত থেকে উত্তর আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফ পর্যন্ত এরই মধ্যে একটি ছোট রেলপথ রয়েছে। নতুনটি যাবে কাবুল হয়ে পাকিস্তানের পেশোয়ার পর্যন্ত, দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৫৭৩ কিলোমিটার।
এই রেলপথ তৈরির ফলে পাকিস্তানের বন্দর দিয়ে দ্রুত ও কম খরচে সমুদ্র সংযোগ পাবে স্থলবেষ্টিত উজবেকিস্তান ও আফগানিস্তান। ধারণা করা হচ্ছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উজবেকিস্তান থেকে পাকিস্তানে পণ্য পরিবহনে প্রয়োজনীয় সময় ৩৫ দিন থেকে মাত্র চারদিনে নেমে আসবে। এর জন্য ট্রানজিট ফি পাবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান।
তবে দুটি রেলপথের ভাগ্যই নির্ভর করছে, সেগুলো চীন ছাড়া অন্যান্য উৎস থেকে অর্থায়ন পায় কি না তার ওপর। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের সমস্যাগুলো বেইজিংকে একা কোনো অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে সতর্ক করে তুলেছে।
তাছাড়া ট্রান্স-কিরগিজ রেলপথের চেয়ে ট্রান্স-আফগান রেলপথের ভবিষ্যৎ বেশি অনিশ্চিত দেখাচ্ছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা তালেবানের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্কে জড়াতে রাজি নয়। ফলে, উভয় পরিকল্পনাই ভেস্তে যাওয়ার বড় আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু যদি প্রকল্প দুটি শেষপর্যন্ত আলোর মুখ দেখে, তাহলে বিশ্বের সঙ্গে আরও ভালোভাবে সংযুক্ত হওয়া এবং রাশিয়ার ওপর কম নির্ভরশীলতার দিকে এগিয়ে যাবে মধ্য এশিয়া।
(দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অবলম্বনে, অনুবাদ করেছেন খান আরাফাত আলী)কেএএ/