প্রতি গ্রীষ্মেই আগুন লাগে বিশ্বের কোনো না কোনো বনে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, অ্যামাজন, আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চল ও সাইবেরিয়ার বনগুলো দাবানলের প্রতি খুবই সংবেদনশীল। গত বছর ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম দাবানল দেখা দিয়েছিল। এতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ৯ লাখ ৫০ হাজার একরের বেশি বনভূমি। এ বছর নিউ মেক্সিকোর বৃহত্তম দাবানলে পুড়েছে তিন লাখ একরের বেশি। দাবানল মানুষের জন্য বিধ্বংসী হতে পারে, তবে এটি ঝলসে যাওয়া যে ভূমি পেছনে ফেলে যায়, তা বনভূমির জীবনচক্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
Advertisement
বনের উর্বরতা বৃদ্ধির একটি প্রাকৃতিক উপায় দাবানল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বনের মাটিতে জমা হওয়া ধ্বংসাবশেষ একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ স্তর তৈরি করে। স্বাভাবিক সময়ে এটি ঠিকভাবে ভাঙা যায় না এবং তা গাছপালা শোষণ করে নেয়। কিন্তু পোড়া অবস্থায় পুষ্টি উপাদানগুলো মাটিতে মিশে যায়।
একটি পরিপক্ব বনের বড় গাছগুলো আগুনের মধ্যেও বেঁচে থাকার জন্য প্রস্তুত হয়। ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্মানো জায়ান্ট সিকোইয়াস পরিপক্ব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এতে পুরু আগুন-প্রতিরোধী বাকল তৈরি হয়, যা গাছটির ভেতরের অংশকে রক্ষা করে। এ ধরনের এলাকার কিছু উদ্ভিদ প্রজাতির বিবর্তনের সঙ্গেও দাবানলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যেমন- লজপোল পাইনের মতো কিছু প্রজাতি অগ্নি-সক্রিয়। অর্থাৎ, দাবানলের কিছুদিন পরে ওই ভূমিতে এগুলোর চারাগাছ দেখতে পাওয়া যায়।
কিন্তু এসব কিছুই বদলে যায়, যখন দাবানল অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। বড় এবং ধ্বংসাত্মক অগ্নিকাণ্ড ক্রমেই নিয়মিত হয়ে উঠছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার অর্থ- বার্ন জোনে মাটি থেকে আরও বেশি পানি বাষ্পীভূত হচ্ছে। আর আমেরিকার পাহাড়ে তুষার খরা মানে, সেখানকার বনগুলোতে আর্দ্রতা কমে যাচ্ছে।
Advertisement
এই শুষ্কতা গাছগুলোকে কাঠে পরিণত করে, যাতে আগুন ধরতে লাগে কেবল একটি স্ফুলিঙ্গ। আমেরিকার বনে প্রায় ৮৫ শতাংশ অগ্নিকাণ্ডে এই স্ফুলিঙ্গটি আসে মানুষের কাছ থেকেই। তাছাড়া অতি-উদ্যোগী অগ্নি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষগুলো নানা জায়গায় প্রাকৃতিক দাবানল আটকে দিয়েছে, যার ফলে মৃত গাছপালা জমে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এগুলোই অনেক বড় ও কম নিয়ন্ত্রণযোগ্য দাবানল সৃষ্টি করতে সক্ষম।
বড় দাবানল ধ্বংস ডেকে আনে এবং গাছপালা পুনর্জন্মের ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করে। এটি বনের বাস্তুতন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। এমনকি অভিযোজিত উদ্ভিদ প্রজাতির জন্যেও এ ধরনের চরম পরিস্থিতিতে টিকে থাকা কঠিন। আমেরিকার ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিসের ধারণা, আগুন-প্রতিরোধী বাকল থাকা সত্ত্বেও আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্বের বৃহৎ সিকোইয়াসগুলোর ১৯ শতাংশ দাবানলে হারিয়ে যাবে।
বিশ্বের বৃহত্তম বন অ্যামাজনে ক্রমেই জীববৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। ব্যাপক বন উজাড় এটিকে বিপর্যয়কর দাবানলের সামনে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
অনিয়ন্ত্রিত দাবানল বন থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে বেশ। আমেরিকায় অনেক দাবানলপ্রবণ সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে অর্থসহায়তা পায়। তবে নতুন ঘরবাড়ি পুরোনোগুলোর তুলনায় আরও বেশি আগুনপ্রতিরোধী হবে, তা নিশ্চিত করার মতো আইনকানুন রয়েছে খুব কম।
Advertisement
তাছাড়া অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় ঘরবাড়ি তৈরি করে। মার্কিন ফরেস্ট সার্ভিসের মতে, দেশটির নিম্নাঞ্চলীয় ৪৮টি রাজ্যের প্রতি পাঁচটি বাড়ির মধ্যে প্রায় দুটি এমন জমিতে রয়েছে, যেখানে দাবানলের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যত বেশি আমেরিকান পশ্চিমে বসত গড়ছে, এ ধরনের বাড়ির সংখ্যাও বাড়ছে।
এ অবস্থায় দাবানলের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তা সাবধানে ভাবতে হবে অগ্নিনির্বাপকদের। তারা যখন খুব দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন, তখন সমস্যাও তৈরি করেন। অবশ্য দাবানলের ভয় এমনটি করতে সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের উত্সাহিত করতে পারে। তবু মনে রাখতে হবে, দাবানল কতটা ভয়ংকর, তার ওপর বনের স্বাস্থ্য নির্ভর করছে।
(দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অবলম্বনে, ভাবানুবাদ করেছেন খান আরাফাত আলী)
কেএএ/এএসএম