ধর্ম

মুখ দ্বারা যেসব মারাত্মক গুনাহ সংঘটিত হয়

মুখ মানব দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এর সুন্দর ও সঠিক ব্যবহারে মানুষ হয় জান্নাতি। মুখ দ্বারা মানুষ কথা বলে। আর এ কথার দ্বারা মানুষ যেমন ভালো কাজ করে আবার এর দ্বারা সংঘটিত হয় অনেক গুনাহের কাজ। তাই মুখের হেফাজতের নিশ্চয়তায় জান্নাতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন স্বয়ং বিশ্বনবি।

Advertisement

মুখ দিয়ে মানুষ কথা বলে। কথা যেমন হতে পারে দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো কাজ, আবার কথার মাধ্যমেই ইচ্ছা-অনিচ্ছায় হতে পারে গুনাহ। যে গুনাহগুলো আবার মারাত্মক ও জঘন্যতম। কিছু গুনাহ মহান আল্লাহও ক্ষমা করবেন না। কারণ মহান আল্লাহ তাঁকে অস্বীকারের ঘোষণা দেওয়া ও গিবতকারীর গুনাহ কখনো ক্ষমা করবেন না। যা ঘটে থাকে মুখ তথা জিহ্বার মাধ্যমে। এছাড়াও আরো যেসব গুনাহ হয়ে থাকে তাহলো-

১. মিথ্যা কথা বলা

কথাবার্তা ও কাজকর্মে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করা কিংবা মিথ্যা কথা বলা মারাত্মক অপরাধ। কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন-

Advertisement

فَاجۡتَنِبُوا الرِّجۡسَ مِنَ الۡاَوۡثَانِ وَ اجۡتَنِبُوۡا قَوۡلَ الزُّوۡرِ

‘সুতরাং মূর্তিপূজার অপবিত্রতা থেকে বিরত থাক এবং মিথ্যা কথা পরিহার কর।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩০)

মিথ্যা মানুষকে পাপাচার তথা জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন-

‘তোমরা মিথ্যা থেকে দূরৈ থাকবে। কেননা মিথ্যা পাপাচার পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়। আর পাপাচার জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়। ব্যক্তি যখন অনবরত মিথ্যা বলতে থাকে, তখন আল্লাহর কাছে তাকে মিথ্যাবাদীরূপে লিপিবদ্ধ করা হয়।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)

Advertisement

২. গিবত করা

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যদিও গিবত জবানের গুনাহ কিন্তু এটা জেনা-ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক অপরাধ। সাহাবায়ে কেরাম এ কথা শুনে আশ্চর্য হলেন; গিবত কীভাবে জেনার চেয়ে মারাত্মক! তারা আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! গিবত কীভাবে জেনার চেয়েও মারাত্মক গুনাহ? নবিজি বললেন, মানুষ জেনা করে, পরে তওবাও করে; আল্লাহ তাআলা তাকে (জেনাকারকে) মাফ করে দেন। কিন্তু গিবতকারীর ক্ষমা তখন পর্যন্ত করা হয় না, যতক্ষণ না পর্যন্ত যার গিবত করা হয়েছে, সে মাফ না করবে।’ (বায়হাকি, মেশকাত)

৩. প্রমাণ ছাড়া কাউকে অভিযুক্ত করা

কাউকে প্রমাণ ছাড়া অভিযুক্ত করা যাবে না। প্রমাণ ছাড়া মানুষের দোষ প্রকাশ করা বা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে সামনে এনে কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা খুবই ঘৃণ্য এবং গর্হিত কাজ। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিকোন থেকে তা নিকৃষ্ট ও গুনাহের কাজ। আবার কোরআনুল কারিমের অন্যের গোপন বিষয় অনুসন্ধান করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيراً مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ

‘হে মুমিনগণ! তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয়ই কিছু ধারণা গোনাহ। আর গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়া পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা হুজুরাত : আয়াত ১২)

৪. গুজব ছড়ানো

যা শুনে তা বলে বেড়ানো বা প্রচার করা যেমন মারাত্মক মিথ্যাচার তেমনি তা গুজব তৈরির সবচেয়ে বড় সম্ভাবনারও তৈরি হয়। আর এর ফলে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষ। এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে-

হজরত হাফস ইবনে আসিম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়।’

৫. ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা

ঠাট্টা-বিদ্রূপ খুবই জঘন্য অপরাধ ও গুনাহের কাজ। ঠাট্টা-বিদ্রূপের মাধ্যমে মানুষ হেয় প্রতিপন্ন হয়। উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়। কোরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিতে এসব নিষিদ্ধ কাজ ও অত্যাচারমূরক অপরাধ। এসব লোক আল্লাহর কাছে জালিম হিসেবে স্বীকৃত। মহান আল্লাহ বলেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا یَسۡخَرۡ قَوۡمٌ مِّنۡ قَوۡمٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُوۡنُوۡا خَیۡرًا مِّنۡهُمۡ وَ لَا نِسَآءٌ مِّنۡ نِّسَآءٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُنَّ خَیۡرًا مِّنۡهُنَّ ۚ وَ لَا تَلۡمِزُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ وَ لَا تَنَابَزُوۡا بِالۡاَلۡقَابِ ؕ بِئۡسَ الِاسۡمُ الۡفُسُوۡقُ بَعۡدَ الۡاِیۡمَانِ ۚ وَ مَنۡ لَّمۡ یَتُبۡ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ

অর্থ : ‘হে মুমিনগণ! কোনো সম্প্রদায় যেন অন্য সম্প্রদায়কে ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর নারীরা যেন অন্য নারীদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপকারিণীদের চেয়ে উত্তম। তোমরা একে অন্যের নিন্দা করো না, একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। ঈমান গ্রহণের পর (ঈমানের আগে কৃত অপরাধকে যা মনে করিয়ে দেয় সেই) মন্দ নাম কতই না মন্দ! (এ সব হতে) যারা তাওবাহ না করে তারাই জালিম।’ (সুরা হুজরাত : আয়াত ১১)

৬. মন্দ নামে ডাকা

নাম বিকৃত করে অথবা মন্দ নাম বা মন্দ খেতাবে ডাকা অথবা ইসলাম গ্রহণ বা তওবাহ করার পর তাকে অতিত ধর্ম বা পাপ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে সম্বোধন করাও ব্যঙ্গ করার শামিল। যেমন এভাবে ডাকা- এই কাফের! এই ইয়াহুদি! ও হিন্দু! ওই লম্পট! হে মাতাল! ইত্যাদি শব্দ কিংবা মন্দ সম্বোধন করে ডাকা মারাত্মক জঘন্য অন্যায় ও গর্হিত কাজ।

ইসলামি শরিয়তে এভাবে মানুষের নামকে বিকৃত করে কিংবা অপমানমূলক ব্যঙ্গ করে ডাকা গুনাহের কাজ। আমরা অনেকে ইচ্ছা-অনিচ্ছায়, অড্ডা-কিংবা মজারছলে আসর জমাতে গিয়েও অন্যকে বিকৃত নামে ডেকে কথা বলে, যা ইসলামে জঘন্য অন্যায় ও গর্হিত কাজ। আল্লাহ তাআলা বলেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا یَسۡخَرۡ قَوۡمٌ مِّنۡ قَوۡمٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُوۡنُوۡا خَیۡرًا مِّنۡهُمۡ وَ لَا نِسَآءٌ مِّنۡ نِّسَآءٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُنَّ خَیۡرًا مِّنۡهُنَّ ۚ وَ لَا تَلۡمِزُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ وَ لَا تَنَابَزُوۡا بِالۡاَلۡقَابِ ؕ بِئۡسَ الِاسۡمُ الۡفُسُوۡقُ بَعۡدَ الۡاِیۡمَانِ ۚ وَ مَنۡ لَّمۡ یَتُبۡ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ

‘হে ঈমানদারগণ! কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডাকবে না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবাহ না করে তারাই অত্যাচারী।’ (সুরা হুজরাত : আয়াত ১১)

৭. কারো হৃদয় ভাঙা

কথা বলায় নিজেদের সংযত রাখা জরুরি। কাউকে এমন কোনো কথা বলা যাবে, যার ফলে মানুষের মনে আঘাত পায়। হৃদয় ভেঙে যায়। কেউ কোনো অন্যায় কাজ না করলে, ইসলাম বিরোধী কোনো কাজে জড়িত না থাকলে তার সঙ্গে অযথা ঝগড়া করে মনে কষ্ট দেওয়া বা তার মন ভেঙ্গে দেওয়া মারাত্মক গুনাহের কাজ। এ কারণেই নবিজি মুখের হেফাজতের নিশ্চয়তায় জান্নাতের নিশ্চয়তার কথা বলেছেন। ‘যে বা যারা দুই ঠোটের মাঝ খান ও দুই পায়ের মাঝখানের নিরাপত্তা দিতে পারবে আমি তাদের জান্নাতে নিরাপত্তা দেবো।’

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মুখ দ্বারা সৃষ্টি উল্লেখিত মারাত্মক গুনাহের কাজগুলো থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/এএসএম