খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কৃষিখাতকে বরাবরই অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে সরকার। এর সুফলও মিলেছে। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষিখাতে ভর্তুকিসহ আছে নানান সুবিধা। উৎপাদন অব্যাহত রাখতে ভর্তুকি দিয়ে কমমূল্যে কৃষকদের সারও সরবরাহ করা হয়। ভর্তুকির সারের মধ্যে টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) অন্যতম। সরকারের এই সুবিধার অপব্যবহার করছে একটি চক্র। সার পরিবহনের আড়ালে চক্রটি ভেজাল মিশিয়ে সেই সার ছড়িয়ে দিচ্ছে সারাদেশে। এ কাজে জড়িত একশ্রেণির পরিবহন ঠিকাদার সিন্ডিকেট।
Advertisement
অভিযোগ রয়েছে, সার পরিবহনের ঠিকাদারদের সঙ্গে করা চুক্তির দুর্বলতার কারণে সহজেই ভেজাল মেশাতে পারছে চক্রটি। এর পেছনে সার উৎপাদনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান টিএসপি কমপ্লেক্স লিমিটেডের (টিএসপিসিএল) একশ্রেণির কর্মকর্তার যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে।
২০২১ সালে সারাদেশে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) জন্য বেশ কয়েকটি গোডাউন নির্মাণ করে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। সরকারি কারখানায় উৎপাদিন সার জেলা পর্যায়ে বাফার গোডাউনে মজুত করে স্থানীয় ডিলারদের সরবরাহ করে বিসিআইসি। সারে ভেজাল মেশানো ও বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে বাফার গোডাউন নির্মাণ করা হলেও সেই সুফল মিলছে না। এখন বাফার গোডাউনে যাওয়ার আগেই সারে ভেজাল মেশাচ্ছেন পরিবহন ঠিকাদাররা। ফলে নিজেদের অজান্তেই ডিলারদের ভেজাল সার সরবরাহ করছে বাফা।
চলতি বছরের মার্চ মাসে যশোরে বাফার গোডাউনে ভেজাল সার ধরা পড়ে। এ নিয়ে ঠিকাদার ও এক প্রতিনিধিসহ দুজনের বিরুদ্ধে যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলাও হয়। ওই মামলায় দুই আসামি উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। তবে এরপর পুলিশ আর কাউকে আইনের আওতায় আনতে পারেনি। এমনকি যেসব ট্রাক পুলিশ জব্দ করেছিল, সেসব ট্রাকের চালক-হেলপারদেরও আইনের আওতায় আনা হয়নি।
Advertisement
টিএসপিসিএল সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অবস্থিত টিএসপি কমপ্লেক্স সার কারখানা থেকে গত ২৭ থেকে ২৯ আগস্ট তিন চালানে ১৮টি ট্রাকে টিএসপি সার বগুড়া বাফার গোডাউনে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ২৭ আগস্ট ১২ ট্রাক, ২৮ আগস্ট ৫ ট্রাক এবং ২৯ আগস্ট এক ট্রাক সার বগুড়ায় যায়। এগুলোর মধ্যে ৭ ট্রাক সার ২৯ আগস্ট সকালে বগুড়ায় বাফার গোডাউনে পৌঁছায়। ওইদিন সকালেই একটি ট্রাক (ঢাকা মেট্রো-ট-১৬-৯৮৮৩) থেকে সার আনলোড করার সময় আগের দেওয়া টিএসপি সারের সঙ্গে ভিন্নতা দেখতে পান বাফার গোডাউন ম্যানেজার মোস্তফা কামাল। বস্তাগুলোতে অসামঞ্জস্যতা দেখে তিনি সার আনলোড বন্ধ করে দেন। এরপর তিনি এ বিষয়ে অবহিত করে টিএসপি ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দেন। পরে বগুড়া জেলা প্রশাসক বিষয়টি জানতে পেরে ওই সাত ট্রাক থেকে সারের নমুনা সংগ্রহ করে দ্রুত পরীক্ষার নির্দেশ দেন। পরদিন (৩০ আগস্ট) সবগুলো ট্রাক বগুড়া বাফার গোডাউনে পৌঁছায়। এসব সার পরিবহনের দায়িত্বে ছিল চট্টগ্রাম মহানগরীর দেওয়ানহাট এলাকার এম এইচ ভবনের মেসার্স এম এইচ আর করপোরেশন। সার পরিবহনে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন আবু তাহের নামে আরেক ব্যক্তি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ও বগুড়া বাফার গোডাউনের ম্যানেজার মোস্তফা কামাল জাগো নিউজকে বলেন, বাফার গোডাউনে আগে যেসব সার এসেছে, তা থেকে ভিন্নতা পাওয়ায় ২৯ আগস্ট সার আনলোড বন্ধ করে দেই। এরপর আমরা বিষয়টি টিএসপি কর্তৃপক্ষসহ স্থানীয় জেলা প্রশাসনকে জানাই। এর মধ্যে টিএসপি কর্তৃপক্ষ টিএসপিসিএলের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান রসায়নবিদ রেজাউল হককে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্য করা হয় টিএসপিসিএলের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মাজহারুল ইসলামকে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আওয়াল হোসেনকে করা হয় সদস্য সচিব। ৩০ আগস্ট ওই কমিটি বগুড়ায় গিয়ে ১৮টি ট্রাক থেকে সারের নমুনা সংগ্রহ করে।
এদিকে, বগুড়া জেলা প্রশাসনের তদন্ত দল রাজশাহী মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে নমুনা পরীক্ষা করে সবগুলো ট্রাকেই ভেজাল সারের অস্তিত্ব পায়। এরপর টিএসপির তদন্ত কমিটি গত ১ সেপ্টেম্বর রাতে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে ওই সাতটিসহ ৯টি ট্রাকে ভেজাল সারের অস্তিত্ব আছে বলে জানানো হয়।
এ ব্যাপারে টিএসপিসিএলের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান রেজাউল হক জাগো নিউজকে বলেন, আমরা ১৮ ট্রাক থেকে নমুনা নিয়েছিলাম। এরই মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে টিএসপি কর্তৃপক্ষ। নমুনা পরীক্ষায় সারে ভেজালের বিষয়টি পাওয়া গেছে।
Advertisement
এদিকে, গত ২ সেপ্টেম্বর টিএসপিসিএলের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মাজহারুল ইসলাম বাদী হয়ে পরিবহন ঠিকাদার মেসার্স এম এইচ আর করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী মো. মোয়াজ্জেম হোসেনসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় মামলা করেন। মামলায় পরিবহন ঠিকাদারের প্রতিনিধি মো. আবু তাহের, ভেজাল সার পরিবহন করা ট্রাকগুলোর চালক-হেলপারদের আসামি করা হয়। এসব মামলায় ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব ও পুলিশ। তবে মূল ঠিকাদার মোয়াজ্জেম হোসেন ও প্রতিনিধি আবু তাহের এখনো গ্রেফতার হননি।
ভেজাল সার পরিবহন করা ট্রাকগুলো হলো- ঢাকা মেট্রো-ট-১৮-৯৮৮৩, ঢাকা মেট্রো-ট-১৮-০৫৮৭, বগুড়া-ট-১১-১০৪৯, ঢাকা মেট্রো-ট-১৬-৯৩২৩, ঢাকা মেট্রো-ট-১৪-৫৪০১, ঢাকা মেট্রো-ট-১৪-৭৮৩৪, ঢাকা মেট্রো-ট-১৬-৫৩৮৫, ঢাকা মেট্রো-ট-১৮-৭৫২৩ এবং ঢাকা মেট্রো-ট-১৪-০৮৯৯। এসব ট্রাকে ১২৬ টন ভেজাল সার পাওয়া যায়।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেলিম রেজা শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) জাগো নিউজকে বলেন, টিএসপি কমপ্লেক্সের পক্ষ থেকে ভেজাল সারের বিষয়ে একটি মামলা হয়েছে। মামলায় ৯ ট্রাকের চালক-হেলপার মিলিয়ে ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম টিএসপি কমপ্লেক্স থেকে সারাদেশে বাফার ২৫টি গোডাউনে সার পাঠানো হয়। সার পরিবহনের জন্য বেশ কয়েকজন ঠিকাদার রয়েছেন। এসব পরিবহন ঠিকাদারের অনেকে জড়িয়ে পড়েছেন সার ভেজাল ও কালোবাজার চক্রে। সবশেষ বগুড়ায় বাফার গোডাউনে ১৮ ট্রাকে ২৫২ টন সার পাঠায় টিএসপি কমপ্লেক্স। এর মধ্যে ১২৬ টন সারে ভেজাল পাওয়া যায়। এসব সার পরিবহনের দায়িত্বে ছিল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স এম এইচ আর করপোরেশন।
টিএসপি সূত্রে জানা যায়, এম এইচ আর করপোরেশনের সঙ্গে ২০ হাজার ১২৫ টন টিএসপি সার পরিবহনের চুক্তি হয়েছে। বাফার ১০টি গোডাউনে এসব সার পৌঁছে দিতে চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি এ চুক্তি হয়। এরপর থেকে সার পরিবহন করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তি ও কার্যাদেশের শর্ত মতে, বগুড়ায় প্রতি টন দুই হাজার ৫শ টাকা করে দুই হাজার ২৫০ টন সার পরিবহন করবে প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়াও রাজশাহীতে প্রতি টন দুই হাজার ৬শ টাকা করে এক হাজার ৫শ টন, সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়িতে প্রতি টন দুই হাজার ৫৫০ টাকা করে দুই হাজার ২৫০ টন, গাইবান্ধায় প্রতি টন দুই হাজার ৮৫০ টাকা করে এক হাজার ৫শ টন, লালমনিরহাট মহেন্দ্রনগর বাফার গোডাউনে প্রতি টন তিন হাজার ৫০ টাকা করে এক হাজার ৫শ টন সার পরিবহন করার বিষয় নির্ধারণ করা হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী দিনাজপুরে প্রতি টন তিন হাজার ১শ টাকা করে এক হাজার ৭৫০ টন, ঠাকুরগাঁওয়ে প্রতি টন তিন হাজার ১শ টাকা করে এক হাজার ৫শ টন, মাদারীপুরের টেকেরহাট গোডাউনে প্রতি টন দুই হাজার ৯শ টাকা করে তিন হাজার টন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডে প্রতি টন দুই হাজার টাকা করে এক হাজার ৮৭৫ টন এবং সিলেট শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে প্রতি টন দুই হাজার ৫শ টাকা করে তিন হাজার টন টিএসপি সার পরিবহন করার কথা। সব মিলিয়ে ৫ কোটি ৪১ লাখ ৩৭ হাজার ৫শ টাকায় (আনলোডিং, স্ট্যাকিং খরচ ও ভ্যাটসহ) ২০ হাজার ১২৫ টন টিএসপি সার পরিবহন নির্ধারিত হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মেসার্স এম এইচ আর করপোরেশন পরিবহন ঠিকাদার কাজ নেওয়ার পর থেকে মাঝিরঘাটের পরিবহন ব্যবসায়ী মেসার্স মুন এন্টারপ্রাইজের মিজানুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে সারে ভেজাল করে আসছিল। বেশ কিছু ট্রাক মালিক ও চালকদের নিয়ে তার একটি শক্ত সিন্ডিকেট রয়েছে। এর আগে যশোরে ধরা পড়া চালানে ভেজাল মেশাতে জড়িত ছিলেন মিজানুর রহমান।
এ ব্যাপারে মেসার্স এম এইচ আর করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আমাদের সারে কোনো ভেজাল ছিল না। আমাদের ফাঁসানো হয়েছে।
মেসার্স মুন এন্টারপ্রাইজের মিজানুর রহমানের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি পুরো বিষয়টি অস্বীকার করেন। মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আমি মুন এন্টারপ্রাইজ কিংবা মিজান নামে কাউকে চিনি না। এ ধরনের কারও সঙ্গে আমার ব্যবসা নেই।’
তবে তার বক্তব্যে ভিন্নতা পাওয়া গেছে তারই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারের বক্তব্যে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শনিবার মেসার্স এম এইচ আর করপোরেশনের ম্যানেজার আসফাক উদ্দিন আহমেদ হিরু জাগো নিউজকে বলেন, আমরা টিএসপির ক্যারিং কন্ট্রাক্টর, পরিবহন করি। বিসিআইসির আটটি প্রতিষ্ঠানের পণ্য আমরা পরিবহন করি। বিএডিসির ১০ লাখ টন সার আমরা পরিবহন করেছি।
মুন এন্টারপ্রাইজের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মুন এন্টারপ্রাইজ আমাদের সব সময় গাড়ি সরবরাহ করে। সে-ই বড় কালপ্রিট (অপরাধী)। সে-ই আমাদের বিপদে ফেলেছে। ৩০ বছর ধরে আমরা লাখ লাখ টন মাল পরিবহন করেছি। আমাদের কোনো খারাপ রেকর্ড নেই।
এ বিষয়ে জানতে কয়েকদিন ধরে মেসার্স মুন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমানের মোবাইলফোনে কল দিলে প্রথমে রিসিভ করে সাংবাদিক পরিচয় জানার পর ব্যস্ত জানিয়ে লাইন কেটে দেন। শনিবার (৩ আগস্ট) দুপুরে কল দেওয়া হলে তার ফোনটি রিসিভ করেন সাগর নামে এক ব্যক্তি। সেসময় সাগর বলেন, ‘আমি মুন এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী। অফিসে কাজ করি। স্যারের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। গতকাল (শুক্রবার) সকালে ফোন অফিসে রেখে স্যার (মিজানুর রহমান) বেরিয়ে গেছেন। এখনো অফিসে আসেননি। তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি।’
বগুড়ায় পাঠানো সারে ভেজাল মেশানোর ঘটনায় গ্রেফতাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে জানিয়েছে, বগুড়ায় বাফা গুদামের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া ট্রাকগুলোতে ভেজাল সার তোলা হয় সাভারের হেমায়েতপুর থেকে। সেখানেই টিএসপির আসল সার নামিয়ে আগে থেকে প্রস্তুত রাখা ভেজাল সার ট্রাকে তোলা হয়।
চুক্তির শর্তের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সারে ভেজাল মেশানোর সুযোগ নেন বিপথগামী পরিবহন ঠিকাদাররা। মেসার্স এম এইচ আর করপোরেশনের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির ৩ এর (ঝ)নং শর্তে উল্লেখ রয়েছে, পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে ট্রাক ব্যবহার করতে হবে। টিএসপিসিএল হতে টিএসপি সার উত্তোলনের সর্বোচ্চ সাতদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বাফা কিংবা কারখানার গোডাউনে অবশ্যই পৌঁছাতে হবে। ব্যর্থ হলে পরের সাতদিনে প্রতিদিন প্রতি টনে দুই টাকা হারে জরিমানা করা হবে। এরপরও সার না পৌঁছালে পরের সাতদিন প্রতিদিন ৩ টাকা হারে জরিমানা করা হবে। জরিমানার এ টাকা পরিবহন বিল থেকে কেটে নেবে টিএসপিসিএল।
এই শর্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, টিএসপিসিএল থেকে ট্রাকে সার লোড করার পর সাতদিনের মধ্যে নির্দিষ্ট গন্তব্যে না পৌঁছালে পরের সাতদিন প্রতি টন দুই টাকা হারে প্রতি ট্রাকে (প্রতি ট্রাকে ১৪ টন সার) একদিনে জরিমানা আসে ২৮ টাকা, যা সাতদিনে আসে ১৯৬। পরের সাতদিন প্রতি টন তিন টাকা হারে একদিনে জরিমানা আসে ৪২ টাকা, যা সাতদিনে মাত্র ২৯৪ টাকা আসে। অর্থাৎ সার লোডের ২০ দিন পর গন্তব্যে পৌঁছালে এক ট্রাকে জরিমানা আসবে মাত্র ৪৯০ টাকা। অথচ বগুড়ার ওই গন্তব্যে ১৪ টন সার পরিবহনে ব্যয় হয় ৩৫ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিএসপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আতাউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বগুড়ায় সার ভেজালের ঘটনায় আমরা মামলা করেছি। বগুড়ার আদালতে একজন আইনজীবী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। তাছাড়া ঠিকাদারের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা বিসিআইসিকে জানিয়েছি। বিসিআইসি থেকে যে নির্দেশনা দেবে, সে মোতাবেক পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
অন্যদিকে যশোরে বাফার গোডাউনের জন্য চট্টগ্রাম টিএসপি কমপ্লেক্স থেকে গত ১৪ মার্চ ১১টি ট্রাকে ১৫৪ টন সার পাঠানো হয়। পরদিন (১৫ মার্চ) ছয়টি ট্রাকে ৮৭ টন সার পাঠানো হয়। সব মিলিয়ে যশোর বাফার গোডাউনের জন্য ২৪১ টন টিএসপি সার গ্রহণ করে পরিবহন ঠিকাদার মেসার্স সৈয়দ এন্টারপ্রাইজ। ১৫ ও ১৬ মার্চ এসব সার যশোর পৌঁছানোর কথা থাকলেও ১৭ মার্চ মাত্র পাঁচ ট্রাক সার পৌঁছায়। এসব সারে ভেজাল সন্দেহ হওয়ায় যশোর বাফার গোডাউন ম্যানেজার আকতারুল হক পাঁচ ট্রাকের সার খালাস বন্ধ করে লিখিতভাবে বিসিআইসি ও টিএসপি কর্তৃপক্ষকে জানান। এরপর টিএসপিসিএল তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে ওই সারে ভেজালের প্রমাণ পায়। এরপর গত ২৭ মার্চ টিএসপিসিএলের উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মোহাম্মদ সোলায়মান বাদী হয়ে যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় মেসার্স সৈয়দ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. আহসান হাবিব এবং তার প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইব্রাহীম হায়দারকে আসামি করা হয়। মামলাটি তদন্ত করছেন যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার উপ-পরিদর্শক এজাজুল হক। ওই মামলার দুই আসামি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। পরে ওই মামলায় আর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গত শনিবার জাগো নিউজকে বলেন, মামলার দুই আসামি হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছেন। আমরা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, টিএসপি কমপ্লেক্স সরকারি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান থেকে উৎপাদিত সার সরকার ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের সরবরাহ করে। সেই সারে ভেজাল ও পাচারে সিন্ডিকেট রয়েছে। অথচ এসব সারে ভেজাল হলে তার প্রতিরোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না টিএসপি কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষকে। এতে বোঝা যায় চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাদের সখ্য রয়েছে। সারে ভেজাল হলে কৃষকই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
টিএসপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আতাউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, যশোরে ভেজাল সার সরবরাহের অভিযোগে পরিবহন ঠিকাদার সৈয়দ এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলাটির তদন্ত চলছে। ওই ঘটনায় আমরা ঠিকাদারের জামানত থেকে সারের ক্ষতিপূরণ আদায় করেছি। পরে এসব বিষয়ে ঠিকাদার হাইকোর্টে দুটি রিট করেন। একটি খারিজ হয়েছে। আরেকটি তারা (ঠিকাদার) রায় পেয়েছে। আমরা এটার বিরুদ্ধে আপিল করবো।
কেএসআর/এএসএ/জিকেএস