মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চা-শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করে দিয়েছেন ১৭০ টাকা। এর আগে তারা ১২০ টাকা করে পেতো। তারও আগে নিশ্চয়ই আরও কম পেতো তারা।
Advertisement
একটা বিষয়ে আমি কনফিউজ, মানে ধন্দে আছি। এই যে ১২০ টাকা মজুরি- সেটা কি প্রতিদিনের জন্য? নাকি প্রতি সপ্তাহের জন্য নাকি প্রতি ঘণ্টার জন্য? চা-শ্রমিকরা মজুরি বাড়ানোর দাবিতে রাস্তায় নামার পর ওই সব অংকের দেখা মিললো, কিন্তু কোনো রিপোর্টেই উল্লেখ নেই ( হয়তো আমার চোখে পড়েনি) যে ওই ১২০ টাকা মজুরি প্রতিদিনের বা সপ্তাহের বা মাসের জন্য।
আমি বেআক্কেলের মতোই প্রশ্নগুলো তুলেছি। আমার তো বোঝা উচিত যে ওই ১২০ টাকায় মোটা চালের দুই কেজি চালের বেশি কেনা সম্ভব নয়। তাহলে প্রথম দফায়ই সপ্তাহ ও মাসের হিসাবটি বাদ দেওয়া গেলো। বাকি রইলো দিনের হিসাব। প্রতিদিন যদি একজন শ্রমিক মজুরি পায় ১২০ টাকা, তাহলে তার সারাদিনের খাদ্যসহ (তরিতরকারিসহ) অন্যান্য খরচ কি মেটানো সম্ভব?
আমি যদি চাল, ডাল, নুন, মরিচ, হলুদসহ বেঁচে থাকার মতো খাদ্য উপাদান-উপকরণ কি কেনা সম্ভব? না, সম্ভব হচ্ছিল না বলেই তো চা-পাতা ভর্তা খেয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর স্বাস্থ্য যে কেমন তা চা-শ্রমিকদের মিছিল না দেখলে আমরা বুঝতে বা জানতে পারতাম না, কেমন মানবেতর জীবন তারা যাপন করছে।
Advertisement
ওই মানবেতর জীবনের শাঁসটুকু জিইয়ে রাখার জন্য সামান্য মাথা গোঁজার ঠাঁই, অতিসামান্য রেশন এবং প্যারাসিটামলজাতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা চা-বাগান মালিকদের বদান্যতার নমুনা হিসেবে উপস্থিত করা যায়। ওইটুকুতেই তারা বেঁচে আছে। বিনিময়ে চা-শ্রমিকরা প্রতিদিন ২৩ কেজি করে পাতা তুলে এনে জমা দেয়। কম হলে প্রতি কেজির জন্য কেটে রাখে ৫ টাকা ২৫ পয়সা। আর তারা যদি বেশি পাতা তোলে তাহলে অতিরিক্ত প্রতি কেজির জন্য দেয় ১ টাকা ৭৫ পয়সা। কি অসাধারণ হিসাবের কারচুপি এবং শোষণ।
আমি যদি প্রক্রিয়াজাতকৃত খরচের কথা বলি তারপরও প্রতি কেজি চায়ের পাতার দাম ৩০০ টাকা হবে না। অতি সম্প্রতি আমি সিলেট গিয়েছিলাম, আগস্টের প্রথমদিন, তখনও চা-শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর জন্য আন্দোলনে নামেনি। বলতে গেলে তারা হঠাৎই নেমে এসেছে রাস্তায়। তার মূল কারণ দ্রব্যমূলের আকাশগতি।
খাদ্যপণ্য কিনতে যে পরিমাণ টাকা লাগছে তা তাদের খুঁতিতে নেই। ফলে তারা আধপেটা খেয়ে জীবন বাঁচাচ্ছে। পরিস্থিতিটা মানবিক দৃষ্টিতে দেখলে আমাদের ভেতর কেবল অস্বস্তি জাগে না, মানুষের অমানুষিক আচরণ, লোভ ও বিত্তের ধমক চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কেবল সিলেটের চা শ্রমিকরা নয়, বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রতি নিয়োগকারী মালিক কর্তৃপক্ষের সবার কথা-বার্তা, আচার-আচরণ, সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম।
মালিক চরিত্রের কথা বলি আমরা, কিন্তু তারপরও এটা সত্য যে শ্রেণির মর্যাদা রক্ষা করেও শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়া যায়। আমাদের এক সাহিত্যের সহকর্মী বললেন পঞ্চগড়ের চা-বাগানের শ্রমিকরা মজুরি পায় ৩০০ টাকা। সেই কাজী চা-বাগানের মালিক কেন তার শ্রমিকদের জন্য ১২০ টাকা রাখেননি? কেন রাখেননি তা বলতে পারবো না। তবে, প্রচলিত সাইকোলজিক্যাল ধারণা থেকে বলতে পারি, কর্তৃপক্ষ ভেবেছেন ওদের শ্রমের অন্যায্য দামটা যেন ন্যায্যের দিকে ধাবমান হয়, সেটাই দেখানো। তাদের মানবিকতা নিঃসন্দেহে সন্দেহাতীত নয়, তারপরও এটাই সত্য যে, মানুষের প্রতি মানবিক দৃষ্টি এখানে প্রসারিত। এখান থেকে মালিকের দেওয়া আকাশ দেখা যায়, যা শ্রীমঙ্গলের শ্রমিকরা দেখতে পায় না। তাদের আকাশে ঘোলা মেঘের দাপট।
Advertisement
এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথায় আসা যাক। চা-শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে মালিকরা তাদের মজুরি ১৪৫ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, যাও, দিয়েছি, এবার কাজে যাও। শ্রমিক নেতারা সেটা মেনে নিয়ে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য সাধারণ শ্রমিকদের জানিয়ে দেয়। কিন্তু কিছু শ্রমিক ওই মজুরি প্রত্যাখ্যান করে। তারা বলে তাদের দাবি মতো ৩০০ টাকা করতে হবে। ফলে সংকটটা জিইয়ে থাকে।
শ্রমিকরা ভাগ হয়ে যায় বটে, তরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিকদের মতো রাজনীতিশাসিত নয় বলে পরস্পরের মধ্যে লাঠালাঠি করে না। তারা বাগানে বসেই প্রতিবাদী স্লোগান দেয়। আমাদের ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াগুলো সেই সব প্রতিবাদী কর্মসূচির সচিত্র নিউজ দিয়ে আমাদের সজাগ-সচেতন করেছেন। নারী চা-শ্রমিকদের অনেকেই দাবি করেন যে, বিষয়টি নিষ্পত্তি করুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তাদের সেই আহ্বানেই তিনি চা বাগান মালিকদের ডেকে তাদের সমস্যা-সংকট জেনে তাদের পটিয়ে শ্রমিকদের মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ করেছেন।
আমরা আশা করতেই পারি, এবার চা-শ্রমিকরা খুশি হয়েই কাজে যোগ দেবে। এবং দিয়েছেও। প্রধানমন্ত্রী চা-শ্রমিকদের দাবি যে যথার্থ তা পুরোপুরিই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। কিন্তু তিনি তো মজুরিদাতা নন, তিনি মধ্যস্থতাকারী, তাই চা-বাগান মালিকরা প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে যতোটুকু দিতে সম্মত হয়েছেন, তিনি সেটুকুই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তবু তো নাই মামার চেয়ে কানা মামার উপস্থিতি অনেকটাই সুখকর।
১২০ টাকা থেকে মজুরি যখন ১৭০ টাকা একটি শ্রমিক পরিবারে যোগ হবে তখন তা আনন্দেরই। যদিও তাদের আর্থিক সংকট কাটবে না। কারণ ওই ১৭০ টাকাও অনেক কম। বিষয়টি কেবল খাদ্যশস্য কেনা বা আনুষঙ্গিক খরচের নয়, বিষয়টি চলমান সময়ের জন্য সঙ্গতিপূর্ণ কি না। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন কেন চা-শ্রমিকের চেয়ে বেশি? কারণ তাদের জব, টেকনিক্যাল। আর এক্সপোর্ট অরিয়েন্টেড বলে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন বেশি।
চা-শিল্পও কিন্তু একপোর্ট অরিয়েনটেড। ফলে এটা মনে রাখতে হবে যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের অনুচর হিসেবে যারা এদেশে চা-বাগান করে মুনাফার পাহাড় ও টিলা বানিয়েছেন, তাদের অনুসরণ করলে গোটা শ্রমজীবনই ঔপনিবেশিক শোষণের নিগড়ে আটকে থাকবে এবং আজো তা অব্যাহত। ভাগ্য বিড়ম্বিত শ্রমিকরা এসেছিল শ্রীলঙ্কা ও ভারতের কয়েকটি রাজ্য থেকে।
যুগের পর যুগ ধরে তাদের শোষণ করে ব্রিটিশরা চলে গেছে। এখন অধিকাংশই বাংলাদেশি মালিকানাধীন চা-বাগান। মালিক পাল্টালেও শ্রমিকের মজুরি পাল্টায়নি। যেমন আমরা দেশটা স্বাধীন করেছি সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে, কিন্তু প্রশাসন ব্রিটিশদের তৈরি ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন অ্যাক্ট দিয়েই চলছে। তবে সামান্য সংশোধন ও পরিমার্জন করেছে পাকিস্তানিরা, আর বাংলাদেশ সরকার। ঠিক চা-বাগানের শ্রমিকরা যে হারে মজুরি পেতো, ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়েছে, আমাদের আইনগুলোও সেভাবেই সংস্কৃত হয়েছে।
অর্থাৎ ঔপনিবেশিক চিন্তা ও মনন দ্বারা আমরা পরিচালিত ও শাসিত। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সেই একই ধারাকে অনুসরণ করেছেন। তিনি উপলব্ধি করতে পারলেও শ্রমিকের মজুরি যারা দেবেন, তাদের মনমানসিকতার ওপরই তিনি নির্ভর করবে, সেটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতা, তা একটি বিধিবদ্ধ ধারণাজাত। ওই ধারণাই নিয়োগ কর্তাকে উচ্চতর কিছু করতে / ভাবতে শিখতে দেয় না, শেখায় না। বরং কীভাবে মজুরি কম রেখে তদের বেশি ঠকানো যায়, সেই প্র্যাকটিসই করে তারা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি চেপে ধরতেন যে তাদের মজুরি ৩০০ টাকা করে দিলেও চা-বাগানের মালিকদের লাভ টিলার সমান, তাহলে কিন্তু রফতানি পণ্য চা ওয়ালারা তা মানতেন। কারণ চা রফতানি করে যে পরিমাণ টাকা তারা কামান, গার্মেন্টস মালিকরা তুলনামূলকভাবে তা পারেন না। কারণ তারা কাপড়সহ এক্সেসরিস কিনে আনে বিদেশ থেকে। সেই পণ্যে দাম মেটানোর পর আসলে গার্মেন্টস সেক্টর তেমনভাবে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে না। যেহেতু গার্মেন্টস সেক্টরের সাইজ অনেক বড়, তাই বৈদেশিক মুদ্রার সাইজটাও বড় দেখা যায়।
তারপরও বলবো, এই মজুরি বাড়ানোর ফলে, তারা মানবেতর জীবনের ওপরে উঠতে না পারলেও, শারীরিকভাবে বেঁচে যাবে। তাইবা কম কী? নেই মামার চেয়ে কানা মামা (চোখে না দেখুক, কানে না শুনুক, তবুও) ভালো।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম