মতামত

মিয়ানমারকে সতর্ক হতে হবে

মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে আরাকান আর্মির (এ এ) সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ চলছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বিমান ও হেলিকপ্টার দিয়ে আক্রমণ চালাচ্ছে। এ এ জানিয়েছে যে, ম্রাউক-ইউ শহরে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে ২৮ আগস্ট তারা এই হামলা চালায়। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও এ এ’র মধ্যে শত্রুতা বৃদ্ধির কারণে সামরিক বাহিনী উত্তর রাখাইন এবং দক্ষিণ চিন রাজ্যে এএ’র বিরুদ্ধে বিমান হামলা এবং ভারী কামান ব্যবহার করেছে।

Advertisement

৩০ আগস্ট রাথিদং শহরে মা নিন টাং গ্রামের কাছে সংঘর্ষের ফলে উভয় পক্ষে হতাহত হয়েছে। ৩১ আগস্ট দক্ষিণ চিন রাজ্যের পালেতোয়া শহরের মায়েক ওয়া গ্রামের কাছে লড়াইয়ে ১০ জন সেনা সদস্য নিহত হয়েছে। উত্তর রাখাইন রাজ্যের মংডু’র পুলিশ ফাঁড়িতে ৩১ আগস্ট এ এ’র আর্মির সশস্ত্র সদস্যরা অতর্কিত হামলা চালায় এবং সেখানে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম জব্দ করে। তাদের এই হামলায় ১৯ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। ফাঁড়ি আক্রমণ এবং ১৯ পুলিশ কর্মকর্তা নিহতের জেরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সীমান্ত এলাকায় তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে বিমান ও হেলিকপ্টারের সাহায্যে আক্রমণ পরিচালনা করছে।

ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু, রেজু আমতলী, বাইশফাঁড়ি, তুইঙ্গাঝিড়ি, গর্জনবুনিয়া ও রেজু পাড়া পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকার ওপারে মিয়ানমার সেনা সদস্যরা এ এ’র বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তের রেজু আমতলী বিজিবি বিওপির আওতাধীন সীমান্ত পিলার ৪০-৪১-এর মাঝামাঝি স্থানে মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে ২৮ আগস্ট দুটি যুদ্ধবিমান এবং দুটি হেলিকপ্টার টহল দেয়। যুদ্ধবিমান থেকে প্রায় ৮ থেকে ১০টি গোলা এবং হেলিকপ্টার থেকে আনুমানিক ৩০-৩৫ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়।

সে সময় দুটি মর্টারশেল সীমান্ত পিলার ৪০ বরাবর বাংলাদেশের সীমানার আনুমানিক ১২০ মিটার ভেতরে এসে পড়ে। নিক্ষিপ্ত মর্টারশেলগুলো বিস্ফোরিত না হওয়ায় কেউ হতাহত হয়নি। ৩০ আগস্ট সারাদিন সীমান্তে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণ চলে এবং আকাশে মিয়ানমারের একটি হেলিকপ্টার আশপাশে টহল দিয়ে কয়েক দফা গোলাবর্ষণ করে। এই গোলাগুলির ঘটনায় সেখানে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

Advertisement

২০২১ সালের নভেম্বরে এ এ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি থাকার কারণে ফেরুয়ারি ২০২১ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর রাখাইন রাজ্যে আপাত শান্তি বিরাজ করছিল। এর আগে দুই বছর এ এ’র সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস লড়াই চলার কারণে হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল এবং ১ লাখেরও বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছিল।

রাখাইন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে ওই সময় সামরিক সরকার আরাকান আর্মিকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে সরিয়ে নেয় এবং এ এ’র সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার অসংখ্য লোককে মুক্তি দেয়। আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যে তাদের শক্তি ও সক্ষমতা বাড়িয়ে চলছিল, যা সামরিক সরকার মেনে নিতে পারছে না। বছরের শেষ দিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যের কিছু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যেমন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মংডু শহর ও প্রতিবেশী চিন রাজ্যের পালেতোয়া শহরের প্রধান প্রবেশদ্বার কিউকটাও শহরে নতুন কয়েকটা চেকপয়েন্ট বসিয়ে সৈন্য মোতায়েন করে ও আগে অবস্থান করা সৈন্য সংখ্যা বাড়ায় এতে এএ’র স্বাভাবিক চলাচলে বাধা আসে। মিয়ানমার সেনারা এ এ’র সাথে প্রশিক্ষণের জন্য সন্দেহভাজন রাখাইন যুবকদের আটক করে। ফলে তাদের সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

২ আগস্ট থেকে এ এ চিন রাজ্যের পালেতোয়া শহর ও এর আশপাশের সীমান্ত এলাকায় আক্রমণ শুরু করার পর সেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে নতুন করে এএ’র সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। প্রায় ছয়টি সীমান্ত ঘাঁটি এএ দ্বারা আক্রমণের পর বিমান এবং হেলিকপ্টার দিয়ে নিয়মিত হামলা চালানো হচ্ছে। এই এলাকার বাসিন্দারা মংডু শহর এবং পার্শ্ববর্তী বুথিডাং শহরে পালিয়ে যায়।

এএ দাবি করেছে যে, ৩১ আগস্ট পালেতোয়ার মায়েক ওয়া গ্রামের কাছে সংঘর্ষের সময় তারা ১০ জন সৈন্যকে হত্যা করেছে। গত ১ সেপ্টেম্বর রাখাইন রাজ্যের অ্যান শহরে এএ একটি সামরিক কনভয়ে অতর্কিত হামলা চালালে বেশ কয়েকজন সরকারি সেনা নিহত হন। সেনাবাহিনী পাল্টা জবাব দিতে বিমান ও হেলিকপ্টারের সহায়তায় এএ’র অবস্থানে আক্রমণ পরিচালনা করছে।

Advertisement

চলমান এই পরিস্থিতিতে আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের রোহিঙ্গাদের এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে আবারও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গা সংখ্যাগরিষ্ঠ মংডু অন্য এলাকায় বিপুলসংখ্যক সেনাসদস্য মোতায়েন করা হচ্ছে।

চলমান সংঘর্ষের কারণে মিয়ানমার আরও রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠাতে চাচ্ছে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নতুন করে একজন রোহিঙ্গাও যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে সেজন্য বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি), কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্টদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে এবং সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবিকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মর্টারশেল নিক্ষেপের বিষয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে মিয়ানমারের এসব কর্মকাণ্ড যে বন্ধুত্বের নিদর্শন নয়- সেটি দেশটির রাষ্টদূতকে ডেকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ, মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে চলমান স্থলযুদ্ধ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সীমান্তে টহল বাড়ানোর পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বৃদ্ধি করেছে। বিজিবি মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতের ওপরে নজর রাখছে ও অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ সব সময় শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানে বিশ্বাসী।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশ কখনো হস্তক্ষেপ করেনি। এরপর ও বাংলাদেশ পাঁচ বছর ধরে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ধীরে ধীরে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে উঠছে। চলমান এ ধরনের উসকানিমূলক ঘটনা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি নষ্ট করে যা কারও কাম্য নয়।

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো মিয়ানমার। চলমান সেনাশাসনের অবসান ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষে বিক্ষোভকারীরা পথে নামে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী বর্তমানে সারাদেশে প্রতিরোধ বাহিনী এবং জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর দ্বারা প্রতিদিন আক্রমণের সম্মুখীন হচ্ছে।

অভ্যুত্থান-পরবতী সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত দেশটিতে ২ হাজার ২০০ জনের বেশি নিহত, প্রায় ১৫ হাজার মানুষ গ্রেফতার ও ২৮ হাজার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জান্তা ও সেনাশাসনবিরোধীদের সংঘর্ষ এবং জান্তার অভিযানের কারণে দেশটিতে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে।

মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিক দেশগুলোকে আরও আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাতে হবে। আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে আসিয়ান, চিন, রাশিয়া ও জাতিসংঘকে মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাত বন্ধে এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত যেন আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দেখা না দেয় সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মিয়ানমার আমাদের উসকানি দিতে চায়, বাংলাদেশ এর জবাবে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে সহিষ্ণুতা প্রদর্শন ও সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সামরিক বাহিনীর বাড়াবাড়ির কারণে শুধু মিয়ানমারের অভ্যন্তরেই নয় বরং গোটা অঞ্চলের শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত দ্রুত মিয়ানমারে বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন : এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

এইচআর/ফারুক/এএসএম