প্রায় ছয় মাস আগে, ঠিক অমিক্রনের আঘাতের পর বেশ কয়েকটি বিশ্লেষণে বলেছিলাম করোনার মহামারির বিদায় ঘণ্টা বাজতে শুরু করছে, যা রোগতত্ত্বের ভাষায় প্যানডেমিক থেকে এন্ডেমিক নামে পরিচিত। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে যে বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিও এখন এন্ডেমিকে পড়েছে| জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান এবং রাশিয়া বাদে প্রায় সব দেশেই এখন করোনার সংক্রমণ এবং মৃত্যু ব্যাপক হারে কমেছে|
Advertisement
পূর্বাপর ক্রমধারার করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ধরন বা উপধরন এবং টিকা আমাদের শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হওয়ায় মূলত এই এন্ডেমিকে প্রবেশ করা সম্ভব হয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা| আবার পুরোপুরি এন্ডেমিক প্রক্রিয়া শেষ হতে আরও দু’বছর লেগে যেতে পারে এমনটি বলা হচ্ছে|
অন্যসব দেশের মতো আমাদের দেশেও করোনাভাইরাসের বিস্তারের সূত্রপাত হয়েছিল উহান ভাইরাস দিয়ে, পরে যে বিবর্তিত ভাইরাসের ধরন বা উপধরন মহামারিকে সচল রেখেছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে তাদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক ছিল এমন উহান ভাইরাসের পর আলফা, তাকে ডিঙিয়ে ডেল্টা, ডেল্টাকে ডিঙিয়ে অমিক্রন বি এ ১, এরপর অমিক্রন বি এ ২, আবার অমিক্রন বি এ ২ কে ডিঙিয়ে এরই একটি উপধরন অমিক্রন বি এ ২.১২, এরপর অমিক্রন বি এ ৪, এবং বি এ ৫|
সবচেয়ে বেশি সংক্রমণশীল হওয়ায় সর্বশেষ অমিক্রন বি এ ৫ হলো এখন সারাবিশ্বে একমাত্র দাপুটে করোনাভাইরাস| এরচেয়েও অতি সংক্রমণ শীল প্যাথোজেনিক করোনাভাইরাসের কোন ধরনের কথা নতুন করে এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি| অদূর ভবিষ্যতে এমনটি শোনা না গেলে ইতিহাসের পাতায় অমিক্রন বি এ ৫ ই হবে সবচেয়ে সংক্রমণ শীল করোনাভাইরাস এবং ডেল্টা হবে সবচেয়ে বেশি প্যাথোজেনিক করোনাভাইরাস| অমিক্রন বি এ ৫ অতি সংক্রমণ শীল হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হলো এই ভাইরাসের পুনসংক্রমণের হার অনেক বেশি| যুক্তরাজ্যের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অমিক্রন বি এ ৫ এর পুনসংক্রমণ হার ১৪.৬ শতাংশ, যা ছিল আলফার ক্ষেত্রে ১.৮ শতাংশ এবং ডেল্টার ক্ষেত্রে মাত্র ১ শতাংশ|
Advertisement
টিকার কারণে অর্জিত হাইব্রিড ইমিউনিটি প্রায় এক কোটি ৪৪ লাখ লোকের জীবন বাঁচিয়েছে করোনাভাইরাসের হাত থেকে| এমনটি জানা যাচ্ছে| অন্যদিকে বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায় প্রায় প্রতিটি দেশে পাঁচ বছরের প্রত্যাশিত গড় স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়ে বেশি সংখ্যক মৃত্যু ঘটেছে করোনার বছরগুলোয়, যাকে অতিরিক্ত মৃত্যু বলা হচ্ছে| অন্যদিকে সংক্রমিত হয়ে অর্জিত প্রাকৃতিক ইমিউনিটির কারণেও বহু মানুষের প্রাণও রক্ষা পেয়েছে|
কেউ আবার আগের ভেরিয়েন্ট দিয়ে অতীতে আক্রান্ত হলে অর্জিত প্রাকৃতিক ইমিউনিটি বর্তমানে চলমান অমিক্রন বি এ ৫ ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে দারুণ সুরক্ষা দেয় প্রমাণিত হয়েছে পর্তুগালে করা এক বড় গবেষণায়| উহান ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ৫৫.৭ শতাংশ, আলফায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা ৫৮.৮ শতাংশ, ডেল্টায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা ৬৪.৫ শতাংশ এবং অমিক্রন বি এ ১ ও বি এ ২ আক্রান্ত ব্যক্তিরা ৭৬.৮ শতাংশ সুরক্ষা পান, যা মহামারিকে এন্ডেমিকে নিয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ|
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনা মহামারির প্রতি ঘণ্টায় ৯২ জন শনাক্ত হয়, ১.৪ জন মৃত্যুবরণ করে, ৯০ জন আরোগ্য লাভ করে, ৬৭৭ জনের টেস্ট করা হয়| সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম পাঁচদিনেই প্রতি ঘণ্টায় ১২ জন হারে শনাক্ত হয়, মৃত্যুবরণ করে ০.০৫ জন| করোনার বিদায় না ঘটলেও পরিস্থিতি যে একেবারে স্বস্তিদায়ক তা বলার অপেক্ষা রাখে না| কিন্তু পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায় যে সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের ঢেউটি শেষ হতে না হতেই আবারও দুই সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে|
গত ২২ আগস্ট শনাক্তের হার ৩ শতাংশ থাকলেও তা এখন বৃদ্ধি পেয়ে পৌঁছেছে ৬.৫ শতাংশে| গত বছর মে মাসে ডেল্টা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল| ফলে সংক্রমনের ট্রাজেক্টরি মতে আরও একটি মৃদু ঢেউ আসার সম্ভাবনা রয়েছে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে| এছাড়া বেশ কিছুদিন ধরে প্রতিদিন দু-একজন করে মৃত্যুবরণ করছে, যা উল্লেখিত সম্ভাবনাকে আরও স্পষ্ট করছে বলে আমার ধারণা|
Advertisement
সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়ার আগ্রহ কমে যাওয়ায় টিকা প্রদানের সংখ্যা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে| এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বে ১২৬০ কোটি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের ২৯ কোটি ৪০ লাখ। বিশ্বে প্রতিদিন এখন ৫০ লাখ টিকা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ টিকা দেওয়া হচ্ছে| সম্প্রতি শুরু হওয়া ৫ থেকে ১১ বছরের শিশুদের টিকা দেওয়ার কারণে প্রতিদিনের টিকা দেওয়ার সংখ্যাটি বেশি বেশি দেখা যাচ্ছে|
সব ধরনের ডোজের ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের তুলনায় টিকা গ্রহণে এগিয়ে আছে যদিও দেশে নারীদের তুলনায় পুরুষদের সংখ্যা বেশি| আমাদের দেশে মানুষের অনাগ্রহের কারণে সিনোভ্যাকের সঞ্চিত টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে বড় সংকট দেখা দিচ্ছে| মানুষের এই অনাগ্রহের কারণে চীন থেকে অঙ্গীকারবদ্ধ কোভাক্সের প্রত্যাশিত টিকা গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হচ্ছে| আবার মানুষের আগ্রহ তৈরির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় কর্মসূচিরও দেখা মিলছে না| সিনোভাক বুস্টার ডোজ হিসেবে চালানো গেলে এ সংকট মোকাবিলা সহজ হবে|
বৈশ্বিক ভাবে টিকা নিয়ে রাজনীতি বা কূটকৌশল পুরোনো হলেও তা নতুন মাত্রা পেয়েছে টিকা উৎপাদন কোম্পানি মর্ডানা যখন ফাইজার এবং বায়ো-এন্ডটেকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে টিকার স্বত্বাধিকার শর্তাবলি লংঘন করার কারণে| সম্প্রতি চীন ক্যানসিনো কোম্পানির আবিষ্কৃত মুখের শ্বাসের মাধ্যমে নেওয়া যায় এমন নতুন একটি টিকা অনুমোদন করেছে| যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অনেক দেশ অমিক্রনের বিরুদ্ধে বেশ কার্যকরী নতুন একটি টিকা প্রদান শুরু করেছে| যুক্তরাজ্য হাসপাতালের লক্ষণবিহীন রোগীদের ক্ষেত্রে করোনা টেস্টের বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়েছে| গর্ভবতী এবং প্রসূতি নারীদের ক্ষেত্রে টিকা নেওয়ার বাধ্যবাধকতা চালু করেছে|
বিশ্বব্যাপী করোনার বিস্তার কমতে শুরু করলেও টিকা নিয়ে এখনো এমন কর্মযজ্ঞ আসলে কূটকৌশলের অংশ অনেকে মনে করেন| করোনার বিস্তার কমতে শুরু করায় আমাদের দেশের মতো অন্যান্য দেশেও মিডিয়ার অ্যাটেনশন কমতে শুরু করেছে| অনেককে বলতে শুনেছি মিডিয়া প্রচার বন্ধ করলে পরে মহামারির তাৎক্ষণিক যবনিকাপাত ঘটবে, মিডিয়াই করোনাভাইরাসকে বাঁচিয়ে রেখেছে, করোনা মহামারি মিডিয়ার সৃষ্টি ইত্যাদি ইত্যাদি সব মন্তব্য|
করোনায় হয়তো ভোগান্তি কম, মৃত্যু হার কম বলে সহজ সমীকরণে এসব মন্তব্য করা খুবই প্রত্যাশিত| দৈনিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা কিংবা বর্তমানে ডেঙ্গু ভাইরাসের মৃত্যুর সংখ্যা করোনাভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশি পরিলক্ষিত হওয়ায় এসব মন্তব্যের নায্যতা খোঁজেন অনেকে| কোনোরকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললেও আক্রান্ত হচ্ছেন না দেখে আরও বেশি মন্তব্যের নায্যতা খুঁজতে থাকেন| কিন্তু মৃত্যুর অজানা শঙ্কা বা পরিসংখ্যানের ভাষায় সম্ভাবনা করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে অনেক বেশি, দুর্ঘটনা এবং ডেঙ্গুর তুলনায়| আপনি চাইলেই দুর্ঘটনা এবং অনেকটাই ডেঙ্গু ভাইরাস এড়াতে পারেন কিন্তু করোনাভাইরাস এড়ানো এত সহজ ব্যাপার নয়|
এছাড়াও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত একটা বড় শতাংশ লং কোভিড বা দীর্ঘকালীন স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েন| যুক্তরাজ্যে আক্রান্তদের মধ্যে ৩ দশমিক ১ শতাংশ লোক ১২ সপ্তাহের বেশি ধরে চলাকালীন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন| তবে আশার কথা হলো অমিক্রন বি এ ৫ এর ক্ষেত্রে লং কোভিডে পড়ার সম্ভাবনা অনেক কম কারণ এদের ভাইরাল লোডের পরিমাণও অনেক কম| এদের অনেককেই সারা জীবন ধরে বয়ে চলতে হতে পারে তাদের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো| বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায় যে, এমনকি ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যুর সম্ভাবনার চেয়েও করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেশি|
সরকারি হিসাব মতে, এখনো ২৬ হাজারেরও বেশি সক্রিয় করোনাভাইরাসের রোগী রয়েছে, যা হওয়ার সম্ভাবনা পরিসংখ্যানের ভাষায় শূন্য| ন্যূনতম গাণিতিক ধারণা প্রয়োগ করেই তা প্রমাণ করা যায়| গত একমাসে শনাক্ত হয়েছে ছয় হাজারের মতো, আর আরোগ্য লাভের সময় গড়ে সাতদিন ধরলেও বিগত ৭ বা ১৫ দিনের মধ্যে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যাই (প্রায় তিন হাজার) সিস্টেমে সক্রিয় রোগীর সংখ্যা ধরে নেওয়া যায়|
তথ্য হালনাগাদ সঠিকভাবে না হলে তথ্যের মর্যাদা যেমন লোপ পায়, ঠিক তেমনই তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বা কার্যকারিতাও লোপ পায়| মনে রাখা দরকার বর্তমান মহামারির তথ্যভান্ডার বা তথ্য সরবরাহ প্রক্রিয়া আগামীদিনের বা শতকের আরেকটি করোনাভাইরাসের মতো মহামারি মোকাবিলার দলিল হিসেবে কাজ করবে|
লেখক: অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান, পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, আই এস আর টি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন নির্বাহী কমিটি।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম