ভ্রমণ

সাঙ্গু নদী ভ্রমণে যা যা দেখে মুগ্ধ হবেন আপনি

ব্রি. জেনারেল (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন

Advertisement

সাংগু নদীর উপরের বড় ব্রিজটি বর্তমানে থানচির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করেছে। থানচি থেকে দক্ষিণের এলাকাগুলোতে যেতে হলে সাংগু নদীই ভরসা। সাঙ্গু দিয়ে দক্ষিণের দিকে চলতে থাকলে বেশ বড় একটা বাজার হলো মদক। এরপর জনপদ তেমন নেই, রির্জাভ ফরেস্ট তারপর মায়ানমার সীমান্ত।

সাঙ্গু নদী বা শঙ্খ নদী, বাংলাদেশের পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের চট্টগ্রাম ও বান্দরবান জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ২৯৪ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১১৯ মিটার। নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা `পাউবো' কর্তৃক সাঙ্গু নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের নদী নং ১৫।

১৮৬০ সালে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গেজেটিয়ার প্রকাশকালে ব্রিটিশ শাসকরা ইংরেজিতে এটিকে সাঙ্গু নাম দেন। তবে মারমা সম্প্রদায়ের ভাষায় শঙ্খকে রিগ্রাই থিয়াং অর্থাৎ স্বচ্ছ পানির নদ বলা হয়। বান্দরবানের শঙ্খ-তীরবর্তী লোকজনের ৯০ শতাংশই মারমা। জীবন-জীবিকাসহ দৈনন্দিন কাজে এরা নদীটির ওপর নির্ভরশীল।

Advertisement

সাঙ্গু নদী দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে চলেছে। এর উৎপত্তি বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে পাহাড়ের ছড়াগুলো থেকে। পাহাড়ি নদী তাই বর্ষায় প্রচণ্ড খরস্রোতা। এর বুকে নুড়ি পাথর মাটি সবই আছে।

এছাড়া আছে বিশাল এক পাথরের রাজ্য। অনেক সময় নদীর দু’পাশে খাড়া অনেক উঁচু পাথুরে পাহাড়ের বিশাল দেওয়াল। এগুলো দেখলে প্রকৃতির কাছে নিজেকে অসহায় মনে হয়। বৃষ্টি হলে পাহাড়ি এই নদীতে প্রচণ্ড স্রোত থাকে তখন ছোট্ট নৌকাগুলো তাল থামলাতে না পেরে পাথরে ধাক্কা খায় ও উল্টে যায়। তাই নদী কিছুটা শান্ত হলেই নৌকা চলে। তা না হলে যোগাযোগ বন্ধ থাকে নৌ পথে। নৌকা যোগে থানচি বাজার থেকে সোয়া ৬টায় রওয়ানা হলাম মদকের পথে।

ইঞ্জিনচালিত নৌকা। বেশ সরু ও এগুলোই এই নদী পথে চলার জন্য আদর্শ। ইঞ্জিনও স্পেশাল, এটি থাইল্যান্ড থেকে আসে। এই ইঞ্জিন ছাড়া অন্য স্যালো ইঞ্জিনে এই নদীতে চলাচল করা সম্ভব না। নৌকার মাঝি থাকে দু’জন। একজন ইঞ্জিন চালায় অরেকজন নদী অবস্থা দেখে পথ নির্দেশ দেয়।

নদী কখনো গভীর আবার কখনো অগভীর। অগভীর জায়গায় স্রোত বেশি। তবে গভীরতা না থাকার কারণে নৌকা আটকে যায়। থানচি থেকে স্রোতের বিপরীতে নৌকা চলছে। নদীর নীচের দিক থেকে আমরা ঢেউ ঠেলে উপরের দিকে চলছি।

Advertisement

থানচি একটা বড় যোগাযোগ কেন্দ্র ও এখানে বড় বাজার আছে। পাহাড়ি এলাকায় পাড়া, বাজার, নদী, রাস্তা এগুলো নিয়েই সব ব্যস্ততা আবর্তিত। থানচিতে নদী বেশ প্রসস্থ, আমরা যত এগিয়ে যাচ্ছি, দক্ষিণের দিকে দু’পাশে পাহাড়গুলো ছোট থেকে বড় হচ্ছে। নদী এঁকে বেঁকে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলছে আনমনে।

পথে অনেকগুলো পাড়া আছে। পাড়াগুলো একটু ভেতরে। তবে পাড়া থেকে আসা পায়ে চলা পথ নদীতে শেষ হয়েছে। এ পথে পানি নিয়ে গোসল করে লোকজন। মাঝে মধ্যে দু’একটা নৌকা বাঁধা আছে। লোকজন মাছ ধরে এই নৌকায় চড়ে যাতায়াত করে আশপাশে।

থানচি এলাকায় নদীর পাড়ের কয়েকটা পাড়া, মুইখই পাড়া, আপ্রোমং পাড়া, নাইদাড়ী পাড়া, আলতলী পাড়া, উসামং হেডম্যান পাড়া, টিএন্ডটি পাড়া, ছান্দাগ পাড়া, নিলথ পাড়া, জিনিয়ং পাড়া, নারিকেল পাড়া, খিবুরী পাড়া, প্রেসিং পাড়া, ছোট ইয়ারী পাড়া, বড় ইয়ারী পাড়া।

এগুলো নদীর দু’পাশেই পাহাড়ের কোলে। ছোট ছোট জনপথ, জনমানুষের দেখা মেলে না। সকাল হলেই বাইরে চলে যায় সবাই। জুমে কিংবা জীবিকার সন্ধানে। বলে নেওয়া ভালো, পাড়াগুলো তেমন ঘন বসতি পূর্ণ নয়, বাঁশের মাচার উপর বাঁশের বেড়া ও টিন বা ছনের ৫-৬টি ছোট ছোট ঘর নিয়ে ছোট পাড়া।

বড় পাড়াগুলোতে ১০-২০টি ঘরও আছে। একটা বাড়ি থেকে আরেকটা বাড়ি একটু দূরে দূরে। বাড়িগুলোতে মুরগি, শুকর ইত্যাদি পোষা হয়। মানুষজন সকাল থেকে সন্ধ্যা জুমে কাজ করে। পাড়াগুলোতে কুকুরের দেখা মেলে। প্রায় প্রত্যেকে একটা করে দা ও পিঠে বাঁশের ঝুড়ি বহন করে। প্রায় ৪০ মিনিট চলার পর দূরে বেশ বড় বাজার দেখা গেল। অনেক নৌকা বোঝাই হচ্ছে পাহাড় থেকে আনা কলা, আনারস, আম দিয়ে। ১০ টাকা করে আমের কেজি। ছেলে মেয়ে সবাই পিঠে করে আম বয়ে এনে নৌকায় ফেলছে।

এগুলো সব থানচি হয়ে বান্দরবান চলে যাবে। পাড়াটার নাম গ্রুপিং পাড়া, টেন্ডুমুখ বাজরের কাছেই পাড়া। বেশ বড় পাড়া। বেশ কয়েকটা জাতি গোষ্ঠী মিলেমিশে এখানে থাকে। এদের স্কুল আছে। কিয়াং ঘর আছে প্রার্থনার জন্য। নৌকা থেকে এখানে নেমে যেতে হয় কারণ পানি ওপর থেকে নিচে জলপ্রপাতের মতো পড়ছে। এখানে নদীর গভীরতা কম পাথর জমে বাঁধের মতো হয়ে গেছে। মাঝি খালি নিয়ে এসে নৌকা ঠেলে আবার নদীতে ফেলে। সেখানে পানি বেশ গভীর ও সবুজ। পাহাড়ের উচ্চতা বেশ বেড়ে গেছে অনেক।

দু’পাশে এখন বেশ ঘন বন। পাখিদের কিচির মিচির শোনা যায়। ইঞ্জিনের শব্দে তাদের শান্তি নষ্ট হলেই কিচির মিচির শুরু হয়। টেন্ডুমুখ থানচি থেকে প্রায় বার কিলেমিটার ও নদীর পাশের পাড়াগুলো হলো, নতুন পাড়া, জামং পাড়া, মংসু পাড়া, গ্রুপিং পাড়া।

টেন্ডুমুখ থেকে ইয়ংরাই যেতে বেশ কয়েকটা পাড়া আছে। তবে বেশিরভাগই নদী থেকে দেখা যায় না। পাহাড় একদম খাড়া। নদীর মধ্যে বড় বড় পাথরের বোল্ডার। এ যেন এক বিশাল পাথরের রাজত্ব। প্রায় দুই তিন কিলোমিটার জুড়ে এর অবস্থান। একেকটি পাথর ২০-৩০ ফিটের মতো উঁচু।

নদীর গভীরতা তাই এখানে একেক জায়গায় একেক রকম। হঠাৎ অনেক গভীর মাঝে মাঝে অগভীর। সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকা এটি। নৌকা ঠিকমতো না চললে হঠাৎ পাথরের ধাক্কা খেয়ে নৌকা উল্টে যায় ও যে কোনো বিপদ হতে পারে।

দু’পাশে খাড়া পাথরের উঁচু দেওয়াল। মাঝে মধ্যে ঘন জঙ্গল। পোকা মাকড় ও পাখির কিচির-মিচির, উপরে নীল আকাশ সাদা কালো মেঘ। দূরে দক্ষিণে আরও পাহাড়ের বাঁক। পেছনে ফেলে আসা এলাকা সব মিলে যেন একটা ফ্রেমে বাঁধা দৃশ্য। নৌকায় থাকা কয়েকজন মানুষ কত ক্ষুদ্র কত তুচ্ছ এই বিশাল প্রকৃতির কোলে।

তারপরও আমরা কত বড় মনে করি আমাদের অবস্থানকে। এখানে এলে উদার এই প্রকৃতির বিশালতা মুগ্ধ হওয়ার মতো। টেন্ডুমুখ থেকে আরও ১০ কিলোমিটার গেলে একটি ছোট বাজার। বাজারের পাশে দুটি পাড়া- রেমাক্রি ও বাগান পাড়া। যাওয়ার পথের পাড়াগুলো হলো- আদামং পাড়া, হালিরাম পাড়া, মোমিও পাড়া, অংলা পাড়া, পুশাও পাড়া, রেমাক্রি পাড়া ও বাগান পাড়া। এই বাজারে সকাল বেলায় তেমন জনসমাগম নেই। দু’একটি নৌকা বাঁধা দেখা গেল। এই পাহাড়ের দেশে দু একজন পাহাড়ি ছোট ছোট বড়সি নিয়ে পিচ্ছিল পাথরের উপর বসে বা দাঁড়িয়ে মাছ ধরছে। এই নির্জন এলাকায় অনেক দূরে দূরে হঠাৎ মানুষের উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয় মানুষই দূর্গমকে সুগম করে। এরপর নদী পাথরের রাজ্য থেকে বেড়িয়ে আবার চলছে আর তার আপন পথে। পথে অনেকগুলো খরস্রোতা বাঁক আছে। পাহাড় থেকে ছোট ছোট ধারায় ঝরে পড়া ঝরনা। আরো আছে ছোট ছোট ছড়া সেগুলোর ছোট ছোট পানির ধারা নদীতে পড়ছে। একটু এগিয়ে গেলে একটা বেশ সুন্দর জলপ্রপাত।

উঁচু থেকে প্রায় ২০০ গজের মতো এলাকা নিয়ে পানি ৫-৬ ফুট নীচে সাঙ্গু নদীতে পড়ছে। পাহাড়ের উপর দিয়ে বয়ে চলা এই প্রপাতের দৃশ্য অপূর্ব। তবে নৌকা থেকে ছবি তুলতে পারিনি ঠিকমতো। এই প্রপাত থেকে উপরের ছড়া দিয়ে দূরে একটা সুন্দর ঝরনায় যাওয়া যায়। বর্ষাকালে দূর্ঘটনার সম্ভাবনা আছে বলে সেখানে যাওয়া আপতত বন্ধ।

আরো প্রায় অনেক রাস্তা সামনে নদী বয়ে চলছে আমরাও চলছি। পাহাড় এখানে অনেক খাড়া, উঁচু দূরে আকাশের টুকরা দেখা যায়। প্রায় বিশ কিলোমিটার পথ পার হয়ে জায়গাটার নাম ছোট মধু। এখানে আসতে অনেক পাড়া আছে। বাঁশিয়া পাড়া, জগচন্দ্র পাড়া, হানাচন্দ্র পাড়া, খেসাপ্রু পাড়া, সাথই পাড়া, বিলোরাম পাড়া ও হক্কুপাড়া।

আমরা চলছি সাঙ্গু নদীর পথে। সূর্যের তাপ বাড়ছে। খাড়াভাবে রোদ লাগছে। কখনো পাহাড় ছায়া দিচ্ছে। দূরে পাহাড়ের উপর আলো ছায়ার খেলা। আলো পড়ে সবুজের রং কখনো গাঢ় কখনো হালকা।

অপূর্ব দৃশ্য মন দিয়ে অনুভব করা যায়। চোখে দেখা যায় এ অপূর্ব রুপের খেলা। ক্যামেরায় ধরতে ব্যার্থ হলাম। সাধারণ ডিজিটাল ক্যামেরার চোখও নেই সেই মন তো কখনো থাকবে না।

প্রায় ৫ ঘণ্টার মতো চলার পর সাঙ্গু নদীর পাড়ের বড় একটা বাজার মদক এ পৌঁছালাম। এখানে আসার পথে পাড়াগুলো হলো- উচামং পাড়া, পুশামং পাড়া, মদক পাড়া, শ্রী মোহন পাড়া ও প্রায়প্রু পাড়া। সব মিলিয়ে প্রায় ৫৭ কিলোমিটার নৌপথে ভ্রমণ।

মদক বাজার বেশ বড়। কর্মব্যস্ত সব মানুষ। নদী চওড়া হয়ে গেছে। মাঝ নদীতে চড়া পড়েছে। আশপাশের মানুষজন নদী থেকে পানি নিচ্ছে। গোসল করছে। বেশ কর্মব্যস্ত সময় পার হচ্ছে তাদের। মদক এর পর জনপদ তেমন নেই। রিজার্ভ বন এলাকা। লিকরী পর্যন্ত মানুষ যায়। এখান থেকে বাঁশ কাঠ সংগ্রহ করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এরপর বাংলাদেশের সীমানা শেষ, মায়ানমারের শুরু। কিছু খেয়ে নিলাম, নদীর বাতাস ও ভ্রমণ ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয়। আকাশ একটু মেঘলা হচ্ছে। মদক এ বৃষ্টি হলে নদী আবার ফুঁসে উঠবে তাই দেরি না করে ফেরার পথ ধরলাম।

ফিরতি পথ স্রোতের অনুকূলে ঝুঁকি আছে জেনেও চললাম। এই ভ্রমণে পাহাড়ি নদী বয়ে চলার পথের নানা দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। ক্যামেরায় সব তোলা যায়নি তবে মনের চোখ সব কিছু দেখে নিয়েছে স্বচ্ছভাবে।

লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ ট্র্যাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন।

জেএমএস/জিকেএস