বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে একটি নির্যাতিত জাতিকে দেওয়া হয়েছিল আশ্রয়। আজ তারাই সেই এলাকার প্রভু। বেলফোর ঘোষণায় রাষ্ট্রের কোনো উল্লেখ ছিল না। ছিল ইহুদি জাতির আবাসভূমি। আরব-ইসরায়েল তিন-তিনটি যুদ্ধের পর গোটা ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ইহুদিরা। মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত থাকার পেছনে তাদের দায় অনেক।
Advertisement
বিশ্ব জনমত উপেক্ষা করে গাজাকে বানিয়ে রাখা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার। এছাড়া নিরাপত্তার নামে পশ্চিম তীরে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে চলে ধরপাকড়। পাখির মতো গুলি করে মারা হয় নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের। রক্ষা পান না সাংবাদিকরাও। যার সর্বশেষ শিকার আল জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ।
মার্কিন এনজিও ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট’ বলছে, গত তিন দশকে ১৮ সাংবাদিককে হত্যা করেছে ইসরায়েল। যার মধ্যে দুজন মার্কিন গণমাধ্যম এপি ও এপিটিএনের এবং একজন রয়টার্সের সাংবাদিক ছিলেন। ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের সংগঠন প্যালেস্টাইনিয়ান জার্নালিস্ট সিন্ডিকেট-পিজেএস বলছে, গত ২২ বছরে অন্তত ৫০ ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে হত্যা করেছে ইসরায়েল। ১৯৬৭ থেকে হিসাব করলে ৮৬ জন।
ব্রিটেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোরের অদূরদর্শী পরিকল্পনার কারণে ইহুদিরা মধ্যপ্রাচ্যকে দশকের পর দশক ধরে অশান্ত করে রাখলেও তার কোনো খেদ নেই যুক্তরাজ্যের। তবে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দুই দেশ নীতিতে অটল রয়েছে দেশটি।
Advertisement
কিন্তু এবার সেই নীতিতেও ভাঙনের সুরের দেখা মিলছে। আগামী ৫ সেপ্টেম্বর কনজারভেটিভ বা টোরি পার্টি প্রধানের নাম ঘোষণা করা হবে। লিজ ট্রাস ও ঋষি সুনাক, যিনিই নির্বাচিত হবেন, তিনিই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের স্থলাভিষিক্ত হবেন। অতি ডানপন্থি লিজ ট্রাসের মাঝে অনেকেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী লৌহ মানবী মার্গারেট থ্যাচারের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। তবে থ্যাচারের রীতি জলাঞ্জলি দিয়ে ইসরায়েল ইস্যুতে ট্রাম্পের পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। জেরুজালেমে ব্রিটিশ দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার কথা বলেছেন ট্রাস।
পাঁচ বছর আগে যখন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরিত করার ঘোষণা দেন, তখন এই সিদ্ধান্তটিকে অবৈধ এবং ভুল বলে ব্যাপকভাবে নিন্দা করা হয়েছিল। একে বলা হচ্ছিল, একজন উগ্র-ডানপন্থি প্রেসিডেন্টের কাজ। যিনি ইভেঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টানভিত্তিকে খুশি করার উদ্দেশ্যে এমনটি করেছেন। যারা বিশ্বাস করে, জেরুজালেমের ওপর ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ ঈশ্বর দ্বারা নির্ধারিত।
তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ওই পদক্ষেপের নিন্দা করে বলেন, ‘পূর্ব জেরুজালেমকে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে বিবেচনা করি আমরা, যা নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।’ এমনকি কট্টরপন্থি বরিস জনসনের প্রশাসনও গত বছরের ডিসেম্বরে বিবৃতিতে জানায়, ‘জেরুজালেমের মর্যাদা সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের অবস্থান স্পষ্ট এবং দীর্ঘস্থায়ী। এটি ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একটি আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা উচিত’।
সম্প্রতি গাজায় বিনা উসকানিতে ইসরায়েল দফায় দফায় বিমান হামলা চালালে, কনজারভেটিভ ফ্রেন্ডস অব ইসরায়েলের কাছে চিঠিতে ট্রাস বলেন, ‘আমি ইসরায়েলে ব্রিটিশ দূতাবাসের অবস্থানের গুরুত্ব এবং সংবেদনশীলতা বুঝতে পারি। ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় রাখতে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার করবো।’ এই পুনর্বিবেচনা মানে জেরুজালেমে ব্রিটিশ দূতাবাস স্থানান্তরের সম্ভাবনা যাচাই করা।
Advertisement
ট্রাসের এমন আগ্রাসী নীতির চেয়েও একধাপ এগিয়ে আছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক। কনজারভেটিভ ফ্রেন্ডস অব ইসরায়েল আয়োজিত নির্বাচনী সভায় জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এটি অবিসংবাদিতভাবে ঐতিহাসিক রাজধানী। ঐতিহাসিক ও বাস্তবসম্মত হিসেবে এটি স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে। আমাদের পরম মিত্রদের জন্য এমন কিছুই আমি করতে চাই। অর্থাৎ পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেসে থাকা দুই প্রার্থীই মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতিকে ছিঁড়ে ফেলে ট্রাম্পের নীতি অনুসরণে বিশ্বাসী।
অনেকে অবশ্য বলছেন, দুজনই ভোট পেতে অতি উৎসাহী মন্তব্য করেছেন। দায়িত্ব পেয়ে অন্যান্য নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মতো এগুলোও ভুলে যাবেন। কিন্তু, বাস্তবতা হলো টোরি পার্টির ৮০ শতাংশ এমপিই কনজারভেটিভ ফ্রেন্ডস অব ইসরায়েলের সদস্য। আর টোরি পার্টির একজন এমপিও কনজারভেটিভ ফ্রেন্ডস অব প্যালেস্টাইন সদস্য নন। এ কারণে ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন দলটিতে ফিলিস্তিনিদের জন্য কোনো কণ্ঠ আর উচ্চকিত হয় না। তাই লিজ ট্রাস ও ঋষি সুনাকের এমন মনোভাব স্বাভাবিক।
লেখক: নিউজ এডিটর, চ্যানেল ২৪।
এইচআর/ফারুক/এএসএম