জাতীয়

‘বাংলাদেশকে উত্তেজিত করতে চাইছে মিয়ানমার’

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জাপানের ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে।

Advertisement

বাংলাদেশে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে গোলা পড়ার ঘটনা, এর প্রভাব, বাংলাদেশের করণীয় নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

জাগো নিউজ: মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে গোলা পড়ছে বাংলাদেশে। এ নিয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলবও করেছে ঢাকা। বিষয়টিতে আসলে উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো কিছু আছে কি না?

Advertisement

অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: এমন ঘটনার জন্য বারবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা এবং কড়া প্রতিবাদ জানানো দরকার।

আমি মনে করি, বিষয়টি আঞ্চলিক ফোরামে আনা দরকার। প্রধানমন্ত্রী দিল্লি যাচ্ছেন। মিয়ানমারের সঙ্গে দিল্লির ভালো সম্পর্ক। প্রধানমন্ত্রীর সফরে এটি উত্থাপন করা দরকার। এমনকি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদেও এটি নিয়ে আলোচনা করা দরকার। মিয়ানমার বাংলাদেশকে উত্তেজিত করতে চাইছে। এটি না বোঝার কোনো কারণ নেই।

জাগো নিউজ: উত্তেজিত করে তোলার কী কারণ থাকতে পারে?

ইমতিয়াজ আহমেদ: রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরা যাতে আরও পেছাতে পারে, তার জন্য বিষয়টি জটিল করতে চাইছে হয়তো। সংঘর্ষ বা সামরিক তৎপরতায় বাংলাদেশকে বিরক্ত করতে পারলে তারা লাভ দেখছে। এ কারণেই আমি মনে করি, যত দ্রুত পারে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসুক। এটি করতে পারলে মিয়ানমারের ওপর এক ধরনের চাপ আসবে।

Advertisement

জাগো নিউজ: মিয়ানমার যদি ইচ্ছাকৃতভাবেই এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকে, তাহলে সামনে কী অপেক্ষা করছে?

ইমতিয়াজ আহমেদ: গত ক’বছরে মিয়ানমারের আচরণ থেকে আপনাকে বুঝতে হবে যে, তারা চাইছে বাংলাদেশ সংঘর্ষে জড়াক। কিন্তু বাংলাদেশকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। সংঘর্ষের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুকে সামনে আনতে চাইছে মিয়ানমার। কিন্তু সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে এই সংকটের সমাধান হবে না। সংকট আরও বাড়বে। বাংলাদেশকে শত্রু বানাতে উঠে-পড়ে লেগেছে। এ কারণেই আমাদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ভালো। প্রচুর ব্যবসা হচ্ছে। গণহত্যাকারী একটি দেশের সঙ্গে তো বাংলাদেশকে তুলনা করা যায় না। মিয়ানমারের মতো একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্ব সম্পর্ক রাখে কেমন করে, সেটাই ভাবনার।

এ কারণেই আমি বলছি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে এটি আলোচনায় নিয়ে আসতে হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও বিশেষভাবে বলে আসা দরকার প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ শুরু থেকেই মাথা ঠান্ডা রাখছে। কিন্তু এটি বাংলাদেশের দুর্লতা দেখছে কি না মিয়ানমার?

ইমতিয়াজ আহমেদ: বাংলাদেশের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক ছিল না শুরুতে। আমরা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধানের দিকে গিয়েছি। গণহত্যার বিষয়টি বড় আকারে নিয়ে আসতে পারিনি। আমরা এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে নিতে পারতাম। তা করতে পারিনি। আমরা দুই মাসের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মধ্যে গেলাম, যেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কোনো সময়সীমা ছিল না।

মিয়ানমারের চেয়ে বাংলাদেশের হাজারগুণ বন্ধু বেশি। এ কারণে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পরিবর্তন করে কথা বলাটা যৌক্তিক ছিল। আমি তো আসলে এই পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকতে পারি না। আমাদের একেবারে বলে দেওয়া যে, মিয়ানমার যা করছে তা অন্যায়।

মিয়ানমার যুদ্ধ চাইলেও বাংলাদেশ চায় না। এটি বিশ্বকে বুঝতে হবে। যুদ্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না। কূটনৈতিক আলোচনার কোনো বিকল্প হতে পারে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে হচ্ছে। ক্ষতি সবার হচ্ছে। কিন্তু শেষে সমাধান হবে আলোচনা করেই। অথচ এই আলোচনাটা আগে করতে পারছে না।

মিয়ানমার এমন ঘটনা ফের ঘটালে রাষ্ট্রদূতকে সকাল-বিকেল তলব করতে হবে। কিন্তু এটি বিশ্ব ফোরামে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে। কারণ ছোট ঘটনা থেকে বড় ঘটনার দিকে যেতে পারে মিয়ানমার। এ কারণে আগেই সতর্ক থাকতে হবে এবং মিয়ানমারকে সাবধান করে দিতে হবে।

জাগো নিউজ: রোহিঙ্গা ইস্যুকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। কী ঘটছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে?

ইমতিয়াজ আহমেদ: আজ হোক কাল হোক রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতেই হবে। চুক্তিবদ্ধ ইস্যু এটি। আন্তর্জাতিক আদালতে দুটি রায় হয়ে গেছে এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের পক্ষে। তারা স্বীকৃতি পেল। যুক্তরাষ্ট্রও ঘোষণা দিয়েছে যে মিয়ানমার গণহত্যা করেছে।

রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আসলে মিয়ানমার কী কৌশল নিতে চাইছে, সেটা আগে জানা দরকার। তারা হয়তো বড় একটি আর্থিক সহায়তা চাইছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নিলে তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে, এটি বোঝাতে চাইছে।

জাগো নিউজ: যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের নেওয়া হবে বলে আলোচনায় আসছে। এটিকে কীভাবে দেখবেন?

ইমতিয়াজ আহমেদ: যুক্তরাষ্ট্রের এমন আলোচনা ডেঞ্জারাস সিগন্যাল বলে মনে করছি। এটি বলার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র অন্য কিছু সুবিধা নিতে চাইছে। জাপানও রোহিঙ্গাদের নিতে চাইছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কয়জন রোহিঙ্গাকে নেবে? পাঁচ বা ১০ হাজার। ১১ লাখ রোহিঙ্গা কই যাবে? এমন ঘোষণা দিয়ে রোহিঙ্গাদের আরও বিপদে ফেলা হচ্ছে। গণহত্যার কী হবে? গণহত্যা নিয়ে বিশ্ব মহলের ভাবনা কী? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মাথা ঠিক নেই। কখন কী বলতে হবে, তা বুঝতে পারছেন না।

জাগো নিউজ: রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সহায়তাও কমে আসছে। বাংলাদেশের টেনশন বাড়ছে কি না?

ইমতিয়াজ আহমেদ: এর দুটি দিক আছে। যতদিন ইউএনএইচসিআর (জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার) ততদিন রোহিঙ্গাদের দেখতেই হবে। নইলে তো ইউএনএইচসিআর থাকার কোনো দরকার নেই। তারা নিজের স্বার্থের কারণেই এখানকার জন্য ফান্ড ক্রিয়েট করবে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ১১ লাখ রোহিঙ্গার সহায়তা দিয়ে সামাল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। অন্তত গত পাঁচ বছরে তার প্রমাণ দিয়েছে। কিন্তু এককভাবে এটি করতে গেলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের মানুষের একটি অংশ বলতে চাইবে, চলো তোমাদের সহযোগিতা করি তোমার ভূমি নিশ্চিত করতে। এটি আজ বা কাল হবেই। অন্য দেশও সুযোগ নিতে পারে। আন্তর্জাতিক মহল যদি এটি বুঝতে না পারে, তাহলে বিপদ সবার জন্যই। শরণার্থী শিবির থেকে দ্বন্দ্বের ঘটনা পুরোনো। তবে বাংলাদেশ হ্যান্ডেল করতে পারবে না, তা নয়। বাংলাদেশ পেরেছে, তার প্রমাণ দিয়েছে। তবে সমস্যা বাড়ার আগেই সমাধান টানা দরকার। গণমাধ্যমেও প্রতিনিয়ত এ নিয়ে আলোচনা থাকা দরকার।

জাগো নিউজ: প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে রোহিঙ্গা ইস্যু ফের গুরুত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে আপনি কী বলবেন?

ইমতিয়াজ আহমেদ: বাংলাদেশ-মিয়ানমার-চীন মিলে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে আগে। চীন পারলে ভারত পারবে না কেন? আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে গিয়ে এ ব্যাপারে জোর দিয়ে বলবেন। দিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক। মিয়ানমারেরও ভালো সম্পর্ক। জাপানও হতে পারে যুক্ত। চীন একা যুক্ত থাকবে কেন?

আমি অবাক, ভারতের অনেক নামি-দামি ব্যক্তিত্ব রয়েছেন অথচ তারা এ ব্যাপারে যুক্ত হতে চান না। ভারতের মাধ্যমে সমাধান হলে বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে দেশটির। রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার আলোচনায় তুরস্ক যে ভূমিকা রাখছে, তাতে তুরস্কের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়েছে। ভারত কেন এ ব্যাপারে চুপ, তা বুঝে আসে না।

এএসএস/এএসএ/জেআইএম