বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা চলমান বেশ কয়েকদিন ধরে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে যেমন এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে, একই ভাবে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সরকারি দলকে ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
Advertisement
করোনা অতিমারি পরবর্তী সময়ে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা চলাকালীন ভারত এবং বাংলাদেশের সরকার প্রধানের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করে। আমরা সবাই জানি যে করোনা অতিমারি এবং বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ইতোমধ্যে ভেঙে পড়েছে।
পাকিস্তানের অর্থনীতির অবস্থাও খুব ভালো নয়। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত শক্তভাবে উভয় পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এই সফরের মধ্য দিয়ে বেশ কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে দুটি দেশ, যা ভবিষ্যতে এই বন্ধুপ্রতিম দুটি রাষ্ট্রের সম্পর্ককে আরও জোরদার করবে।
গত ৫ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর শুরু হতে না হতেই একটি পক্ষ সফরকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। বিমানবন্দরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কে অভ্যর্থনা জানালেন সেটি তাদের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতে পৌঁছানোর পর সে দেশের রেল ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়েছেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি পক্ষ যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে তা হলো ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক কমে গেছে কারণ নরেন্দ্র মোদী শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে আসেননি।
Advertisement
যারা এই বিষয়টি নিয়ে অহেতুক জল ঘোলা করার চেষ্টা করছে তাদের জানা উচিত ভারতের সরকার সে দেশে সফররত রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য একটি প্রটোকল মেনে চলে। সেই প্রটোকল অনুযায়ী কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে সেই দেশের প্রতিমন্ত্রী সব সময় বিমানবন্দরে স্বাগত জানান। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেছে।
যেমন ২০১৭ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ভারত সফর করেন সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রটোকল ভেঙে বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এছাড়া ভারত সরকারের রীতি হচ্ছে সে দেশে সফররত অতিথিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয় সফরের দ্বিতীয় দিনে রাষ্ট্রপতি ভবনে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। শেখ হাসিনার সফরের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ৬ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছান, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন এবং লালগালিচা সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে কেন ২০১৭ সালে নরেন্দ্র মোদী নিজে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছিলেন। এই প্রশ্নের উত্তর নরেন্দ্র মোদীই ভালো ভাবে দিতে পারবেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করে যে এই সফরটি ছিল নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে শেখ হাসিনার প্রথম ভারত সফর এবং তার কিছু দিন আগেই নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। বাংলাদেশ এবং ভারত ঐতিহাসিকভাবে দুটি বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র এবং যাদের সম্পর্ক অত্যন্ত সুদৃঢ়। সেই জায়গা থেকে নরেন্দ্র মোদী নিজে বিমানবন্দরে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
২০১৭ সালে নরেন্দ্র মোদী যেভাবে শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়েছিলেন ঠিক তেমন কয়েকটি ঘটনা এর আগে ঘটেছে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জাপানের প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত শিনজো আবে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে নরেন্দ্র মোদী নিজে বিমানবন্দরের স্বাগত জানান। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ভারত সফরের সময় বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়েছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত সুষমা স্বরাজ।
Advertisement
বিমানবন্দরে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানানোর বিষয়টি নিয়ে অহেতুক রাজনীতি করার কোনো যৌক্তিক কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। এই গোষ্ঠী শুধু এ বিষয়ে জলঘোলা করার চেষ্টা করেই খান্ত হয়নি তারা ২০০৬ সালের ২০ মার্চ খালেদা জিয়ার ভারত সফরকালীন সময়ের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে দাবি করেছে যে সেই সময় খালেদা জিয়াকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়েছিলেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। এটা ঠিক যে ছবিতে দেখা যাচ্ছে খালেদা যখন গাড়ি থেকে নামছেন, তখন মনমোহন সিংহ তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। বিষয়টি সঠিক হলেও ছবিটি আসলে বিমানবন্দরে স্বাগত জানানোর নয়। সেটি ছিল ২০০৬ সাল ২১ মার্চ অর্থাৎ খালেদা জিয়া ভারতে পৌঁছানোর দ্বিতীয় দিনের। তিনি যখন রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছান তখন মনমোহন সিংহ তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দরে কে স্বাগত জানালো সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এই বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা করার জন্য যারা ব্যস্ত রয়েছেন তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করছেন। একই রকমভাবে এই গোষ্ঠী প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ বলে দাবি করার চেষ্টা করছে। তাদের মতে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালীন বাংলাদেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে এমন কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। এমনকি তারা বলছে যে বাংলাদেশ সরকারের ব্যর্থতার কারণে লাইন অফ ক্রেডিটের আওতায় বাংলাদেশের ভারতের কাছ থেকে ৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার পাওয়ার কথা থাকলেও খুব অল্প অর্থ পেয়েছে।
বাংলাদেশের বিরোধী একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী সব সময় ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়ে রাজনীতি করে। তাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র হচ্ছে ভারত বিরোধিতা এবং আওয়ামী লীগের সাথে ভারতকে যুক্ত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করা যার শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে পরিবারে হত্যার মাধ্যমে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সব সামরিক শাসক ভারত বিরোধিতার কার্ডটি ব্যবহার করেছে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য।
তাদের মূল অগ্রাধিকার ছিল পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক জোরদার করা এবং চীনের প্রতি সদয় নীতি গ্রহণ করা। পাকিস্তান ও চীনের সাথে ভারতের বৈরিতা রয়েছে বিধায় ভারত বিরোধিতাকে ব্যবহার করে তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করতো। তবে সে অবস্থা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে ভারত বিরোধিতার কার্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশে এখন আর কাজ হয় না।
এই পক্ষ সব সময়ই চেষ্টা করে চলেছে ভারত এবং আওয়ামী লীগকে একই সূত্রে গেঁথে জনগণের মধ্যে একটি ভুল বার্তা প্রদানের জন্য। আমরা লক্ষ্য করেছি ভোট এলেই এই গোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে। যেমন- তারা স্লোগান দিতো এই বলে যে ‘শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গেলে ঢাকা হবে দিল্লি’ এবং ‘মসজিদগুলো হিন্দুদের উপসনালয়ে পরিণত হবে’। এই ধরনের প্রপাগাণ্ডা মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অভিপ্রায়ে এই গোষ্ঠী ভারত বিরোধিতা করে আসছে অনেকদিন ধরে। আর এই কারণেই প্রধানমন্ত্রীর সফরকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক তৈরি করে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরিতে ব্যস্ত তারা।
আমরা সবাই জানি যে ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি পক্ষ বিভিন্ন ধরনের প্রপাগাণ্ডা মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে চলেছে। এই গোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে বিতর্কিত করার মাধ্যমে জনগণের সমর্থন পাওয়া। আর এই চিন্তা থেকেই তারা বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য বিতরণ করছে। তবে বাংলাদেশের জনগণ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন। তারা গত সাড়ে ১৩ বছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করেছে। তারা দেখেছে যে বাংলাদেশের ওপর ভারত কখনোই খবরদারি করেনি। এই ধরনের অমূলক এবং ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করা থেকে দূরে সরে এসে গঠনমূলক রাজনীতি সব পক্ষের জন্য যেমন ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে, ঠিক তেমনি ভাবে দেশের রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হবে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/ফারুক/এমএস