চলমান সাংবাদিকতার রূপ দেখে পত্রিকা পাঠের প্রতি পাঠক আগ্রহ হারাচ্ছেন। তারা গণমাধ্যমের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। প্রকৃত সাংবাদিকতা এখন লুপ্তপ্রায়। অভিযোগ রয়েছে, যা ঘটে তা তুলে ধরা হয় না। সামাজিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক অন্যায় ও অবিচারের সঠিক চিত্র গণমাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশ পায় না। দেশের মুক্ত গণমাধ্যমের অবস্থা এবং সামগ্রিকভাবে এই শিল্পের চ্যালেঞ্জ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে সাংবাদিকদের সব শীর্ষ সংগঠন এবং মালিক ও সম্পাদকদের। এই অবস্থার মধ্যেই সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হচ্ছে দুটি উঁচু মানের দৈনিক পত্রিকা।
Advertisement
এই দুটি পত্রিকার সম্পাদক হয়েছেন দুই প্রথিতযশা সাংবাদিক। যাদের হাত দিয়ে দেশের বাঘা বাঘা সংবাদপত্রের জন্ম হয়েছে। সম্ভবত ৪ সেপ্টেম্বর বাজারে আসছে দৈনিক বাংলা। সম্পাদক হয়েছেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক তোয়াব খান। ১৯৭২ সালে এই দৈনিক বাংলার প্রথম সম্পাদক ছিলেন তিনি। আগে এই পত্রিকার নাম ছিল দৈনিক পাকিস্তান। স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় দৈনিক বাংলা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই পত্রিকাটিকে তৎকালীন সরকার ১৯৯৭ সালে বন্ধ করে দেয়।
২৫ বছর বন্ধ থাকার পর সেই দৈনিক বাংলা নতুন আঙ্গিকে, নতুন ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। তবে পেছন থেকে যারা মূলশক্তি হিসেবে কাজ করছেন, সেই ব্যবসায়ী মহলের মনমানসিকতার ওপর নির্ভর করছে পত্রিকার ভবিষ্যৎ। দ্বিতীয় পত্রিকা ‘কালবেলার’ সম্পাদক হয়েছেন আরেক কিংবদন্তি সাংবাদিক আবেদ খান। এটি প্রকাশিত হবে ২৫ সেপ্টেম্বর। আবেদ খানের সাংবাদিক জীবনও দিগন্তজোড়া খ্যাতি।
বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে এই দুই খান দুই নক্ষত্রপুঞ্জ। তাদের দেশের সাংবাদিকতার বাতিঘর বলা হয়। তবুও কেন জানি মানুষ এই দুই পত্রিকা প্রকাশের সংবাদে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। আগে দেখেছি, মানসম্মত একটি নতুন পত্রিকা প্রকাশ হওয়ার খবর শুনে মানুষ আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করতো। কবে বাজারে আসবে, কেমন হবে পত্রিকাটি, নিরপেক্ষ হবে কি না। এমন আগ্রহ, কৌতূহল নিয়ে প্রথম সংখ্যাটি কেনার জন্য মানুষ ভিড় করে থাকতো পত্রিকা বিক্রেতাদের কাছে।
Advertisement
কিন্তু এই দুটি পত্রিকা প্রকাশের খবরে মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এর পেছনে সম্ভবত দুটি কারণ কাজ করছে বলে আমার মনে হয়। একটি হচ্ছে, দুই সম্পাদকের কট্টর রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে সংবাদ পরিবেশন ও সম্পাদকীয় নীতিতে তার প্রতিফলন ঘটবে কি না। অন্যটি গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন আইনকানুন। এই আইন-কানুনের স্পষ্ট প্রভাব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। সামাজিক দর্পণ বলতে যা বোঝায়, সেটা এখনকার গণমাধ্যমে অনেকটা অনুপস্থিত বলা যায়। প্রকাশিতব্য এই দুই পত্রিকা সে জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে পাঠকের প্রত্যাশা পূরণে কতটা সক্ষম হবে, সেটাও প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। অনাগ্রহ, অনীহার কারণ সম্ভবত এগুলোই। বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে, অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে।
একুশে পদক পাওয়া জাঁদরেল সম্পাদক তোয়াব খান দীর্ঘদিন দৈনিক জনকণ্ঠে উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে ছিলেন। তাছাড়া তোয়াব খান জনকণ্ঠের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েরও একজন ছিলেন।
সাংবাদিকতা জগতের আরেক নক্ষত্র আবেদ খান- যিনি একসময় সাংবাদিক হিসেবে গগণচুম্বি খ্যাতি পেয়েছিলেন। টেলিভিশন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি চমক সৃষ্ট করেছিলেন। নব্বই দশকের দিকে তার অনুসন্ধানমূলক টেলিভিশন রিপোর্টিং সিরিজ ‘ঘটনার আড়ালে’ এবং ‘ওপেন সিক্রেট’ ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মাইলফলক হয়ে আছে।
এছাড়া তিনি দৈনিক ভোরের কাগজ, যুগান্তর ও সমকালে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার টক অব দ্য টাউন, প্রাঙ্গণে বহিরাঙ্গনে, গৌরানন্দ কবি ভনে শুনে পুণ্যবান, তৃতীয় নয়ন, অভাজনের নিবেদন, লেট দেয়ার বি লাইট প্রতিবেদনগুলো প্রথম শ্রেণির কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরে পাঠকের কাছে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।
Advertisement
একুশে টেলিভিশনে তিনি প্রথম টক শো'র প্রবর্তন করেন। এছাড়া ১৯৮৪, ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ২০১৫ সালে বিটিভির ‘ঈদ আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক ড. সানজিদা আখতারসহ তার অসাধারণ উপস্থাপনা আজো সবার মনে জাগরুক হয়ে আছে। যার কারণে আবেদ খানকে একনামে সবাই চেনেন। কিন্তু তার কাল হলো ‘কালের কণ্ঠ’। এই কালের কণ্ঠ তার নিজের দেওয়া নাম। এই নামে তিনি প্রথম আলোয় কলাম লিখতেন। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিন মাসের মধ্যে তিনি কালের কণ্ঠের প্রচার সংখ্যাকে উচ্চমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
বর্তমানের অসুস্থ সাংবাদিকতার পেশা থেকে তিনি নাকি বিরত থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিরত থাকতে পারলেন কই। তখনকার চেয়ে আরও বহুগুণ অসুস্থ সাংবাদিকতার সময়ে তিনি হাল ধরলেন ‘দৈনিক কালবেলার’।
এর পরপরই তিনি প্রকাশ করলেন ‘দৈনিক জাগরণ’ । শোনা যাচ্ছে, কালবেলার পাশাপাশি তিনি ‘জাগরণেও’ কাজ চালিয়ে যাবেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক আবেদ খান ‘নিউজ বাংলা ২৪.কম কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সাংবাদিকতার নীতি মেনে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করে নতুন আঙ্গিকে দৈনিক কালবেলাকে পাঠকের কাছে তুলে ধরা হবে। অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করে, রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থেকে কাজ করবে এই পত্রিক ‘। আশা করি, তার এই কথার সাথে কাজের মিল থাকলে শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ‘কালবেলাকে’ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।
বর্তমানে সাংবাদিকতার দুঃসময় চলছে বলা যায়। সাংবাদিকতার সেই স্বর্ণযুগ হারিয়ে গেছে। সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এখন মাথার ওপর ঝুলছে ১২-১৩টা আইন। জটিল অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে গণমাধ্যম শিল্প। একদিকে খড়্গ, অন্যদিকে মালিকপক্ষের অমানবিক, বিবেকহীন আচরণ, আরেকদিকে সাংবাদিকদের বিভক্তি। এসব যাঁতাকলে পিষ্ট সাংবাদিকরা। যার কারণে অনেক দক্ষ ও মেধাবী সাংবাদিক অর্থ কষ্টসহ নানা কারণে এই পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এটা জাতির জন্য অশনিসংকেত।
এই দুর্যোগের মধ্যে শত চ্যালেঞ্জ এবং কণ্টকাকীর্ণ পথ পার হতে হবে, এটা জেনেও অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করার যে উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ, সেজন্য তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। আমরা আশা করি, রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত হয়ে সাংবাদিকতার নীতি, নৈতিকতা এবং পেশাদারত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, মালিকপক্ষের প্রভাবমুক্ত হয়ে যদি সাহসের সাথে সংবাদপত্রকে পরিচালনা করা যায়, তবে অবশ্যই পাঠকসমাজের সাধুবাদ পাওয়া যাবে। তিমির সময়কে জয় করার দৃঢ়তা এবং অঙ্গীকার নিয়ে দুই পত্রিকার আগমনকে আমরা স্বাগত জানাই। জয়তু দৈনিক কালবেলা, জয়তু দৈনিক বাংলা।
লেখক : সাবেক সভাপতি, রাজশাহী প্রেস ক্লাব।golamss636@gmail.com
এইচআর/জিকেএস