শিক্ষা এমন একটি উদ্দেশ্যমূলক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য যেমন জ্ঞান, দক্ষতা, সামাজিকীকরণ, নৈতিক মূল্যবোধ, সততার মত বিষয়গুলোকে অর্জন করার চেষ্টা করা হয়। আর এই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যগুলোকে শিক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার গুরু দায়িত্ব পালন করেন একজন শিক্ষক।
Advertisement
সুতরাং খুব স্বাভাবিকভাবেই একজন শিক্ষক অবশ্যই সমাজের একজন আদর্শ চরিত্র যার সহচর্যে শিক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা বিকশিত হয়ে দেশ এবং সমাজের কল্যাণে কাজ করবে। তাই শিক্ষার প্রক্রিয়াটিও হবে অত্যন্ত সুন্দর, স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ এবং আনন্দময়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে শিক্ষায় খুব দুঃখজনক একটি চিত্র পরিলক্ষিত হয়।
বর্তমানে শিক্ষা এমন একটি প্রেসার কুকার হয়ে দাড়িয়েছে যার মধ্যে শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছে এবং হাঁসফাঁস করছে একটা হুইসেল বেজে কিছুটা চাপমুক্ত হওয়ার আশায়। শিক্ষক সমাজের দায়িত্ব ছিলো এই বদ্ধ প্রেশার কুকারের ঢাকনি উন্মুক্ত করে শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষার মুক্ত পরিবেশে বিচরণ করার সুযোগ করে দেওয়া। অথচ তার বদলে একশ্রেণীর শিক্ষক সেই চাপের সাথে শারিরীক কিংবা মানসিক নির্যাতন যুক্ত করে পরিস্থিতি করে তুলেছে আরো ভয়াবহ।
২০১০ সালে সরকার কর্তৃক পরিপত্র জারির মাধ্যমে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসিক এবং শারীরিক শাস্তি প্রদান সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং জাতিসংঘ সনদের ৩৭ নং ধারায় 'কোনো শিশুই নির্যাতন বা নৃশংস অমানবিক মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তির শিকার হবেনা' এমন নির্দেশনা থাকলেও বন্ধ হয়নি ভয়ের এই সংস্কৃতিচর্চা।
Advertisement
বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থী নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। প্রতিদিনের সংবাদপত্র কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চোখ রাখলেই এধরনের ঘটনার দেখা মেলে। শিক্ষকের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার এই আতঙ্ক শিক্ষাঙ্গনে সৃষ্টি করছে ভয়ের সংস্কৃতি। যার নেতিবাচক সামাজিক প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।
একজন শিক্ষার্থী যদি তার শিক্ষা জীবনের প্রথম অংশেই শিক্ষক কর্তৃক নির্যাতিত হয় এবং প্রহারকেই সমস্ত রোগের মহৌষধ হিসেবে তার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে সেই শিক্ষার্থী ভবিষ্যতের সমাজ ব্যবস্থার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে? একজন শিশুর ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ভয়ের সংস্কৃতি স্থাপন করার মাধ্যমে আমরা কোন ভবিষ্যত বিনির্মাণের দিকে চলেছি?
একথা খুবই সত্য একটি শ্রেণিকক্ষে চঞ্চল প্রকৃতির কিছু শিক্ষার্থী থাকেই যাদেরকে নিয়ন্ত্রনে আনাটা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক পৃথিবীতে বাস করে সেই নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া কখনও আদীম বর্বর যুগের মত হতে পারেনা। বেশিরভাগ ঘটনার পর্যালোচনা করলে দেখা যায় খুব তুচ্ছ কারণেই শিক্ষার্থীরা গুরুতর শারিরীক কিংবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
সুতরাং একথা বলাই বাহুল্য একজন নির্যাতনকারী শিক্ষক তার অন্যান্য মানসিক অবসাদ কিংবা রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের মাধ্যমে। এমনকি এসব ঘটনায় বাদ যায় না নারী শিক্ষার্থীও। সমাজের কোনো কোনো পক্ষ প্রাচীন সংস্কৃতি টেনে এনে বোঝাতে চান শিক্ষক থেকে শাস্তি না পেলে ছাত্রজীবন ব্যর্থ এবং সবচেয়ে দুঃখজনক বাস্তবতা এই শাস্তি হিসেবে তারা শারিরীক প্রহারকেই সমর্থন করেন। অথচ তারা কখনও গভীরভাবে ভেবে দেখেন না শিক্ষা ব্যবস্থায় এই ভয়ের সংস্কৃতি একজন শিক্ষার্থীর কোমল মনে কতটা ভয়ংকর দাগ ফেলতে পারে!
Advertisement
শতকরা আশি জন শিক্ষার্থী হয়তো সেই দুঃসহ স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে, কিন্তু বাকি বিশ জন? সেই বিশজনকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। শিক্ষার উদ্দেশ্যতো কারো প্রতি অবহেলা নয়, কাউকে পিছিয়ে পড়তে দেওয়া নয় বরং সবার জন্য উপযুক্ত এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করা যেখানে সবাই আনন্দের সাথে নিজের পঠনপাঠনটি শিখতে চাইবে।
আগামীকাল পড়া না পারলে শিক্ষক শাস্তি দিবেন, এমন আতঙ্কই মূলত মুখস্থ বিদ্যা চর্চার সুত্রপাত ঘটায়। শুধু শাস্তি থেকে রক্ষা পেতে একজন শিক্ষার্থী অজান্তেই ঝুঁকে পড়ে মুখস্থ বিদ্যা চর্চায়। ফলে সৃজনশীল নামক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকলেও আদতে শিক্ষায় তার প্রভাব পড়ছে না। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের ধারায় বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা এই মুখস্থ বিদ্যা।
আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই সেখানে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া চলে একটি আনন্দময় এবং সার্বজনীন পরিবেশে। জ্ঞানার্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের আতঙ্কজনক পথ পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। সেদিন খুব বেশি দুরে নয় যেদিন উন্নত বিশ্বের কাতারে সমুজ্জল হবে বাংলাদেশের নাম। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে একটি সুশিক্ষিত জাতি গঠন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
শিক্ষাঙ্গনে এধরনের ভয়ের সংস্কৃতিচর্চা নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা বিমুখ করে তুলবে। তাই প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদেরকে আনন্দময় পঠন এবং শিখনরীতি বাস্তবায়নের জন্য প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন। একজন শিক্ষার্থীর পড়ালেখায় পিছিয়ে থাকা বা তার শিশু বয়সের সামান্য ভুলটা যেন সে আনন্দময় পরিবেশে সংশোধনের সুযোগ পায় সেদিকে সবার আগে শিক্ষক সমাজকেই সচেতন দৃষ্টি দিতে হবে।
শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তবে শিক্ষার্থী সেই মেরুদণ্ডের কশেরুকা আর শিক্ষক মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর। আদর্শ মেরুদণ্ড গড়তে তাকে প্রতিটি কশেরুকা জোড়া দিতে হবে অত্যন্ত সাবধানে এবং যত্নের সাথে। মনে রাখতে হবে এই জোড় প্রক্রিয়ায় সামান্য ভুল জাতির জন্য, সর্বোপরি দেশের জন্য অমঙ্গল বয়ে আনবে।
লেখক: সংবাদকর্মী ও কলাম লেখক।
এইচআর/এমএস