প্রায় এক মাস ধরে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় দেশের শেয়ারবাজার। এপ্রিলে তলানিতে নেমে যাওয়া লেনদেনের গতিও এখন বেড়েছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) নিয়মিত হাজার কোটি টাকার ওপর লেনদেন হচ্ছে। একদিকে বিভিন্ন সিকিউরিটিজের দাম বাড়া, অন্যদিকে লেনদেনের গতি বাড়ায় মূলধন হারানোর আতঙ্ক ভুলে মুনাফা তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন বিনিয়োগকারীরা। নতুন বিনিয়োগকারীও আসছে বাজারে। সূচক, লেনদেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা- সবকিছু মিলিয়ে প্রায় এক বছর পর ফুরফুরে অবস্থায় রয়েছে শেয়ারবাজার। এ পরিস্থিতিতে সতর্কতার সঙ্গে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
Advertisement
তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের বাকি আর দেড় বছর। এই নির্বাচনের আগে সরকার শেয়ারবাজারকে একটা ভালো অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যার ফলস্বরূপ দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাব গণনা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাব গণনা করা হবে ক্রয়মূল্য হিসেবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা লিজিং কোম্পানির বিনিয়োগও ক্রয়মূল্য হিসেবে গণনা করা হবে। ফলে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হলো।
আরও পড়ুন: শেয়ারবাজারে দেশি বিনিয়োগকারী বাড়লেও কমেছে বিদেশি
তারা আরও বলছেন, সরকার যে শেয়ারবাজার ভালো করতে চায় তা সাম্প্রতিক সময়ে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার পাশাপাশি আর্থিক খাতের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান গভর্নরকেও শেয়ারবাজারবান্ধব হিসেবে মনে করা হয়। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তেও এ চিত্র ফুটে উঠেছে। সবকিছু মিলিয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরেছে শেয়ারবাজার। এতে বেশিকিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেশি বেড়েছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেশি নিচে (তুলনামূলক কম) রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সার্বিক তথ্য ভালো করে যাচাই-বাছাই করে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
Advertisement
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মহামারি করোনার প্রকোপ শুরু হলে ২০২০ সালে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধস নামে। দরপতন এতটাই ভয়াবহ রূপ নেয় যে পরিস্থিতি সামাল দিতে টানা ৬৬ কার্যদিবস লেনদেন বন্ধ রাখা হয়। এমন পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন করে সরকার। কমিশনে নতুন চেয়ারম্যানের পাশাপাশি নতুন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়। নতুন কমিশনের বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে পতন কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় শেয়ারবাজার। এক বছরের বেশি সময় ধরে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় থাকে বাজার। ফলে গত বছরের ১০ অক্টোবর রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক।
আরও পড়ুন: দুদিন পর উত্থানে ফিরলো শেয়ারবাজার
তবে এরপর আবার ছন্দপতন ঘটে বাজারে। দেখা দেয় টানা দরপতন। বিশেষ করে চলতি বছরের মার্চে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বড় ধরনের পতনের মধ্যে পড়ে শেয়ারবাজার। দরপতনের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে প্রতিটি সিকিউরিটিজের (শেয়ার ও ইউনিট) ফ্লোর প্রাইস (সর্বনিম্ন দাম) বেঁধে দেয় বিএসইসি। এর মাধ্যমে থামানো হয় দরপতন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আসতে থাকে শেয়ারবাজারবান্ধব একের পর এক সিদ্ধান্ত।
গত ৪ আগস্ট শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাব সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোনো ব্যাংক অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ধারণের হিসাবায়নে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা (এক্সপোজার লিমিট) নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ক্রয়মূল্যকেই ‘বাজারমূল্য’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
Advertisement
এরপর ১৪ আগস্ট আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা (এক্সপোজার লিমিট) নির্ধারণের ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত শেয়ার, ডিবেঞ্চার, করপোরেট বন্ড, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইউনিট এবং শেয়ারবাজারে অন্যান্য বিনিয়োগ হিসাবায়নের ক্ষেত্রে বাজারমূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্য বিবেচনা করতে হবে।
এর আগে শেয়ারবাজারে প্রবাসীদের বিনিয়োগ সহজ করার লক্ষ্যে গত ২৭ জুলাই ব্যাংকগুলোকে একটি নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বলা হয়, প্রবাসীদের ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রে কাগজপত্র বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের সত্যায়নের শর্ত আরোপ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কোনো নির্দেশনায় এই শর্তের কথা উল্লেখ নেই। তাই প্রবাসীদের ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস থেকে সত্যায়নের দরকার নেই।
শেয়ারবাজারের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এভাবে একের পর এক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসায় প্রভাব পড়ে বাজারে। ফলে গত এক মাসে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক প্রায় পাঁচশ পয়েন্ট বেড়ে গেছে। বাজার মূলধন বেড়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শেষ ১৬ কার্যদিবসের মধ্যে ১৩ দিনই শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী ছিল। চলতি সপ্তাহের প্রথম দুই কার্যদিবস কিছুটা দরপতন হলেও মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) আবার শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখিতার দেখা মিলেছে।
এ বিষয়ে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সম্প্রতি একাধিক সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। ফলে শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরেছে। তবে রোববার (৪ সেপ্টেম্বর) ও সোমবার (৫ সেপ্টেম্বর) দরপতন দেখা গেছে। আমি এ দরপতনের কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখি না।
তিনি বলেন, আমি মনে করি সার্বিকভাবে বর্তমানে শেয়ারবাজার বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত। তবে কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকতে হবে। বাজারে এখনো অনেক ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম কম মূল্যে আছে। বিনিয়োগের আগে বিনিয়োগকারীদের সার্বিক তথ্য বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করতে হবে। জুয়াড়িদের পেছনে দৌড়ে বিনিয়োগ করলে লাভের বদলে লোকসানের মধ্যে পড়তে হতে পারে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজার একটা ইতিবাচক ধারায় যাচ্ছে। বিএসইসি-বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়ে যেসব ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি করেছে। তবে গত কয়েকদিনে ফ্লোর প্রাইস নিয়ে একটা গুজব ছড়িয়েছে। শেয়ারবাজারে এটা কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এরপরও আশার কথা হলো, বিএসইসির চেয়ারম্যান পরিষ্কার বলে দিয়েছেন- ফ্লোর প্রাইস উঠানোর বিষয়ে কোনো আলোচনা এখন নয়।
আরও পড়ুন: সাড়ে ছয় হাজার পয়েন্ট ছাড়ালো সূচক
তিনি বলেন, রবি ও সোমবার যে দরপতন হয়েছে, তা স্বাভাবিক মূল্য সংশোধন। এখন লেনদেনের ফ্লো বেশ ভালো। এটা বিনিয়োগকারীদের আস্থার বিষয়। বিনিয়োগকারীরা যখন দেখেন বাজার ভালো তখন তারা আসেন। এখন বাজারে নতুন বিনিয়োগকারী এবং টাকা এসেছে। নতুন বিও হিসাবও বেড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী? এমন প্রশ্নে জাগো নিউজকে ছায়েদুর রহমান বলেন, সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করে বিনিয়োগ করতে হবে। যেসব শেয়ারের দাম বেশি ওঠা-নামা করে, সেগুলোতে বিনিয়োগ না করা। কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো করে বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম এখন ১০ পিই’র নিচে। কেউ যদি ১০ পিই’র নিচে না কিনে ৫০ পিই’র ওপরে কেনেন- এর দায়দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।
বাজারে এসেছে ১০ হাজার নতুন বিনিয়োগকারীগত এক মাসে শেয়ারবাজারে ১০ হাজারের বেশি নতুন বিনিয়োগকারী এসেছে। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসের শেষ কার্যদিবস (৩১ জুলাই) বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব ছিল ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৮৮৪টি, যা বেড়ে এখন (৫ সেপ্টেম্বর) দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ২২৫টিতে। অর্থাৎ গত এক মাসে ১০ হাজার ৩৪১টি বিও হিসাব বেড়েছে।
সূচক ও লেনদেনগত ২৮ জুলাই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্যসূচক ছিল ৫ হাজার ৯৮০ পয়েন্ট। সেখান থেকে সূচক বেড়ে এখন ৬ হাজার ৪৭০ পয়েন্টে উঠে এসেছে। অর্থাৎ এক মাসে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক বেড়েছে ৪৯০ পয়েন্ট। তবে গত বছরের শেষ কার্যদিবসে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ছিল ৬ হাজার ৮৫৩ পয়েন্ট। ফলে গত বছরের শেষ কার্যদিবসের তুলনায় মূল্যসূচক এখনো ৩৮৩ পয়েন্ট কম রয়েছে।
এদিকে, চলতি বছরের এপ্রিলে ডিএসইতে লেনদেন কমে চারশ কোটি টাকার নিচে নেমে গিয়েছিল। এখন প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার ওপর লেনদেন হচ্ছে। শেষ নয় কার্যদিবসের মধ্যে সাত কার্যদিবসেই ডিএসইতে দেড় হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদের হয়েছে। এর মধ্যে দুদিন দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়।
বাজার মূলধনপ্রায় এক মাস ধরে বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকায় ডিএসইর বাজার মূলধন ২৭ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা বেড়েছে। গত ২৮ জুলাই ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ৯২ হাজার ১১৩ কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে ৫ লাখ ১৯ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকায় উঠে এসেছে।
এমএএস/কেএসআর/এএসএম