জাগো জবস

মায়ের অনুপ্রেরণায় বিসিএস ক্যাডার হলেন তারেক

তারেক রহমান। ৪০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে (মেধাক্রম চতুর্থ) সুপারিশপ্রাপ্ত হন। তার শৈশব ও বেড়ে ওঠা টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায়। তার বাবা হাফিজুর রহমান পেশায় ব্যবসায়ী। মা কামরুন্নাহার গৃহিণী। তিনি ধনবাড়ী নওয়াব ইনস্টিটিউশন থেকে এসএসসি এবং ধনবাড়ী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগ থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করেন।

Advertisement

সম্প্রতি তার বিসিএস জয়ের গল্প ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইসমাম হোসাইন—

জাগো নিউজ: আপনার শৈশবের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই—তারেক রহমান: আমার শৈশব অন্যদের মতো দুরন্তই ছিল। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায় আমার ছোটবেলা কাটিয়েছি। গ্রামে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। পরে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ক্যাডেট কোচিং করি। অনেকগুলো স্কুলে পড়াশোনা করেছি। এলাকায় ধনবাড়ী কলেজিয়েট স্কুল, ঢাকায় সোডা, টাঙ্গাইলের সৃষ্টিসহ বেশ কিছু স্কুলে পড়েছি। আম্মা বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে অনেক দুষ্টু ছিলাম। এখনো আছি। ধরন শুধু পাল্টেছে। এ জন্য বারবার স্কুল বদল করতে হয়েছিল। সময়মতো স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, খেলাধুলা করা তো ছিলই। যখন টাঙ্গাইলে সৃষ্টিতে পড়তাম, সেটা বেসরকারি স্কুল ছিল। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষা দিতে হয়েছিল একটি সরকারি স্কুল থেকে।

জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?তারেক রহমান: এটি ছিল নবম শ্রেণির বছর। আর্থিক প্রতিবন্ধকতা নয়। নবম-দশম শ্রেণিতে আমার পড়ালেখায় গ্যাপ পড়ে। আমি পড়ালেখা বাদ দিয়েছিলাম। পরে পড়ালেখায় ব্যাক করাই আমার লাইফে বড় স্ট্রাগল ছিল। দুই বছর আমি কোনো পড়ালেখা করিনি। টেস্ট পরীক্ষা দিতে গিয়ে আবার পড়ালেখা শুরু করি। পরীক্ষার আগে একটু পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিই। টেস্টের পরে তিন মাস সময় ছিল। ওই সময়টা আমি অনেক পড়েছি। এই যে দেড়-দুই বছর গ্যাপ পড়েছে, এটাই আমার সবচেয়ে বড় স্ট্রাগল। ওই জায়গা থেকে কাম ব্যাক করা ছিল বড় একটা চ্যালেঞ্জ। আমার মা খুব কান্নাকাটি করতেন সারাদিন। আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। আল্লাহ মায়ের দোয়া কবুল করেছেন। সেই থেকে আমি ব্যাক করেছি।

Advertisement

আমার যেদিন বিবিএর রেজাল্ট দেয়; সেদিন এবং আমি যেদিন ৩৭তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডার পাই, আমার মা সারাদিন কান্নাকাটি করেছেন। কারণ অনেকেই বলেছেন, ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে মায়ের প্রশ্রয়ে। ছেলে নষ্ট হলে তো মায়ের দোষ দেন সবাই। সেই কথা মনে করে আম্মা এখনো কান্না করেন। মা বলেন, সেই তুমি আজকে চাকরি করছো, অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছো। সবাই বলতেন, অমুকের ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু আজকে আমার এটা ভালো লাগে তুমি অনেকগুলো চাকরি পেয়েছো। এগুলোই আমার লাইফে বড় স্ট্রাগল ছিল। শুধু আমার নয়, আমার মায়েরও স্ট্রাগল ছিল।

জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?তারেক রহমান: বিসিএসের স্বপ্ন দেখি এমবিএ শেষ করে। সব সময় চিন্তা ছিল দেশের বাইরে যাব। আমেরিকা অথবা কানাডা যাব। অন্য কোনো দেশ নয়। আমার কাজিন, কাকা সবাই কানাডা ও আমেরিকায় থাকেন। আমি ওইভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলাম। ইউনিভার্সিটি লাইফে ইংলিশে ভালো করার জন্য আমেরিকান কর্নার ও ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে সারাদিন সময় কাটাতাম। তারপর আইইএলটিএস দিয়ে স্কোরও পেয়েছিলাম সেভেন। সেভেন পাওয়ার পর বাসা থেকে বলে দেয়, বাবা-মায়ের একটাই সন্তান; বিদেশ যেতে হবে না। দেশে যা করার করো। অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছো, তুমি যা-ই করো, দেশে থাকতে হবে। ছোট চাকরি করো, বড় চাকরি করো বা পারিবারিক বিজনেস দেখো, যা করো দেশেই করো। তাতে বিদেশ যাওয়ার ভূত মাথা থেকে নেমে গেল। আমার এমবিএর পরীক্ষার পর বিসিএসের প্রিপারেশন নিতে শুরু করলাম। আস্তে আস্তে বিসিএসের দিকে ঝুঁকলাম। বিসিএসকে ভালোবেসে ফেললাম।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?তারেক রহমান: মনে আছে, ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম গেলাম পহেলা বৈশাখ পার করে। তখন গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি এমবিএ ভাইভা শেষ করে গ্রামের বাড়িতে আসি। এপ্রিল মাসে আবার চট্টগ্রাম যাই। সেখারে আমার তিন-চার জন বন্ধু ছিল। ওদের সঙ্গে গিয়ে কোচিংয়ে ভর্তি হই। ওই সময় থেকে চাকরির পড়ালেখা শুরু করলাম। বাসায় পড়াশোনা করতাম, কোচিং করতাম রেগুলার। প্রিলি, রিটেন, ভাইভার জন্যই কোচিং করেছি। কোচিংয়ে ক্লাস করতাম, পরীক্ষা দিতাম। এভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছি।

জাগো নিউজ: আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?তারেক রহমান: ৩৭তম বিসিএস থেকে আমার যাত্রা শুরু। প্রথম ৩৭তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডার পাই। পরে অনেকটা ভেঙে পড়েছিলাম। আমার বন্ধু-বান্ধব সবাই জেনারেল ক্যাডার পেলেন, আমি শিক্ষা ক্যাডার পেলাম। আমার মা আমাকে সাহস দিতেন। তারপর তো আমি বিয়ে করলাম। আমার স্ত্রী সাহস দিতো। আমার মনে আছে, আমি যখন ৪০তম বিসিএসে ভাইবা দিতে গিয়েছি; তখন স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন সকাল বেলা আমার স্ত্রী নামাজ পড়ে অনেক দোয়া করে সঙ্গে গিয়েছিল। যেদিন আমার পরীক্ষা থাকতো; সেদিন স্ত্রীর মানসিক অস্থিরতা লক্ষ্য করতাম। অনেকই সাপোর্ট দিয়েছেন। বাবা-মা, স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধবসহ অনেক নাম আছে। তাই কারো নাম মেনশন করতে চাচ্ছি না। বন্ধুরা অনেক সাহায্য করেছে। একটা জিনিস বিশ্বাস করি, আমার একাডেমিক রেজাল্ট এবং বিসিএস রেজাল্টের জন্য বন্ধুরাই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। তাদের সঙ্গে গ্রুপ স্ট্যাডি করতাম। এটি আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছে। এটা না করলে পড়ালেখা মনে থাকতো না। যারা আমার রুমমেট ছিলো, তারাও সাহায্য করেছে। তারা আমার পড়া ধরতো। বিয়ের পর স্ত্রীও আমার পড়া ধরতো। এভাবে সবাই হেল্প করেছে।

Advertisement

জাগো নিউজ: নতুনরা প্রিলির জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?তারেক রহমান: আমি প্রিলির ক্ষেত্রে একটা কথা বলি এবং আমি যেটা মনে করি, বিসিএসের মূল পরীক্ষা হচ্ছে প্রিলি। প্রিলিতে পরীক্ষা দেয় ৪ লাখ ১০ হাজার থেকে ৪ লাখ ৫০ হাজার। এদের মধ্যে টেকে কত? ১৫ থেকে ২০ হাজারের মতো। তার মানে, যদি চার লাখ পরীক্ষা দেয়; এর ভেতর টিকছে ২০ হাজার। আমি রাউন্ড ফিগার ধরলাম। অর্থাৎ ৩ লাখ ৮০ হাজার একটি পরীক্ষায় বাদ। আপনাকে তো প্রিলিতে ফার্স্ট হতে হবে না, কিন্তু টিকতে হবে। যার প্রিলি প্রিপারেশন যত ভালো হবে; তার রিটেন ও ভাইবা প্রিপারেশন তত ভালো হবে। অনেকের মধ্যে একটা টেন্ডেন্সি আছে, একটা সাবজেক্টের জন্য পাঁচ থেকে সাতটা বই পড়েন। আমি বলতে চাই, কেউ যদি বাংলা বই পড়েন; সেই বইটাকেই ৫-৭ বার রিভিশন দেন। এক বাংলার জন্য পাঁচটি বই পড়ার দরকার নেই। যে কোনো একটি পড়লেই হবে। বই সবই এক। শুধু বলতে চাই, এক বই বারবার পড়ার জন্য। এক বই পাঁচবার পড়ার জন্য, পাঁচটা বই একবার করে পড়ার জন্য নয়। বই একটা শেষ করতে পারলে ওটাকেই বারবার রিভিশন দিতে হবে। কারণ এখানে মনে রাখার খেলা, রাইট টাইমে রাইট বৃত্ত ভরাট করতে হবে। আসলে এটি নলেজ ইজ পাওয়ার নয়, অ্যাপ্লাইড নলেজ ইজ পাওয়ার। নলেজ আমার আছে কিন্তু আমি ঠিকমত বৃত্ত ভরাট করতে পারলাম না। তাহলে ওই নলেজ দিয়ে লাভ কী? পরীক্ষায় নলেজটাকে অ্যাপ্লাই করতে হবে। প্রিলির জন্য একটাই সাজেশন, একটাই বই পড়েন। বারবার রিভিশন দেবেন। যার যে বই পড়তে ভালো লাগে, সেটাই পড়বেন।

জাগো নিউজ: বিসিএস ভাইবার প্রস্তুতি কেমন হবে?তারেক রহমান: ভাইবার জন্য তো কোনো সিলেবাস নেই। ভাইবা বোর্ড পুরোটাই ডিপেন্ড করে স্যারদের ওপর। তবে এখানে যেটা দেখা হয়, আপনি রিটেন-প্রিলি পরীক্ষা দিয়েছেন। তার মানে আপনি চার লাখ পরীক্ষার্থীর মাঝখান থেকে উঠে এসেছেন। অর্থাৎ তিন লাখ ৯০ হাজার মানুষকে পেছনে ফেলে এসেছেন, মানে আপনি যোগ্য। ভাইভায় কী দেখা হয়? আপনার কথা বলার ধরন। আপনি যেটা পারেন না, সেটা বলার একটা উপায় আছে। ‘সরি স্যার, আমার জানা নেই’। ‘আমি পারি না’। ভাইভায় প্রশ্ন না পারার ওপরে চাকরি নির্ভর করে না। ভাইবা বোর্ডে আপনি একদম নরমাল থাকবেন যে, আমি এটাই। ভাব নেওয়ার কিছু নেই। প্রশ্নের উত্তর জানেন না, সহজ ভাষায় বলে দেবেন—আমি জানি না। এখানে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। ভাইভা বোর্ড খুবই ফ্রেন্ডলি, এখানে হাসিমুখে থাকবেন। নার্ভাস হবেন, এটা স্বাভাবিক। যিনি প্রথম হন; তিনিও নার্ভাস থাকেন। এই নার্ভাসনেস কাটানোর জন্য স্মার্টভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করতে হবে।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রায় সোশ্যাল মিডিয়া কি কোনোভাবে কাজে এসেছে?তারেক রহমান: পড়ালেখার ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া বা বিভিন্ন ধরনের অ্যাপস ব্যক্তিগতভাবে কাজে লাগাতে পারিনি বা পারি না। অন্যরা পারেন হয়তো। ফেসবুকে অনেকগুলো গ্রুপ আছে, হাজার হাজার পিডিএফ আছে, এগুলো অনেকেই পড়েন। কিন্তু আমি পড়তে পারি না। আমার পড়ার জন্য খাতা, কলম, বই লাগে। তবে অনলাইন যেটা হেল্প করছে; সেটা হলো—বিভিন্ন এমসিকিউ টেস্ট অ্যাপস। প্রিলির জন্য বিভিন্ন অ্যাপসে পরীক্ষা দিতাম। এই পরীক্ষা যে কোনো জায়গায় বসে দেওয়া যায়। গাড়িতে বা অফিসে বসে, পাঁচ-দশ মিনিট কাজ নেই, একটা পরীক্ষা দিয়ে দিতাম। টাইম দেওয়া থাকে সাত মিনিট; পাঁচ মিনিটে পরীক্ষা শেষ করার চেষ্টা করতাম। ওই টাইমের মধ্যেই পরীক্ষা শেষ করতাম। কিন্তু ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের টপিক পড়বো বা পিডিএফ পড়বো—এসব পারতাম না।

জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?তারেক রহমান: পরিকল্পনা বলতে এখন যেহেতু সিভিল সার্ভিসে জয়েন করবো। সিভিল সার্ভিসে ট্রেনিং করিয়ে দক্ষ অফিসার হিসেবে সবাইকে তৈরি করা হয়। সে দক্ষতা ভালোভাবে অর্জন করতে চাই। সরকারের যেসব উন্নয়নমূলক কাজ আছে, সেগুলো করতে চাই। মানুষকে ভালোভাবে সেবা দিতে চাই। ক্যাডার হওয়া সহজ, কিন্তু সেই ক্যাডারশিপ ধরে রাখা অনেক কঠিন। সেটা আমি ধরে রাখতে চাই। একজন ভালো অফিসার হিসেবে চাকরিটা শেষ করতে চাই।

এসইউ/এএসএম