দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে মামলা নিষ্পত্তিতে গতি ফিরেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর একই সময়ে এ হার বেড়েছে ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে মামলা নিষ্পত্তির হার গড়ে ৯১ দশমিক ৯০ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে এ হার ছিল গড়ে ৫৯ দশমিক ৫০ শতাংশ।
Advertisement
সোমবার (১২ সেপ্টেম্বর) সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের এক বিবরণীতে দেশের আটটি বিভাগের অধস্তন আদালতে মামলা নিষ্পত্তির এ হার তুলে ধরা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নির্দেশনা এবং উচ্চ আদালতের আটজন বিচারক নিয়ে মনিটরিং কমিটি গঠনের পর দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে মামলা নিষ্পত্তিতে গতি বেড়েছে। বর্তমান কমিটির সভাপতিদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান, নিরবচ্ছিন্ন মনিটরিং এবং গতিশীল নেতৃত্বে দেশের সব বিভাগে অধস্তন আদালতগুলোতে মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ।
এরমধ্যে ময়মনসিং বিভাগে সবচেয়ে কম মামলা দায়ের হলেও মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বিভাগটিতে ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ৪৭ হাজার ৯০৮টি (দেওয়ানি ও ফৌজদারি) মামলা দায়ের হয়েছে। এরমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৫১ হাজার ৮১১টি। নিষ্পত্তির এ হার ১০৮ শতাংশ।
Advertisement
আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার ও মুখপাত্র ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সাইফুর রহমানের দেওয়া তথ্য বিবরণীতে বিষয়টি উঠে এসেছে।
গত মার্চে অধস্তন আদালতে বিচারাধীন দেওয়ানি, ফৌজদারি ও ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা সরেজমিনে গণনা করে এবং তদন্তাধীন থাকা মামলার প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি।
...প্রধান বিচারপতির সদয় অনুমতিতে The Supreme Court of Bangladesh (High Court Division Rules), ১৯৭৩ অনুযায়ী মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পালনের উদ্দেশে গত ২৭ জানুয়ারি বিজ্ঞপ্তি মূলে আট জন বিচারপতির সমন্বয়ে আটটি বিভাগের অধস্তন আদালতসমূহে মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়।
বিবরণীর তথ্যমতে, অধস্তন আদালতে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেওয়ানি ও ফৌজদারি মিলে ৭ লাখ ৪৭ হাজার ৪৭৬টি মামলা দায়ের করা হয়। এ সময়ে অধস্তন আদালতে ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৯৫২টি মামলার নিষ্পত্তি হয়। গত বছর একই সময়ে আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মিলে ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৯৮১টি মামলা হয়েছিল। নিষ্পত্তি হয়েছিল ৩ লাখ ৯০ হাজার ৩১১টি।
Advertisement
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন আপিল বিভাগের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। শপথ নেওয়ার পর গত ২ জানুয়ারি এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, দেশের সব অধস্তন আদালতে মামলাজট নিরসন তথা বিচারপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আনার লক্ষ্যে আটটি বিভাগের জন্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিকে প্রধান করে একটি করে মনিটরিং সেল গঠন করা হবে। প্রতি মাসে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রতিবেদন নেওয়া হবে।
এরপর গত ২৭ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রধান বিচারপতি দেশের আটটি বিভাগের প্রতিটির জন্য হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতিকে মনোনয়ন দিয়ে পৃথক আটটি মনিটরিং কমিটি ফর সাব-অর্ডিনেট কোর্টস গঠন করে দিয়েছেন।
বিজ্ঞপ্তির তথ্যানুযায়ী, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামকে ঢাকা বিভাগে, বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনকে খুলনা বিভাগে, বিচারপতি জাফর আহমেদকে বরিশাল বিভাগে, বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লাকে চট্টগ্রাম বিভাগে, বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানকে সিলেট বিভাগে, বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনকে রংপুর বিভাগে, বিচারপতি মো. জাকির হোসেনকে ময়মনসিংহ বিভাগে এবং বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামানকে রাজশাহী বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের বিবরণীতে আটটি মনিটরিং কমিটির কার্যক্রম, বিভাগভিত্তিক চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ও ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দায়ের ও নিষ্পত্তি হওয়া মামলার সংখ্যা ও তুলানামূলক পরিসংখ্যান উল্লেখ রয়েছে। এতে ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাস ও ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে, অর্থাৎ মনিটরিং কমিটি গঠনের আগে ও পরে মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির সংখ্যা ও শতকরা হিসাব তুলে ধরা হয়েছে।
আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, পৃথক মনিটরিং কমিটি গঠনের পর কমিটির সভাপতি হাইকোর্ট বিভাগের আটজন বিচারপতি বিভিন্ন সময়ে দেশের আটটি বিভাগের অধস্তন আদালত পরিদর্শন করেন। কমিটির সভাপতিদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান, নিরবচ্ছিন্ন মনিটরিং ও গতিশীল নেতৃত্বে দেশের সব বিভাগে একত্রে মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মামলাজট নিরসনসহ আদালতের বিভিন্ন সমস্যা ও এসব সমাধানে যুগোপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্দেশে মনিটরিং কমিটির সভাপতিরা বিভিন্ন সময়ে নিজ নিজ বিভাগের অধস্তন আদালতের বিচারকদের সঙ্গে জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে মতবিনিময় সভা করেন। এরই মধ্যে বিচারকার্যের সুবিধার্থে দেশের সব বিভাগের বিচারকদের বিডি লেক্সের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমান মনিটরিং কমিটির সভাপতিরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে পুরোনো মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
চলতি বছরে মামলা নিষ্পত্তির হার গড়ে ৯১.৯০ শতাংশবিবরণীর তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে আটটি বিভাগের মধ্যে ঢাকা বিভাগের অধস্তন আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মিলে ২ লাখ ৬১ হাজার ৬২৬টি, খুলনা বিভাগে ৮৪ হাজার ৭৫৯, বরিশাল বিভাগে ৪৪ হাজার ৬৫৬, চট্টগ্রাম বিভাগে ১ লাখ ৩২ হাজার ৫০৮, সিলেট বিভাগে ৩৯ হাজার ১৯৭, রংপুর বিভাগে ৫৩ হাজার ৬৭৩, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৭ হাজার ৯০৪ ও রাজশাহী বিভাগে ৮৩ হাজার ১৫৩টি মামলা দায়ের করা হয়। সব মিলিয়ে ৮ বিভাগে মামলা দায়ের করা হয় ৭ লাখ ৪৭ হাজার ৪৭৬টি।
এসময়ে ঢাকা বিভাগে ২ লাখ ২৫ হাজার ৬০৮টি, খুলনা বিভাগে ৭৪ হাজার ৬৯৪, বরিশাল বিভাগে ৪০ হাজার ৯১১, চট্টগ্রাম বিভাগে ১ লাখ ২৯ হাজার ৯২৬, সিলেট বিভাগে ৩৭ হাজার ৪৭৩, রংপুর বিভাগে ৫২ হাজার ৮৪৬, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫১ হাজার ৮১১ ও রাজশাহী বিভাগে ৭৩ হাজার ৬৮৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এ হিসেবে চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে দেশের ৮ বিভাগে মোট ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৯৫২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ছয় মাসে মামলা নিষ্পত্তির হার গড়ে ৯১ দশমিক ৯০ শতাংশ।
গত বছর নিষ্পত্তির হার ছিল গড়ে ৫৯.৫০ শতাংশতথ্য বিবরণীতে দেখা যায়, গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের আট বিভাগের মধ্যে ঢাকা বিভাগে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা মিলে ২ লাখ ৫০ হাজার ৯৫৩টি, খুলনা বিভাগে ৬৭ হাজার ২৯, বরিশাল বিভাগে ৩২ হাজার ১৮৩, চট্টগ্রাম বিভাগে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৮৯, সিলেট বিভাগে ৩৪ হাজার ৭৯, রংপুর বিভাগে ৪৫ হাজার ৪৪৭, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৮ হাজার ৯৭৭ ও রাজশাহী বিভাগে ৬৬ হাজার ৪২৪টি মামলা দায়ের করা হয়। মোট মামলা দায়ের হয়েছিল ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৯৮১টি।
ওই সময়ে ঢাকা বিভাগে ১ লাখ ৩০ হাজার ২৪২টি, খুলনা বিভাগে ৪৬ হাজার ৬৪, বরিশাল বিভাগে ২৩ হাজার ৩২৪, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭০ হাজার ৯১১, সিলেট বিভাগে ২০ হাজার ৮৪৯, রংপুর বিভাগে ৩০ হাজার ৯৮৯, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৪ হাজার ৮৫৫ এবং রাজশাহী বিভাগে ৪৩ হাজার ৭৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। গত বছরের প্রথম ছয় মাসে মোট নিষ্পত্তি হয় ৩ লাখ ৯০ হাজার ৩১১টি মামলা। এসময়ে নিষ্পত্তির হার ছিল গড়ে ৫৯ দশমিক ৫০ শতাংশ।
এফএইচ/এমকেআর/এমএস