ভ্রমণ

একদিনে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

মাজহারুল ইসলাম শামীম

Advertisement

চট্টগ্রামে আছে অসংখ্য ভ্রমণ স্থান। সেসব ভ্রমণ স্থানের মধ্যে অন্যতম হলো পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে খুবই জনপ্রিয় এই স্থান। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। যা কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত।

চট্টগ্রাম শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত পতেঙ্গা। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এর প্রচুর ক্ষতি হয়। বর্তমানে বাঁধ দিয়ে রক্ষাণাবেক্ষণ করায় সৈকতের সৌন্দর্য অনেকটা বেড়েছে। জোয়ারের সময় ঢেউয়ের আঁচড় যেন নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা করে।

আর সে বাঁধের উপর সবুজ ঘাস দেখলে মনে হবে যেন সবুজের কার্পেট বসানো আছে। সৈকতের চারপাশে প্রকৃতির নৈসর্গিক মনোরম দৃশ্যের হাতছানি সঙ্গে সমুদ্রপাড়ের কর্মব্যস্ততা ও বিশাল সমুদ্রের সঙ্গে কর্ণফুলী নদীর মিলনমেলা।

Advertisement

সাগর পাড়ের বালুকা রাশি, বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ মন ভরিয়ে দেবে আপনার। দেখা পাবেন নানা বয়সী মানুষ কতই না আনন্দ করছে সেখানে। সৈকতজুড়ে চার কোণাবিশিষ্ট কংক্রিটের ব্লকগুলো দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। এতে সৈকতের সৌন্দর্য অনেকটাই বেড়েছে।

জোয়ারের সময় সিসি ব্লকের ওপর আছড়ে পড়া সমুদ্রের ঢেউ এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা করে। এতসব মনোমুগ্ধকর পরিবেশের কারণে চট্টগ্রাম শহরের পতেঙ্গা সৈকতটি অন্যান্য সৈকত থেকে খানিকটা আলাদা।

পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার যারা দেখনি কিংবা সময়ের অভাবে দেখার সুযোগ পাননি, তাদের এই পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত হতে পারে সবচেয়ে ভালো বিকল্প।

এরই মধ্যে এই সৈকত বিশ্ব পরিচিতি পেয়েছে। বিকেল হতে না হতেই হাজারো পর্যটক ভিড় জমায় এই সমুদ্র সৈকতে। সেখানকার পরিবেশ এতোটাই মনোমুগ্ধকর যে তীরে দাঁড়ালেই কানে বাজে সাগরের কল্লোল।

Advertisement

সাগড়পাড়ে দাঁড়ালেই পায়ে এসে লুটিয়ে পড়বে নীল জলরাশির অপার ঢেউ, দেখা মিলবে বিশ্বের নানা দেশের নানা পতাকাবাহী নোঙর করা সারি সারি জাহাজ।

সৈকতের পাশে ও ঝাউ বনে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাবারের দোকান। সমুদ্রে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য আছে স্পিড বোট। সমুদ্র তীরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আছে সি বাইক ও ঘোড়া। ঝাউবন ঘেঁষে উত্তর দিকে একটু সামনেই রয়েছে বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলি নদীর মোহনা।

বিকেলে সূর্যাস্তের দৃশ্য না দেখলে সমুদ্রসৈকতের আসল দৃশ্য দেখা মিস হবে। সূর্যাস্ত যাওয়ার দৃশ্য দেখলে মনে হবে যেন সূর্যটা সাগরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। আর এমন লাল রং ধারণ করে সূর্য তখন যা অসম্ভব দৃশ্য তৈরি হয়ে যায়।

মহূর্তে আপনার মন জুড়ে যাবে। আবার সকালে যখন সূর্য উদয় হয়, তখন মনে হবে সাগর থেকে যেনো সূর্য উঠতেছে। কি ঠান্ডা মনোরম পরিবেশে অবস্থিত পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত।যা নিজ চোখে কেউ না দেখলে বিশ্বাস করবে না।

এমন মনোরম দৃশ্য দেখার জন্য আমাদের এবারের গন্তব্য হলো পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত। তারিখটা ছিলো ২০১৯ সালের মে মাস। প্রচণ্ড গরমের আবহাওয়া তখন। তারপর ও আমাদের ভ্রমণের ইচ্ছে থাকাতে মন্তব্য গন্তব্যকে ঠেকাতে পারেনি। আমাদের সে ভ্রমণ হয়েছিলো ১৭ জনের।

সব সদস্য ছিলো আমাদের নিজস্ব এলাকার। আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনার জন্য সবচেয়ে পরিশ্রমী ও উদ্যমী ছিলো আমার বন্ধু খুরশিদ আলম (সজিব)। পাশাপাশি বন্ধু রানা ও অনেক সহযোগিতা করছিলো সে ভ্রমণে।

আমাদের ভ্রমণ সদস্যদের মধ্যে সজিব, রানা, একরাম, বাবু, পলাশসহ আরো ১২ জন ছিল। ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে বড় ক্রেডিট পাওয়ার যোগ্য বন্ধু সজিব। আমরা ঠিক ভ্রমণের দিন সকাল বেলায় ভ্রমণের দুপুরের খাবার হিসেবে বিরিয়ানি রান্না করে নিয়ে গেলাম।

পাশাপাশি একটি ট্রি-শার্টসহ দেওয়া হলো ভ্রমণে। আমরা সব রান্না শেষ করে ও সব সদস্যকে একত্র করে সকাল ৯টায় রওনা দিলাম পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশ্যে। যাত্রাপথে গাড়িতে বিনোদনের জন্য গান বাজিয়ে বন্ধুরা সবাই আনন্দ করে গাড়ি চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্খিত স্থান পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত।

যদিও আমি ২০১৪ সালে আরো একবার গিয়েছিলাম পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত। ওইবার এতটা উন্নত ছিল না। এবার গিয়ে তো দেখলাম সব পরিবর্তন হয়ে এক ছবির মতো দৃশ্য হয়ে গেলো পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত।

আমরা পৌঁছাতে প্রায় দুপুর ১২টা বেজে গেলো। তখন প্রচণ্ড রৌদ আর গরম। অবশেষে আমরা গাড়ি থেকে নেমে সবাই চারপাশ হেঁটে দেখলাম। তারপর যখন দুপুরের লাঞ্চের সময় হলো সবাই দুপুরের খাবার শেষ করে নিলাম।

এরপর আমরা সমুদ্রের পানির কাছে গেলাম। ছবিতে যে রকম দেখা যায় বাস্তবে কিন্তু অন্য রকম এক অনুভূতি। পানি শব্দ, সমুদ্রের বালি, স্পিড বোর্ট চলাচল, বড় বড় জাহাজ যা দেখে মহূর্তে মন ভরে যায়। তার একটু পরে কর্ণফুলী নদীর মোহনার অবস্থান। আমরা প্রথমে সবাই স্পিড বোটে করে সমুদ্রের একটুখানি ঘুরে আসলাম।

এরপর কেউ ঘোড়ার পিঠে উঠলো, কেউ কাঁকড়া ভাজা খেল, কেউ আচার কিনছে, কেউ আবার সমুদ্রের পানিতে নেমে আনন্দ করছে। প্রচণ্ড বাতাস থাকায় গরমের তাপ বেশি শরীরে অনুভব হয় না। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের প্রস্থ কম কিন্তু ঢেউয়ের গতি ও আওয়াজ অনেক বেশি।

তাই সেখানে সাঁতার না কাটাই ভালো। কারণ অতিরিক্ত উৎসাহ, আনন্দ অনেক সময় বিপদ ডেকে আনতে পারে। তারপরও আমাদের অনেক সদস্য সমুদ্রে সাঁতার কেটেছে। আবার কেউ কেউ ফুটবল খেলেছে সমুদ্রের বালির মধ্যে।

সবচেয়ে বড় ব্যস্ততা হলো সবাই ছবি তোলা নিয়ে। সৌন্দর্যের সঙ্গে নিজেকে ফ্রেমবন্দি করে রাখতে কে না চায়। এভাবে চলতে চলতে প্রায় বিকেল নেমে আসলো। এবার আমাদের বাড়ি ফেরার পালা।

আমাদের ভ্রমণটা ছিলো ডে ট্যুর। ফেরার পথে দেখলাম রাস্তার পাশে ঝাউগাছের সারি। একটু দূরে দেখা মেলে ম্যানগ্রোভ বনের। যার দৃশ্য সত্যিই অনেক সুন্দর। এ দৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ভ্রমণের সমাপ্তি হলো।

সতর্কতা

সৈকতে ঘুরতে গিয়ে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি এড়াতে দল বেধে যাওয়াই ভালো। কোনো বিপদ কিংবা অভিযোগ থাকলে সৈকতের ভ্রাম্যমাণ পুলিশ ফাঁড়িতে জানাতে পারেন। আর অধিক লোকের সমাগম আছে ওই দিকটায় থাকাই শ্রেয়।

সৈকতে বেড়াতে গেলে নিজস্ব ক্যামেরা নিয়ে যেতে পারেন। স্পিডবোড, নৌকা, ঘোড়া যেখানেই চড়ুন! আগে দেখে শুনে ভাড়া শুনে নিলে ভালো হয়।

কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন?

আবার যারা ঢাকা বা দেশের অন্যান্য স্থান থেকে আসবেন পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত দেখতে তারা প্রথমে চট্টগ্রাম শহরে চলে যাওয়া ভালো হবে। তারপর চট্টগ্রাম শহরের এ কে খান কিংবা জিইসি থেকে খুব সহজে যেতে পারেন সৈকতে।

পতেঙ্গা চট্টগ্রাম থেকে ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে। চট্টগ্রাম শহর থেকে অটো রিকশায় করে যেতে সময় লাগে ঘণ্টাখানেক। ভাড়া পড়বে ২৫০ টাকার মতো।

আর বাসে যেতে চাইলে তো কথাই নেই, বহদ্দার হাট, লালখান বাজার মোড়, জিইসি মোড়, নিউ মার্কেট, চক বাজার মোড় থেকে সরাসরি বাস পাবেন। বাসের গায়ে লেখা দেখবেন সি বিচ।

আর যারা চট্টগ্রামে বসবাসকারী তাদেরকে নতুন করে যাবার উপায় বলার দরকার নেই। সড়ক পথে যেতে চাইলে-অলংকার মোড়- এ কে খান হয়ে সরাসরি চলে যেতে পারবেন সৈকতে।

তাছাড়াও সি বিচ লেখা বাসগুলোতে চেপে বসলেই হবে শুধু। আর যদি নগরীর জিইসি মোড় থেকে যেতে চান তবে ১৮০-২০০ টাকায় সিএনজি অটোরিকশা নিয়েও যেতে পারবেন।

অন্যদিকে ট্রেনে বা রেলপথে কেউ চট্টগ্রাম আসতে হলে তাকে ট্রেনে ঢাকা-চট্টগ্রামের রুটে মহানগর প্রভাতি ঢাকা ছাড়ে সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে, চট্টলা এক্সপ্রেস সকাল ৯টা ২০ মিনিটে, মহানগর গোধূলি ঢাকা ছাড়ে বিকেল ৩টায়, সুবর্ণ এক্সপ্রেস ঢাকা ছাড়ে বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে, তূর্ণা ঢাকা ছাড়ে রাত ১১টায়। ভাড়া ১৬০-১১০০ টাকা।

আর যদি কেউ সেখানে রাত যাপন করতে চান তাহলে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল আছে উন্নতমানের। আবাসিক হোটেলগুলো ভাড়া নিয়ে রাত যাপন করতে পারেন।

আমাদের যেহেতু ডে ট্যুর ছিলো তাই আমাদের রাত যাপনের কোনো প্রয়োজন হয়নি। সব কিছু মিলে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এক চমৎকার ভ্রমণকেন্দ্র। চাইলে আপনিও ভ্রমণ করে আসতে পারেন পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত।

লেখক: ফেনী সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

জেএমএস/জেআইএম