দেশজুড়ে

ঘড়িতে ১১টা বাজলেই রানার কাছে ছুটে আসে ২০০ শালিক

ভালোবাসা হলো এক অমোঘ শক্তি। ভালোবাসা দিয়ে সব কিছু জয় করা যায়। এমনকি ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বনের পাখিরাও মানুষের কাছে ছুটে আসে। চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে পাখির প্রতি ভালোবাসার এমনই এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পাখিপ্রেমী মনিউর রানা। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ক্ষুধার্ত পাখিগুলো ছুটে আসে রানার কাছে। তখন রানা স্নেহ-ভালোবাসায় খাবার তুলে দেন ক্ষুধার্ত শালিক পাখিদের মুখে।

Advertisement

রানার আতিথেয়তায় তার সঙ্গে এখন দুইশ শালিকের ভাব জমেছে। রানার সঙ্গে শালিকদের এমন সখ্যতা এলাকাবাসীরও মন কেড়েছে। গত তিন বছর ধরে অসংখ্য শালিক পাখিকে খাইয়ে আসছেন রানা। করোনা মহামারির শুরু থেকে অদ্যাবধি পাখিদের খাবার দেওয়া একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। প্রথম দিকে নিয়মিত ১৫-২০টি শালিক পাখি খাবার খেতে আসলেও বর্তমানে ওই শালিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০।

প্রতিদিন এক প্রকার নিয়ম করেই বেলা ১১টার দিকে খাবারের জন্য শালিক পাখিগুলো জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে বৈদ্যুতিক লাইনের তার এবং দোকান ঘরের কার্নিশে সারি বেঁধে বসে কিচিরমিচির শব্দ করে ডাক শুরু করে। রানা বুঝতে পারেন পাখিগুলোর ক্ষুধা পেয়েছে। এ সময় তিনি পাখিদের জন্য চানাচুর, বিস্কিট, পাউরুটি, মুড়ি, আর পরোটার টুকরো ছড়িয়ে দেন তার ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠানের সামনে। মুহূর্তেই বিদ্যুতের তার আর দোকানের কার্নিশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক উড়ে এসে মনের আনন্দে খাবারগুলো খায়।

নির্ভয়ে খাবার খেয়ে আবার চলে যায় পাখিগুলো। দেখলে মনে হবে পাখিগুলো রানার বেশ পরিচিত ও আপন। টানা তিন বছর ধরেই তিনি নিজের উপার্জিত টাকার একটি অংশ থেকে পাখিদের খাবার খাওয়াচ্ছেন। পাখি আর রানার এমন সম্পর্ক দেখতে প্রায় সময়ই ভিড় জমান এলাকাবাসী।

Advertisement

মনিউর রানার বাড়ি চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার দৈালতদিয়াড় পাড়ায়। তিনি ২০ বছর যাবদ জীবননগর উপজেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে রানা এক্সরে নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালান।

তিনি জানান, তিন বছর আগে করোনাকালীন মহামারির সময় দুপুর বেলা ৫-৭ টা শালিক পাখি আমার প্রতিষ্ঠানের সামনে কিচিরমিচির শব্দ করে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। এসময় অমি কিছু মুড়ি এবং চানাচুর পাখিগুলোকে খেতে দিই। খাবার খেয়েই পাখিগুলো চলে যায়। এরপর আমি বাড়িতে গিয়ে রাতে শুয়ে চিন্তা করি, করোনার কারণে লকডাউনের জন্য কোনো মানুষই বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। এছাড়া বাজারগুলোতে মানুষের উপস্থিতি কম হওয়ায় অধিকাংশ দোকান-পাট বন্ধ। এ কারণে পাখিগুলো খাবার সংকটে পড়েছে। আমি তখনই সিন্ধান্ত নিই আমার সাধ্যমতো পাখিগুলোকে খাবার দেবো।

পরদিন সকালে আমি আমার প্রতিষ্ঠানে এসে কিছু চানাচুর, বিস্কিট, পাউরুটি, মুড়ি এবং হোটেল থেকে পরোটা কিনি। পরোটাগুলো টুকরো করে কেটে চানাচুর, বিস্কুট, পাউরিটি ও মুড়ির সঙ্গে মিশিয়ে পাখিদের জন্য খাবার তৈরি করি। পরদিন খেয়াল করে দেখি একই সময় আরও অনেকগুলো শালিক পাখি এসে জড়ো হয়েছে খাবারের আশায়। খাবারগুলো দেওয়ার পর মনের আনন্দে খেয়ে পাখিগুলো চলে যায়। সেই থেকে পাখিদের খাবার দেওয়া একদিনের জন্যও থেমে থাকেনি।

প্রথম দিকে ৬-৭টি পাখি আসলেও দিন যত গড়ায় ধীরে ধীরে শালিকের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে শালিকগুলোর প্রতি এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয় আমার। এখনতো শত শত শালিক আসে খাবার খেতে। দুটো পয়সা খরচ হলেও ওদের কলতানে যে কী আনন্দ পাই তা বলে বুঝাতে পারব না। পাখিগুলোর কিচিরমিচির ডাক সত্যিই ভালো লাগে। এতে মনেও অনেকটা প্রশান্তি মেলে। এসব পাখিদের নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসি। যতদিন পারবো ওদের খাবার দিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবো।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, কোনো কারণে দু’এক দিন দোকানে বসতে না পারলে ফিরে আসার পর পাখিগুলো কিচিরমিচির শব্দ করে কাছে আসে। পরে খাবার ছিটিয়ে দিলে আপন মনে খেয়ে যার যার মতো চলে যায়।

পার্শ্ববর্তী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মাজেদুর রহমান লিটন বলেন, ভালোবাসার বিনিময়ে যে অনেক কিছু জয় করা যায় তা প্রমাণ করে দিয়েছেন রানা। ভালোবাসার বিনিময়ে পাখির সঙ্গে তার সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছে। দুপুরে পাখিগুলো যখন খাবার খাই তখন দেখতে খুবই ভালো লাগে। কিচিরমিচির শব্দ করে, যা শুনে মনটা ভরে যায়। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এভাবে সবাইকে পাখিদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।

জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, শালিক ফসলবান্ধব পাখি। বিশেষ করে আমন মৌসুমে তারা ধান ক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে থাকে। এতে কৃষকদের কীটনাশক খরচ অনেকাংশে কমে যায়। এই কারণে শালিক পাখিদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার। রানার মতো সবারই পাখির প্রতি এ ধরনের ভালোবাসা থাকা উচিত। পাখি বিভিন্ন উপায়ে পরিবেশের উপকারে আসে। যার জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত পাখির প্রতি উদারতা দেখানো।

এফএ/এমএস