শ্যামলীর মাঠে বসে কেক আর মাঠা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি ছেলে এসে বলল, ‘ভাইয়া, একটু কেক দিবেন?’ ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দিয়ে দিলাম। তারপর মাঠায় যেই চুমুক দেব, আরেকটি ছেলে এসে বলল, ‘ভাইয়া, আমাকে মাঠা দিবেন? পিপাসা লাগছে।’ আমি দিয়ে দিলাম। এরপর বসে বসে ফোন দেখছি।
Advertisement
হঠাৎ পাশে ফিরে দেখি, ছেলে দুটি একসঙ্গে বেলুন ফুলিয়ে ফুল বানিয়ে বিক্রি করছে। একটু পরে ডাক দিলাম। ডাক দিতেই কাছে এলো। পাশে বসালাম। বললাম, ‘তোমরা কি আপন ভাই?’ বলল, ‘না, আমরা বন্ধু।’ বললাম, ‘তোমাদের ছবি তুলি?’ একজন বলে উঠল, ‘তোলেন ভাই।’ অন্যজন আপত্তি জানালো। তবে বন্ধু তাকে রাজি করালো। তুলে ফেললাম তাদের ছবি।
পাশে বসিয়ে জুড়ে দিলাম গল্প। একজনের নাম মাহবুব, আরেক জনের নাম রায়হান। দুজনই মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে থাকে। রায়হানের বয়স কম। ৯ বছর হবে। একটু লাজুক। যতক্ষণ কথা বলল, লক্ষ্য করলাম নিচু হয়েই কথা বলছে। রায়হানের একটি ছোট বোন আছে। বাবা রিকশা চালান। মা মানুষের বাসায় কাজ করেন।
পড়াশোনার কথা জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ‘ক্যাম্পে শিশু শ্রেণিতে পড়ি। যাই আবার যাই না। পড়তে ভালো লাগে না।’ ‘ভালো লাগে না কেন?’ জিজ্ঞাসা করলাম। রায়হান বলল, ‘মরে গেলেই তো পড়ালেখা শেষ। পড়ালেখা করে কী হবে? ঠিক কই নাই ভাই?’ আমার দিকে তাকালো। আমি হেসে উঠলাম।
Advertisement
মাহবুবকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমরা কয় ভাই-বোন?’ বলল, ‘জানি না।’ অবাক হয়ে বললাম, ‘জানি না মানে?’ মাহবুব বলল, ‘আব্বায় তো চারটা বিয়া করছে। তাই কয় ভাই-বোন জানি না। তবে মা তো আমারে নিয়ে একাই থাকে। মা মানুষের বাসায় কাম করে। আমি ফুল বেচি।’ মাহবুবের বয়স ১১ বছর। পড়াশোনা করে কি না জানতে চাইলে বলল, ‘আমিও মাঝে মাঝে যাই আবার যাই না।’
কথা বলে আরও জানতে পারলাম, তারা এ বেলুন ফুল বিক্রি করে টাকা তুলে দেয় মায়ের হাতে। দিনে বিক্রি করে ১২০-১৭০ টাকার মতো। কোনো কোনো দিন তেমন বিক্রি হয় না। মাহবুব জানায়, ওরা চকবাজার থেকে বেলুন কেনে। বেলুনের তিনশ টাকার একটি প্যাকেট কিনে ফুল বানিয়ে প্রায় আটশ টাকার মতো বিক্রি করা যায়।
প্রথম বেলুন কেনার টাকা ওদের মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে বলে জানায়। ভবিষ্যতে কী হতে চায়, এমন প্রশ্ন করলে দু’জনের বলার ধরন আলাদা হলেও মূল কথা একই। ওরা ভালো কিছু করে মাকে নিয়ে ভালোভাবে থাকতে চায়। তবে ভালো কিছু কী? তা তারা জানে না। শুধু জানে, ভালো কোনো কাজ।
আমি বললাম, ‘ভালো কিছু করতে হলে তো পড়াশোনা করতে হবে। তোমরা তো ঠিকভাবে পড়াশোনা করো না। যদি ভালোভাবে পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিই, করবে?’ ওরা কিছু বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। একপর্যায়ে উঠে চলে যায় উত্তর না দিয়েই।
Advertisement
পড়াশোনার প্রতি কেন এত অনীহা ওদের মতো পথশিশুদের। কারণ জানতে কথা বলি শিশু অধিকারকর্মী ও গণসাক্ষরতা অভিযানে কর্মরত উন্নয়নকর্মী সিজুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, ‘পরিবারে বাবা-মায়ের সম্পর্ক প্রতিটি শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। জেনেভা ক্যাম্পের প্রতিবেশী হিসেবে বলতে পারি, সেখানকার পরিবেশ শিশু কেন কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্যও বসবাস উপযোগী নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাঠদানের পদ্ধতি যদি আরও বেশি আনন্দদায়ক হতো, তাহলে তারা আকর্ষিত হতো পড়াশোনায়। এ শিশুরাই আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়তে পারে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে। তাদের মূল স্রোতধারায় ধরে রাখতে না পারাটা সত্যিই বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। যেন একটি শিশুও ঝরে না পড়ে।’
এসইউ/জেআইএম